ফারুক ফেরদৌস : কওমি মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থার স্বীকৃতি বাস্তবায়নের লক্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত ৯ সদস্যের কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছে বেফাক। চট্টগ্রামে বেফাক সভাপতি আল্লামা আহমদ শফীর উপস্থিতিতে বেফাকের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক গতকাল সকাল ৯ টায় শুরু হয়ে বিকেল পর্যন্ত চলে। বৈঠকটি নিয়ে আগ্রহ ছিলো সারা দেশে। দুপুরের মধ্যেই সবাই বেফাকের সরকার গঠিত কমিটি প্রত্যাখ্যানের খবর পেয়ে যায়। এরপর এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা শুরু হয়ে এখনো চলছে। চট্টগ্রামের বৈঠকটিতে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা যে সারা দেশের সিংহভাগ আলেমের প্রতিনিধিত্ব করেন এ নিয়ে কারো সন্দেহ নেই। অনেকেই বৈঠকের সিদ্ধান্তকে সঠিক আখ্যা দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ আবার বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বলছেন, বৈঠকে ব্যক্তি বিদ্বেষের প্রতিফলন ঘটেছে। কেউ কেউ বলছেন, সিদ্ধান্তটি সুচিন্তিত হলো না। ঘোষিত কমিটির নেতাদের সাথে আলোচনায় বসতে পারতো বেফাক কর্তৃপক্ষ।
ফেসবুকে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার শিক্ষক ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটির লেকচারার মাওলানা মামুনুল হক লিখেছেন, বেফাকের চট্রলাবৈঠকের সিদ্ধান্তে মনে কিছুটা সাহস পাচ্ছি৷ মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়েনি কওমী ওলামাদের ৷ সরকারের ভেংচি দেখে লেজ গুটিয়েও নেন নি তারা ৷ আবার হঠকারিতার পথও ধরেন নি ৷ প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাত করে সঠিক পথ দেখানোর সিদ্ধান্ত খুবই ভারসাম্যপূর্ণ ৷ সরকারের যদি শুভবুদ্ধির উদয় হয় তো ভালো কথা ৷ আর যদি একগুঁয়েমির পথেই হাটে সরকার, তবে হার্ড লাইনে চলার পদ্ধতি জানা আছে ওলামায়ে দেওবন্দেরও ৷ কওমী মাদরাসা কোনো সরকারের করুণার ফসল নয় ৷ ওলামায়ে কেরাম মাদরাসা গড়েছেন ৷ সরকারের কাছ থেকে করুণা নয়, স্বীকৃতির অধিকার আদায় করতে হবে৷ আমাদের কথা পরিষ্কার, ওলামায়ে কেরাম তাদের প্রতিনিধি ঠিক করবেন, প্রয়োজনে সরকার তার আস্থাভাজনদেরকে কো-অপ্ট করবে ৷ সরকারের গড়া কোনো কমিটি কওমীর কল্যাণ করবে না, সরকারের এ্যজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে ৷ ওলামায়ে কেরামের আস্থার বাইরে সরকারের স্বীকৃতি যাদের দরকার তাদের জন্য আলিয়ার দুয়ার তো খোলাই ৷ কাজেই ওলামায়ে কেরামের আস্থা ছাড়া সরকারের স্বীকৃতি দিয়েই কেল্লা ফতেহ হয়ে যাবে, এমন ভাবনা সঠিক নয়৷
