মনযূরুল হক : কবি আল মাহমুদ তখন একটু অসুস্থ। তাই তার বাসায় যাবো যাবো করেও ইতস্তত করছিলাম। তারপর একদিন কবি মহিম মাহফুজ-এর সাথে তার বাসার পথে রওনা হলাম, দেখি কী হয়। তখন বাংলা বৈশাখ মাস পেরিয়ে গেছে বোধ করি। ইংরেজি জুন মাস। ২০১৪। প্রচণ্ড গরম। ভর দুপুরে গিয়ে হাজির হলাম কবির মগবাজারের বাসায়। বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কবি। কেউ তার সাক্ষাতে এসেছেন শুনে বিশ্রাম ছাড়তে আপত্তি করলেন না। আমরা ঘরে ঢুকলাম। বেশ বড়-সড় একটা ফ্ল্যাট বাসা। সামনের ড্রয়িং রুমে আমাদের অপেক্ষা করতে বলা হলো। কবি ততক্ষণে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন। মিনিট দশেকের মধ্যে ডাক পড়লো ভেতরে যাবার। আমি যখন তার সামনে দাঁড়ালাম, নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এই কি সেই সোনালী কাবিনের কবি? হতে পারে? শীর্ণকায় দুর্বল একটা মানুষ বসে আছে এলোমেলো অগোছালো বিশাল বিছানার এক পাশে। কবি। কিন্তু আমাদের হতভম্ব হয়ে থাকার সুযোগ দিলেন না। হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন। যত্ন করে বসতে বললেন। আমরা দুজনে দুটি ছোট্ট টুলের উপর বসে পড়লাম কিবর বিছানার পাশ ঘেঁষে। খানিকটা ইতস্তত, কিংবা জড়তা। কবি চোখ তুলে চাইলেন। সে-দৃষ্টির ভাষা আমাদের পড়তে কষ্ট হলো না। অর্থাৎ, কথা শুরু করো, সময় বেশি নেই। আমরা শুরু করলাম।
.
—আজকাল কী নিয়ে আছেন?
—কবিতা। কবিতা নিয়েই তো থাকি। মাঝেমধ্যে বাইরেও যাই কোথাও। আজও আসবে একদল। তাদের একটা অনুষ্ঠান। আমারও যেতে খারাপ লাগে না। আমাকে ভালোবেসে ডাকলে না করতে পারি না।
.
—আজ কোথায় যাবেন?
—আমি তো জানি না। আমাকে যেখানে যে যেতে বলে, সেখানেই যাই।
.
—সম্প্রতি আপনার একটা গল্প ‘টান’ অবলম্বনে কোলকাতায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে তারা ডেকেছিলো?
—ডেকেছিলো। আমার তখন শরীর ভালো ছিলো না। যেতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু যেতে পরি নি। তারা আমাকে খুব সম্মান দেখিয়েছে। আমার জন্যে অর্থ পাঠিয়ে দিয়েছে।
.
—কবি, আপনাকে যখন পেয়েছি, একটা কথা আলোচনা করেই নিই। রাজু আলাউদ্দিনের এক সাক্ষাৎকারে আপনি ইসলাম-মুসলমান নিয়ে অনেক কথা বলেছেন।.. সেই সাক্ষাৎকার নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে।...
— কোন সাক্ষাৎকার সেটা?
.
— তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হুমায়ুন আজাদ তার সাথে এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, “আমার মুসলমান পরিচিতির কোনো দরকার নেই।” আপনি বলেছেন, “আমার মনে হয় যে আমার সেই পরিচিতির দরকার আছে।...
—হ্যাঁ, আছেই তো। অবশ্যই আছে। যে বলে নেই, সে মুসলমান নয়। কারণ ইসলামে স্বীকার করা একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। স্বীকার না করলে তুমি মুসলিম হতে পারবে না। আমি মুসলিম। আমি কথায়, কবিতায়, সংসারে, রাজনীতিতে সব সময়ই আমি মুসলিম।
.
—আপনি কি রাজনীতি করেন?
—আমি তো কবিতা লিখি। কবিতা রাজনীতির থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী। কবিতাই আমার রাজনীতির মঞ্চ।
.
—আপনি কি কখনো সরকারের রোষানলে পড়েছেন? আপনাকে আপস করতে হয়েছে?
—হয়েছে। আমাকে বঙ্গবন্ধু জেলে ভরলো। এক বছর ছিলাম। তারপর বললো, তুই তো কবি, যা তুই শিল্পকলায় যা। আমাকে শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক বানানো হলো।
.
—এখানে কোথায় আপস হলো?
—হলো না? যে আমাকে জেলে ভরলো, তার কথামতো আমি কাজ করলাম। এটাই তো আপস।
.
—আপনাকে একটু বিব্রত করি। আপনি নারীর মধ্যে এমন কী পেয়েছেন, কবিতায় নারীকে এত বেশি আনছেন? অবশ্যই সবাই আনে। কিন্তু আপনি কেনো?
