মাসুদ খান:
মৎস্যস্বভাবা
মা জননী, প্রজায়িনী, ওরে ঔদরিক,
এতটাই বুভুক্ষা তোমার!
আগে-আগে খেয়ে ফ্যালো যারা ছিল শ্রেষ্ঠ
সন্তান তোমার!
তারপর করো শোক
মা আমার,
ধীরা ধারিণী আমার,
হয়ে ওঠো অধীরা আকুল।
‘কোথায়? কোথায় আহা আমার সোনার সন্তানেরা?
শস্যজ্যোতির ঝিলিক-ঝরানো সেই বাছারা আমার?’--
ব’লে হাহাকার করতে করতে ধেয়ে যাচ্ছ তুমি
শ্যাওলাঘোলা এক দূর পিচ্ছিল ভবিষ্যতের দিকে
জটাস্যজটিল ইতিহাস ও মলিন মানচিত্রে বাঁধা
এ পোড়া দুর্ভাগা জলরাজ্য জুড়ে
তীব্র তোলপাড় তুলে, তুমুল মাতম করে ফিরছ জননী।
আয়ত্ত করেছ বটে তুমি মাতা মাছের স্বভাব।
আর এই ঘোলাটে জলায়তনে জলজেরা উৎকণ্ঠিত চেয়ে দ্যাখে--
সন্তানের শোকে
ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছে উন্মাদিনী সে মৎস্যজননী।
বৃষ্টি-৩
রাত্রিতে তুমুল বৃষ্টি আজ
বিজলি আর ঝোড়ো হাওয়াসহ।
আজ রাতে যেইখানে যত বাক্য আছ অর্থহীন হাবা-হাহাকার
যত বাক্য আছ ঠাণ্ডা আততায়ী উদ্বাস্তু ফেরার
যত বাক্য আছ ভাঙা-ভাঙা আর ভাঙাচোরা আর ফ্র্যাগমেন্ট
হঠাৎ ঝিলকে ওঠা দুনিয়ার যত লিপিহীন ভাষার কথারা,
স্ফুট ও অস্ফুট সব কথা--
দণ্ডে-দণ্ডে পলে-পলে অযথা-উৎপন্ন যত কথা, কথার শ্রাবণ--
আজ রাতে এত চেষ্টা করছি
ওইসব পালিয়ে-থাকা, অবিরাম পলায়নপর,
অসহায়, ঠাণ্ডা যত বাক্যে বাক্যে অর্থ আরোপের, উষ্ণতা আরোপের,
কথাগুলি সংগঠিত করবার--
কিন্তু নিষ্ফল!
কোনো বাক্য, কোনো বাণী বা বচন--ম্লেচ্ছ কিংবা মহাজনি, কিংবা নিরাকার--
কিছুই আজ আর অর্থ পাচ্ছে না, আকার পাচ্ছে না।
হাইপার রিয়ালিটি
মরণের পর মা-রা দেহ ছেড়ে চলে যান দূরের বিদেহপুরে।
তারপর প্রতিদিন ওই ব্যস্ত বিদেহনগর থেকে এসে
ঘুরে ঘুরে দেখে যান যার-যার ছেড়ে-যাওয়া সোনার সংসার।
অন্তত প্রথম ত্রিশ দিন।
কী করছে আহা সোনামণিরা তাদের,
কেমনই-বা কাটছে তাদের দিন, মাতৃহীন...
বিষাদবাতাস, ঘন দীর্ঘশ্বাস, ফাঁকা-ফাঁকা ঘরদোর, আশপাশ...
নবমৃত মায়েদের কি-জানি কেবলই মনে হতে থাকে--
বেঁচেই আছেন তারা সংসারে, হয়তো
সংসারেরই ভিন্ন কোনো সম্প্রসারে-- মায়ায়, আবেশে।
যেমন জন্মের অব্যবহিত পরের কিছুদিন
নবজাতকের কাছে
মনে হতে থাকে যেন সে রয়েছে তখনো মায়েরই গর্ভকোষে।
পরিত্যক্ত অ্যারিনায় নৈশ অধ্যায়
মৃত এই প্রেক্ষাক্ষেত্রে কারা আসে আবার সজীব?