প্রখ্যাত কবি ও লেখক মুহিব খান তার দীর্ঘ স্ট্যাটাসে কওমি সনদের স্বীকৃতি চাওয়ার বিরুদ্ধে নানা যুক্তি তুলে ধরেছেন। সরকার স্বীকৃতি দেওয়ার চেয়ে আমাদের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যই বেশি উন্মুখ মন্তব্য করে তিনি লিখেছেন, আমাদের বুঝতে হবে যে, শাসকশক্তি আমাদেরকে (কওমি মাদরাসা ও আলমেদেরকে) স্বীকৃতি দেওয়ার চেয়ে আমাদের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যই বেশি উন্মুখ। এতে যদি শাপলার লাল রক্ত কিছুটা ফিকে হয়ে আসে আর চির জাগ্রত আপোষহীন সত্য-শক্তি কওমি অঙ্গনকে কায়দা করে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে পরাধীনতা ও বাতিলবিরোধী মূল চেতনা ও ইতিহাস থেকে বিচ্ছিন্ন ও অথর্ব করে দেয়া যায়! সে প্রক্রিয়াই হয়তো চলছে। আমরা না বুঝে অনেকেই খুব খুশি। অনেকের শুধু সম্ভাব্য সুবিধার দিকগুলোই স্বপ্ন হয়ে চোখে ভাসছে। অনেকে একে ঐতিহাসিক প্রাপ্তি ভেবে ইতিহাসের নায়কদের একজন হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকতে উঠেপড়ে লেগেছেন। কওমি সংস্কার ও উন্নয়ন নি:সন্দেহে সময়ের সর্বাধিক প্রয়োজনীয় স্বতন্ত্র একটি কাজ, এর সঙ্গে সরকারি সনদ গ্রহণকে এক না করাই উচিত, কারণ এখানে অন্য অনেক সতর্কতার বিষয় বিদ্যমান। শুধু এ সরকার নয়, সব সরকারের ক্ষেত্রেই কথাটি প্রযোজ্য।
আওয়ার ইসলামকে দেয়া ফরিদ উদ্দীন মাসঊদের সাক্ষাতকারের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে আওয়ার ইসলামের নির্বাহী সম্পাদক রোকন রাইয়ান লিখেছেন, সারাদিন বৈঠক করে শেষ পর্যন্ত বেফাক কওমি স্বীকৃতি বাস্তবায়ন কমিটি প্রত্যাখ্যান করল। আলেমগণ যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটাতে আমি একমত। তবে আমার মনে হয় আরেকটু ভাবার দরকার ছিল। এই প্রত্যাখ্যান প্রত্যাখ্যান খেলা তো দীর্ঘ বছর ধরেই চলছে। মাওলানা ফরিদ মাসউদ সাহেব তো সব রকম শর্ত মানতেই রাজি ছিলেন এবং বিবৃতিতে জানিয়েছেন। তো সেখানে বেফাকের চাহিদা পেশ করার একটা সুযোগ ছিল। সেটা পেশ করার পর যদি উনি না মানতেন তবে তখন প্রত্যাখ্যান করা যেত। যুক্তি তো এটাই বলে নাকি? সেটা না করে বিনা বাক্যে কেন কেন প্রত্যাখ্যান সেই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। যাই হোক ভবিষ্যত সময়ই বলবে, তবে আমার মতে প্রত্যাখ্যানের আগে আরো ভাবার আছে।
বেফাকের প্রত্যাখ্যানের নিন্দা জানিয়ে শোয়াইব জিয়া লিখেছেন, বেফাকের বিবৃতি: যেন পরাজিত'র আর্তনাদ!!
* স্বীকৃতি নিয়ে নিচ্ছে ৪ বোর্ড!
* বেফাক ঘোষিত উলামা সম্মেলনে ৪ বোর্ড হতে সম্ভবত কেউ আসছেননা!
* কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন কাউকে বাধ্য করবেনা। যাদের ইচ্ছে কমিশন হতে স্বীকৃতি নেবেন।
* স্বীকৃতি শুধুমাত্র দাওরায়ে হাদিসের হবে। তাই আপাতত অভিন্ন সিলেবাস হচ্ছেনা!
একসময় বেফাক স্বীকৃতি'র পক্ষে ছিলেন! পরে বিপক্ষে গেলেন! সর্বশেষ আবারো পক্ষে এলেন আজ। আর বেফাকের বাইরের অন্য বোর্ড গুলিরও একিই অবস্থা। সম্মিলিত কাওমী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ব্যনারে.. তারাও একসময় বিপক্ষে এবার পক্ষে।
সর্বশেষ গত ২৭ তারিখ সরকার বেফাকের বাইরের বোর্ডগুলো নিয়ে কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশনের চূড়ান্ত আইন পাশের জন্য একটি কমিটি ঘোষণা করেন। ঘুম ভাঙ্গে বেফাকের ২৪ ঘন্টার মধ্যেই জরুরী বৈঠক!! কমিটি প্রত্যাখ্যান। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ'র ঘোষণা। শুধুমাত্র বেফাক ও আল্লামা আহমাদ শফী এর নেতৃত্বে স্বীকৃতি চাই ধরণের একগুয়ে দাবি।
এ যেনো পরাজিতের আর্তনাদ!!
