হাসান রুহানী: আওয়ার ইসলাম
স্থান কখনও চরিত্র হয়ে ওঠে। কাল মহাচরিত্র। চরিত্র হয়ে ওঠে দুশ্চরিত্র। গল্পে চরিত্রের বহুরুপিতা খুব ভয়ঙ্কর। আজকাল তো গল্পে চরিত্রকে নাকচ করা হচ্ছে। আমার গল্পে প্লাটফর্ম চরিত্র হতে পারত। অথবা সূত্রপাত। হয়নি। কোনওটাই। কারণ প্লাটফর্ম চরিত্র বা প্রতীক হিসেবে পুরনো। প্লাটফর্ম থেকে গল্পের সূত্রপাত হওয়াটাও পুরনো। অবশ্য পুরনোকে নতুন আদলে পেশ করারও নতুনত্ব ছিল। আমি সেই রাস্তাও অবলম্বন করতে পারিনি। আমার আছে অপারগতা। আমি জানি শিল্পী সাহিত্যিকরা জীবনে হন লাগামহীন। শিল্পে তার উল্টো। আবার তাদের জীবনের লাগামহীনতার থাকে অলিখিত শৃঙ্খল। এখানে এসে তাদের জীবন ও শিল্প সমান্তরালে বয়। আমার জীবন আমার এ বক্তব্যের ঠিক বিপরীত মুদ্রা। আমার জীবনে অলিখিত শৃঙ্খলতা প্রধান। শিল্পে লাগামহীনতা। তাই গল্প লিখতে বসে গল্পের প্লাটফর্ম রচনা করি। গল্পের কলকব্জা নাড়তে গিয়ে ফাঁদি গল্পের পর গল্প।
আমি যখন খেতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাড়ির লম্বা সাজানো রাস্তাটা অবাক হয়ে দেখছি তখণ প্লাটফর্মের বুক থেকে স্টেশনের নাম মুছে গেছে। স্টেশন থেকে বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল বলে সোজা খেত মাড়িয়ে আসা। নইলে ঘোরপথে বাড়ির ভেতর দিয়ে ছায়াছায়া ছোট্ট পথ ছিল। যেটা মূলত পথই। রাস্তা না- নসিব শাহের বাড়ির এ রাস্তাটা যেমন। খেত থেকে রাস্তায় না উঠে রাস্তা যেখানটাতে বাড়ির উঠোনে পড়েছে তার কোণটায় গিয়ে উঠলাম। দুটো সুপারি গাছের মাঝখান দিয়ে। নতুন রাস্তা । নতুন বাড়ি। গাছগুলোও বাচ্চা বাচ্চা। ঘরের সামনের বেড়ায় নীল সাইনবোর্ড সাঁটা। উপাধিহীন। বড় করে লেখা নসিব শাহ। নিচে বিস্তারিত।
স্বপ্নে ছিলাম। অথচ স্বপ্নেও ভাবিনি জীবনে কোনওদিন নাটক নাকরা আমি এত সুন্দর অভিনয়টা করতে পারব। বাড়িতে ঢুকেই তেড়া করে হাঁটু দুটো ফেলে দিলাম। বাবা বাবা করে জুড়ে দিলাম কান্না। চোখে জলও আসছিল। আমার কান্নায় নসিব শাহ ভাতের প্লেট ঠেলে দিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে এলেন। আমাকে ওরকম খোঁড়ার মত পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিলেন মোটা এক মুগুর। এসেই বাড়ি ফেলবেন পায়ে। আমি থামিয়ে দিলাম।
ততক্ষণে লোকজন জড়ো হয়ে গেছে। সবার চোখেমুখে একটা বিবেচক বিবেচক ভাব। মুখে মুখে নসিব শাহের কবিরাজি কারিশ্মা । কেউ কেউ কারিশ্মা ভাঙতে চায়। পারে না। তার আগেই নসিব শাহ বা তার পক্ষের লোকগুলো একশো একটা খোঁড়া যুক্তি ছুঁড়ে দিচ্ছে। গাঁয়ের লোকেরা ওতেই কুপোকাত। এরমধ্যে আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম। নসিব শাহ তার চিকিৎসার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। আমার ভেতরে শুরু হয়েছে ঢিপ ঢিপ ভয়। আমার সুস্থ শরীরটাতে কি থেকে কি করে ফেলে চিকিৎসার নামে। দেখি একটা ছেলে কীসব গাছপাকড়া কুটিকুটি করে পেষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছেলেটা দেখতে আমাদের গাঁয়ের আরেকটা ছেলের ছোটভাই টাইপের। আমার ঘোর সন্দেহ হলো। ছেলেটা হয়ত বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে এই আকামে যোগ দিয়েছে। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম,
এই ছেলে তোর বাড়ি কই?
