ইমরান আনোয়ার; কাতার থেকে
কাতার। আরব উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল থেকে উত্তর দিকে প্রসারিত একটি সমৃদ্ধশালী দেশ। ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি সুরক্ষার অন্যতম কেন্দ্র ভাবা হয় ক্ষুদ্রায়তনের এ দেশটিকে। প্রগতি, উন্নয়ন, আধুনিক অবকাঠামো-ব্যবস্থার চোখধাঁধানো উৎকর্ষতায় বর্তমানে দেশটি পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় জনপদে রূপান্তরিত হয়েছে।
আধুনিক কাতারের জনক শাইখ হামাদ বিন খালিফা আল-থানি ১৯৯৫-এর জুনে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহণ করেন। এরপরই বদলে যেতে থাকে দেশটির বর্ধমান রূপ। সে ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে বর্তমান আমির তামিম বিন হামাদ আল-থানি'র শাসনামলেও। খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে পরিপূর্ণ উপসাগরীয় এ ভূখণ্ডটি একদিকে যেমন বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে, অন্যদিকে তার ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং ইসলামি রেনেসাঁ-আদর্শকে পৃথিবীবাসীর সামনে তুলে ধরেছে সুনিপুণ কৌশলে।
শিক্ষা, অর্থনীতি, মানবসেবা উন্নয়নের পাশাপাশি ধর্ম প্রচারেও দেশটি লাভ করেছে প্রভূত সাফল্য। দাওয়াতি মেহনত, মানবিক মূল্যবোধ চর্চা, বিশ্ববরেণ্য আলেমদের যথাযথ মূল্যায়ন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদশি কর্মীদের কাজের স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে দেশটি হয়ে উঠেছে আরব-অনারবের অভূতপূর্ব মিলনমেলা!
কাতারে রাষ্ট্রায়ত্ব অন্য সকল প্রতিষ্ঠানের মত ধর্মীয় কার্যক্রমও পরিচালনা হয় একটি বিশেষ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে। 'ওয়াযারাতুল আওকাফ ওয়াশ-শুঊনিল ইসলামিয়াহ' বা 'ধর্ম মন্ত্রণালয়' হিসেবে পরিচিত এ প্রতিষ্ঠান বিশ্বের যে কোন মুসলিম স্কলারকেই উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করে থাকে।
এবং নিজেদের প্রকল্পভুক্ত যে কোন পবিত্র দায়িত্ব পালনে বিশ্বের সুপরিচিত ইসলামি ব্যক্তিত্ব, দক্ষ আলেম এবং সুমিষ্ট তিলাওয়াতের অধিকারী কুরআনের হাফেজদের কর্মসংস্থানেরও আয়োজন করে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতিভাবান হাফেজ-আলেমদের মনোনিত করে তাঁদের উপর এখানকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক, ইমাম, খতিব ও মুয়াজ্জিনের অপরিহার্য দায়িত্ব-ভার তুলে দেওয়া হয়।
তুলনাগত বিচারে দায়িত্ববান কর্মকর্তাদের সিংহভাগই আসেন বাংলাদেশ থেকে; যা একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদা ও গর্বের।
দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশীরাই এগিয়ে
আগেই বলা হয়েছে, পুরো বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠী থেকে নির্বাচিত হাফেজুল কুরআন এবং বিদগ্ধ আলেমগণ এখানে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত আছেন। তবে তাঁদের মধ্যে কর্মদক্ষতা ও সীমাহীন নিয়মানুবর্তিতার কারণে বাংলাদেশি ইমামগণ আলাদাভাবে সবার নজর কেড়েছেন।
বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ আলেম, আন্তর্জাতিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত হাফেজে কুরআন, ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত কিংবা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে আসা ছাত্ররা এখানে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। ফলে অন্যান্য দেশের তুলনায় নির্বাচিত ইমামদের মাঝে বাংলাদেশিদের চাহিদা ও প্রাধান্য পরিলক্ষতি হয়।
তাঁরা এ দেশে নিজেদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে অন্যান্য প্রবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্কের কারণে সবাই যেন এখানে আপন ভূমিকেই অনুভব করার স্বাদ পেয়ে যান!