বেফাক চাইলেই পারতো সরকার ঘোষিত কমিটিতে ফরিদ উদ্দীন মাসউদ কে সদস্য করে অন্য কাউকে আহব্বায়ক করার দাবি জানাতে। মাওলা রুহুল আমিন সাহেবকে সদস্য রেখে তরুন ভিন্ন কাউকে সদস্য সচিবের পদ দিতে। নতুন কোন সদস্য বাড়নো প্রস্তাবনাও দিতে পারতো। কারণ ঐ প্রজ্ঞাপনে সদস্য বাড়ানোর কথা বলাই আছে।
চট্টগ্রামের বৈঠকে ব্যাপারে লালবাগ জামিয়ার ইফতা বিভাগের ছাত্র আশরাফ মাহদি লিখেছেন, দরবারের বিশেষ লোকজনের নেতৃত্বে যে নব্য কমিটিটা গঠন হয়েছে সেটাকে আমি আপনি যেভাবেই দেখি বেফাক সেটাকে নিজের অস্তিত্বের জন্য বিরাট হুমকি হিসাবে নিয়েছে। কারণ পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বেফাককে বাদ দিয়েই সরকার ফরিদ সাহেবের গঠিত কমিশনকে স্বীকৃতি দিয়ে দিবে। বাস্তবতা হচ্ছে বেফাকের ক্ষমতা নাই নব্য কমিটির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। তার উপর আবার আব্দুল কুদ্দুস সাহেব ও শাহ সাহেবদের মত হযরতদের নাম তাদের অজান্তেই নতুন কমিটিতে তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। এসব দেখে বেশ তড়িঘড়ি করে ও বিরাট বড় আশা নিয়ে হাটহাজারীর হযরতদের শরণাপন্ন হয় বেফাক। চেয়েছিলো সরকারী আলেমদের বিপক্ষে আজকে একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফিরবে। সেই কমিটি প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্তে যদিও মনে হচ্ছে বেফাক অনেকটা সফল কিন্তু এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন থেকে যায়। ওলামায়েকেরামের সাক্ষাত করার প্রস্তাবকে সরকার কেনইবা অতিরিক্ত গুরুত্বের সাথে নিবে? তাছাড়া এর আগের মিটিংয়ে হেফাজত বলেছিলো শিক্ষানীতি বাতিল না করলে তারা স্বীকৃতি নেবে না। আজকে তো শিক্ষানীতি নিয়ে কোন আলাপ কেন হলোনা? শফি সাহেব পুরো বৈঠকে একটা টু শব্দও করেননি। এদিক থেকে দেখলে বলতে হবে যে হেফাজতের এই নমনীয়তায় বেফাকের প্রত্যাশাগত জায়গা থেকে বেশ হতাশ। ঘটনাগুলো এভাবেই ঘটছে তাই এইগুলাই হলো ফ্যাক্ট। তবে এখানে আমার আপনার নীতিগত সিদ্ধান্তটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পক্ষ বিপক্ষ উভয়েই যে স্বীকৃতি চাচ্ছে সে বিষয়টা বেশ স্পষ্ট। বিরোধটা হচ্ছে কেবলমাত্র পদ্ধতিগত জায়গায়। এখন আমাদের কোন একটা পক্ষকে সমর্থন করতে হলে সিদ্ধান্তে পৌছতেই হবে। এবং যেকোন সিদ্ধান্ত নেবার আগে সামনে রাখতে হবে এই ফ্যাক্টগুলিকে। একইসাথে হাটহাজারীর এই বৈঠকে সকল ওলামায় কেরাম ঐক্যমতের ভিত্তিতে কেন সরকারী ওলামাদের পক্ষটাকে প্রত্যাখ্যান করলো সেটা বিশ্লেষণ করে কারণটা খুঁজে বের করতে না পারলে বিভ্রাটের ব্যাপক সুযোগ আছে ।
বেফাকের কমিটি প্রত্যাখ্যানের সিদ্ধান্তে হতাসা প্রকাশ করে নুরুল্লাহ মারুফ লিখেছেন, সেদিন খুব বেশি দুরে নয় যেদিন কওমির ভবিষ্যত প্রজন্ম বিক্ষুব্ধ হয়ে বেফাককেই প্রত্যাখ্যান করে বসবে। স্বীকৃতি নিয়ে যা শুরু হয়েছে তাতে অনাগত অসহনশীল কওমি তরুণদের ধৈর্য আর কতদিন বহাল থাকে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
এফএফ