ধৃতরাষ্ট্র! হাঃ, সেও এসেছে! সে তো এখন পর্যন্ত জ্যান্ত, জীব।
জীব আর কতটা দীপনশক্তি ধরে রাখে এই ব্যাপ্ত
ক্লীব অন্ধকারে? জাড্য থেকে দ্রুত মুক্ত হয়ে এস জড়, তুমিই পর্যাপ্ত
শক্তিশীল। অন্যথায় আজ খুব রক্তা-
-রক্তি হবে। উপরন্তু আসক্তি থেকেই যাবে যাক, অবিভাজ্যের প্রবক্তা।
প্রকাশ থাকে যে, লাশে জ্যান্তে আজ ইকেবানা, চূড়ান্ত বিন্যাস।
লাশ জ্যান্ত লাশ লাশ জ্যান্ত লাশ জ্যান্ত লাশ লাশ।
যতটুকু তাপ পেলে সোজা নির্বেদাঙ্কে পৌঁছা যায়, ঠিক
ততটুকু দস্তা ছিল, তেঁতুলবৃক্ষও ছিল ঝুঁকে উপলব্ধির দক্ষিণ দিক।
তাপ আর তেঁতুলবৃক্ষ তো পৃথগন্ন নয়। নিঃসঙ্গ মৌমাছি তার ফরমিক বিষের
প্রতাপ হারায় জমজমাট কংগ্রেস থেকে ফিরে একা। তাহলে কিসের
তাড়না এসব? শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মের এই অণ্ডটিতে ছোট ছিদ্র হবে, ছাইরং
ধারণা নির্গত হবে। অবিরল ধারণার স্রোত শুধু-- গদ্যাকার, লু, লিপ্ত এবং
স্থূল। শাস্ত্র খুঁড়ে তুলে-আনা শিয়াকুল গাছ; ডালে গর্জমান সে-রহস্যমাংস
হুলো বিড়ালটি-- নৈশ ডিজাইনে ঢোকানো শরীর যার তাড়াতাড়ি তিন-তৃতীয়াংশ।
শাস্ত্রের যে-পাশ দিয়ে বিপর্যয় বেঁকে ছুটতে থাকে সদ্য-ছিন্নমুষ্ক ষাঁড়ের গতিতে
অস্ত্রের প্রভাবে, ঠিক বিপরীতে, ঝাঁক-ঝাঁক ফলে থাকে কার্পাস, সিঁড়িতে।
মিল-এ যাব, হেঁটে হেঁটে, সুদূর-উদ্দিষ্ট, আলোজ্বলা, কাপড়ের।
চিলেকোঠা থাকে, কালো পিপীলিকা থাকে অনেকের। অবিমৃষ্যকারীদের?
কোনও রন্ধ্র নেই, পরিপাশে
শোনো, নকটার্ন ভেঙে ভেঙে যায় আজ এই অনর্থক বরেন্দ্র-উল্লাসে।
হোমাপাখি
পড়তে থাকা শুরু হলে একবার, জানি না কতটা পতনের পর সূচিত হয় উত্থান আবার--
ভাবছি তা-ই আর মনে পড়ছে সেই হোমাপাখিদের কথা যারা থাকে আকাশের অনেক উঁচুতে। আকাশেই ডিম পাড়ে। পড়তে থাকে সেই ডিম। কিন্তু এত উঁচু যে পড়তে থাকে দিনের পর দিন। পড়তে পড়তেই ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। তখন বাচ্চা পড়তে থাকে। পড়তে পড়তেই বাচ্চার চোখ ফোটে, ডানা হয়, পালক গজায়। একদিন দেখতে পায় সে পড়ে যাচ্ছে। অমনি চোঁ করে উড়ে যায় মায়ের দিকে। উঠে যায় অনেক উঁচুতে। এত উঁচুতে যে পাখিরা আকাশের গায়ে ইতস্তত ভাসমান তিলচিহ্ন হয়ে ফুটে থাকে।
ওই পক্ষিকুলে জন্ম পুনর্জন্ম আমাদের, ওই পক্ষিকুলেই পালন-পোষণ-পতন-উত্থান-উড্ডয়ন...
যজ্ঞ
তোমার সহিংসতাটুকু আমিই তোমার হয়ে
সেরে আসি বাইরে গিয়ে রাতে। তবেই-না তুমি
সম্পূর্ণ অহিংসরূপে স্বর্গসুখে সুখনিদ্রা যাও।
ভোর রাতে জেগে উঠে বলো-- 'বাহ্! করেছ কী কাণ্ড!
বাইরে কী অপরূপ রক্তবিকিরণ!
স্প্রাং রিদমের তালে-তালে জম্বি ছন্দে চলছে যজ্ঞ মনুমেধ--
ওই যে থ্যাঁতলানো দেহ-- প্রতীকপ্রতিম, ছিটকে-পড়া ঘিলু-- রূপকসমান,
পোড়ানো হাত-পা মুখ-মাথা-- উপমেয়হারা উপমান,
কাটা মুণ্ডু, ফাটা জিভ, বিমূর্ত চিত্রের মতো নাড়িভুঁড়ি, অনুপ্রাস,
থকথকে কূটাভাস, চকচকে চিৎকার, সত্রশিখা, উগ্র আগ্নেয় তুফান...
থেকে থেকে যজ্ঞপটে জেগে ওঠে ভৌতিক জবান।
যোজনগন্ধার গন্ধকাহিনির মতো চমৎকার
রক্তের সুবাস ভেসে আসছে জানালায়।'
সেইসঙ্গে এও বলো--
'যদি পারো মুছে ফেলো সব আর্ট, তাড়াতাড়ি।
বিমূর্ত চিত্রের রূপ-- মূর্ত তো থাকে না বেশিক্ষণ।'
এসএস