যে পদ্ধতিতে ইমাম এবং মুয়াজ্জি নির্বাচন করা হয়
এখানে মূলত দুটো পদ্ধতিতে ইমাম নির্বাচন করা হয়। এক. বছরের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে কাতারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটো শরয়ী কিতাবের পরীক্ষা নেওয়া হয়। এবং তা হয় লিখিত আকারে। যারা সেখানে উত্তীর্ণ হন তাদের আহ্বান করা হয় কুরআন হিফজের পরীক্ষার জন্য।
ছয় কিংবা সাত সদস্যের পরীক্ষক-বোর্ড একজন পরীক্ষার্থীর সার্বিক মান বিবেচনা করে তাঁকে মসজিদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেন। কুরআন হিফজ, সুন্দর আযান, যথার্থ বয়স, আরবী বাক্যালাপ, এ বিষয়গুলো থাকে মূলত পরীক্ষার বিবেচনাধীন বিষয়।
দুই. ধর্ম মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ বিভিন্ন সময় পর্যায়ক্রমে বিদেশ সফর করেন। উদ্দেশ্য থাকে দেশগুলোর সেরা হাফেজ এবং আলেমদের বাছাই করে এখানে মসজিদের দায়িত্বে নিযুক্ত করা। এটি হয় সম্পূর্ণ সরকারি ব্যবস্থাপনায়।
ফলে প্রক্রিয়াটি ব্যপক সাফল্য এবং উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয়। গত বছর দুয়েক আগেও বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ হাজার হাফেজের মধ্য থেকে একশ' জনকে বাছাই করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। যাদের অধিকাংশই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় একাধিকবার প্রথমস্থান অর্জনের সাফল্য দেখিয়েছেন। কেউ কেউ এমনও আছেন যারা চার-পাঁচটি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের নাম উজ্জল করেছেন।
যে স্বপ্নে আলোড়িত হয়ে এখানে সবার আগমন হয়
একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন গঠনের লক্ষ্যে প্রতিটি মানুষই চেষ্টা করেন নিজের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির। এবং যেহেতু দুনিয়া-আখেরাত উভ-জগতের কল্যাণ সাধিত হয় এ পবিত্র পেশায়, ফলে ইমাম কিংবা মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পেতে ভীষণভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেন বিশ্বের তাবৎ আলেম-ওলামা।
বাদ যান নি ধর্মভীরু বাংলাদেশি আলেমগণও। জীবনের টানে এবং খোদায়ী প্রেমে প্রবাসী-জীবনকেই তাঁরা বরণ করে নিয়েছেন সাবলীলভাবে। মর্যাদাপূর্ণ ইমাম এবং মুয়াজ্জিনের চাকরিতে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন অকুন্ঠ ভালবাসায়। সম্মানিত ইমাম এবং মুয়াজ্জিগণ তাঁদের কর্মক্ষেত্রে যোগ দেওয়ার কয়েকমাস অতিবাহিত হলে তাঁদের পার্মানেন্টলি নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে থাকে ট্রেনিং পিরিয়ড। মানে অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন মসজিদে দায়িত্ব পালন করা।
কোন স্থায়ী ইমাম ছুটিতে অনুপস্থিত থাকলে তাঁর জায়গায় বাদীল (প্রতিনিধি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন শেষে মসজিদ পরিচালনা বোর্ড কাউকে কাউকে স্থায়ীভাবে চাকরিতে নিয়োগ দেন।
যারা স্থায়ীভাবে অনুমোদন পেয়ে যান, তাঁদের জন্য রয়েছে মসজিদ সংলগ্ন পারিবারিক বাসস্থানের সুবিধা। যদিও এ প্রক্রিয়াটি (ফ্যামিলি বাসা) কিছুটা সময়সাপেক্ষ; তবে চাকরিতে অন্তর্ভুক্তির আগে লিখিত চুক্তিপত্রে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বসবাসের জায়গা, চিকিৎসা সেবা এবং তাঁদের সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষায় সহায়তা দানের বিষয়গুলো স্পষ্ট লিপিবদ্ধ থাকে। যাতায়াতের খরচও সে চুক্তির আওতাধীন রয়েছে। ফলে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিজ আবাসে অবস্থানের অধিকার থেকে কারোরই বঞ্চিত হতে হয়না।
দীর্ঘদিন ধরে যারা কাতারে ধর্মীয় পেশায় জড়িত আছেন, তাঁদের সন্তানেরা এখানকার ভাষা-সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতিগুলো খুব সহজেই রপ্ত করে নেয়। শিক্ষা-দীক্ষায় স্থানীয়দের মত তাঁরা সমান সুযোগ পায়। ফলে বসবাসরত ভিনদেশী ইমাম-মুয়াজ্জিনদের এখানে নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন হতে হয় না।
গত বিশ বছর ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশি আলেম-হাফেজগণ কাতারে ইমাম-মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মুখরিত এ দেশের ইবাদাতকেন্দ্রগুলোতে তাই নির্বিঘ্নে চোখে বাংলাদেশিদের সাফল্যগাঁথা।
তিলে তিলে নিজেদের অবস্থানকে আরো সুসংহত করে তুলছেন এ প্রতিভাবান মানুষগুলো। আখেরাতের সফলতা অর্জনের পাশাপাশি দুনিয়ার সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে তাঁদের পাঠানো রেমিটেন্সের মাধ্যমে। যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতি ও সমাজ বিনির্মাণে এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে চলেছে।
ইমরান আনোয়ার: শিক্ষার্থী, কাতার বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইমাম, মসজিদে শাইখ হামাদ বিন খলীফা আল থানি, উম্মে কুরাইবাহ, যুবারা, কাতার।