নেত্রকোনা।
জেলার নাম শুনেই আমি শিওর হয়ে গেলাম। আমার সন্দেহ সত্যি। অধীর হয়ে বললাম,
নেত্রকোনা কোন গ্রামে? থানার নাম জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন বোধ করলাম না।
ও থতমত খেয়ে গেল। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ক্ষাণিক কুচকে গেল। ও আমাকে চিনতে পারছে না ঠিক। কারণ আমি যখন বাড়ি ছেড়ে আসি। সপরিবারে। ও তখন অনেক ছোট। তাছাড়া আগেও কখনও বাড়িতে আমি নিয়মিত ছিলাম না। ভয়ে ছেলেটা গ্রামের নাম বলতে পারছে না। ইংরেজিতে বানান করছে জে ও ওয়াই… । আমি গালে ছোট্ট একটা থাপ্পড় কষিয়ে বললাম, জয়কৃষ্ণনগর তো? ও আমতা আমতা করে বলল,
হুঁ।
সাইখুল তোর বড় ভাই না?
হুঁ
আচমকা ঘুম ভেঙে গেল। কবিরাজির অজানা ঢিপঢিপ ভয়টা থেকে মুক্তি পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে কাউকে একটা ফোন দিতে মন চাইল । ছেলেটা আসলে হারিয়েছে কিনা। ছেলেটার অবস্থানটা অন্তত জানিয়ে দিয়ে ওর বাবা-মার আত্মায় শান্তি পৌঁছানো যায়। কিন্তু ফোন দেওয়া আর হলো না। ফোন দিলে বাড়ির লোকেরা হয়ত আমাকে নিয়ে হাসবে। আমিও ওই বয়সে একবার বছরখানেক ওই সিলেট চট্টগ্রামে পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম বলেই ছেলেটাকে এভাবে স্বপ্নে দেখা। এই ভেবে ওরা আমাকে হাসির পাত্র বানাবে।
স্বপ্নটা দেখার পর বড় একটা গল্পের প্লট মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। চিকিৎসার নামে লোকটা আমার কী হাল করতে পারত? ওর বিরুদ্ধে একশন নিয়ে কতটুকু সফল হতে পারতাম এদ্দূর থেকে গিয়ে? ওর পক্ষে থাকত গাঁয়ের সাপোর্টাররা। থানা পুলিশ প্রশাসন তো ওর পক্ষেই থাকত। সবচেয়ে বড় ভয় ছিল ওই ছেলেটাকে নিয়ে। ওর খোঁজ বাড়িতে জানিয়ে দিতে পারি এই ভয়ে ও আমার একটা ক্ষতিও করে ফেলতে পারত। কারণ আমি জানি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরে একটা ছেলে কি করে আমার মত সংবাদদাতা থেকে বেঁচে থাকতে চায়। মোটকথা আমি কেনই বা গিয়েছিলাম সিলেটের ওই নাম নাজানা গ্রামটায়। কবিরাজটার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্যে? এও কি সম্ভব?
এসএস