—নারী হলো সুন্দরের প্রতীক। কোরানে আল্লাহ মানুষকে সবচে’ সুন্দর সৃষ্টি বলেছেন। মানুষের মধ্যে সুন্দর নারী। কবি তো সুন্দরের চর্চা করে। সুন্দরের কথা বলে। তাই নারী আসে। নারীর কাম-ক্রোধ, নারীর প্রেম-ছলনা, নারীর রূপ-মোহ সবটাই সুন্দর।
.
—সবটাই সুন্দর কী করে বলেন?
—তুমি দেখবে নারীকে নিয়ে যত মন্দ কথা বলা হয়, তা তার সৌন্দর্যের কারণেই। নারীকে নিয়ে হানাহানি, যুদ্ধ, তা-ও সুন্দরকে কেন্দ্র করে। নারী মা হলেও সুন্দর, ভগ্নি হলেও সুন্দর, প্রেয়সী হলেও সুন্দর। পৃথিবীর সবচে’ সুন্দর সৃষ্টি নারী। আমরা ভাবি, প্রাচীনকালে নারী নিপীড়িত ছিলো। না, আদিম যুগে নারী পূজনীয় ছিলো। এখন নেই।
.
—আপনি কি নারীকে ভালোবাসেন?
—হ্যাঁ, বাসবো না কেনো?
.
—একজন মানুষ কতজন নারীকে ভালোবাসতে পারে?
—প্রশ্নটা সেখানে নয়, প্রশ্ন হলো তুমি নারীকে কিভাবে ভালোবাসো। নারীকে ভালোবাসতে পারাও একটা বিরাট নান্দনিক বিষয়। তুমি যদি সুন্দরকে ভালোবাসো, তাহলে নারীকে তুমি ভালোবাসবে। নারীর সব তোমার ভালো লাগবে।
.
—নারীর কথা বলতে বলতে আপনার কোনো প্রিয়তমার কথা মনে পড়ছে?
—আমার প্রেমিকা আমার স্ত্রী। তার কথা আমি ভুলি না। মনে থাকে সব সময়।
.
—আপনি তাহলে যৌবনে প্রেমে পড়েন নি? প্রেমে না পড়েই কবিতা লেখা শুরু করেছেন?
—প্রেম হয়েছিলো, বা বলো হতে চলেছিলো; কিন্তু ঘনিয়ে ওঠে নি কারও সাথে। তাই আজও কবিতা লিখতে পারছি। নির্দিষ্ট একজনের প্রেমে পড়লে তো তুমি বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলবে। শুধু তাকে নিয়ে ভাববে। হা হা।
.
—আপনি যখন লেখা শুরু করেন, তখন কী কী বই পড়তেন? প্রশ্নটা করছি, বই পড়ার ব্যাপারে আপনার কোনো পরামর্শ পেতে। সব বই তো পরা সম্ভব নয়..
—তোমরা মার্কেজ পড়ো। পড়ো নি:সঙ্গতার একশ’ বছর। দেখো, একশ’ বছর ধরে একটা দেশ কিভাবে ঘুমিয়ে ছিলো। তারপর তারা জেগে উঠেছে। এখন এই কিছুদিন আগে নোবেল পেলো না, ওরহান পামুক, তাকে পড়ো। বিশ্বসাহিত্য আমাদের চষে ফেলা উচিত।
.
—এই সময়টায় এসে কি আমাদের লেখার বিষয়বস্তু ঠিক করা উচিত? কে কী লিখবে, কী লিখবে না?
—না। লেখার বিষয় ঠিক করবে লেখক। তার যা ইচ্ছা হয় লিখবে। তুমি আমি ঠিক করে দেবার কে? লেখককে যদি স্বাধীনভাবে লিখতে না দাও, তাহলে তার বিকাশ ঘটবে না। সৎ-সাহিত্য বেরিয়ে আসবে না।
.
—মন্দকিছুও তো আসতে পারে?
—যদি তা তার মধ্যে থাকে, তবে সেটাই আসবে। সে-জন্যে তো তাকে বিষয় নির্ধারণ করে দিয়ে কোনো লাভ হবে না, যেমনটা অনেক সমাজতান্ত্রিক দেশে আছে।
.
—আপনিও আগে সমাজতন্ত্রী ছিলেন।
—আমি মার্কসিস্ট ছিলাম।
.
—তারপর বদলে গেলেন কী করে?
—বদলে যাই নি, বলতে পারো আমি মূলের দিকে ফিরে এসেছি। মার্ক্স আমার ভালো লাগে। তবে আমি কোরান পড়ি। ধর্মচর্চা করি। সেটাকেই আমি মূল মনে করি।
.
—এটা কি রাজনৈতিক কারণে হয়েছে?
—তা খানিকটা হয়েছে। আমার নিজস্বতা বলে একটা কিছু তো আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে আমি কবি। রাজনীতিতে জড়িয়ে আমাকে কোনো গণ্ডিতে আটকানো যাবে না।
.
—সেটা হয়তো আপনার শক্তিমত্তার কারণে। আপনার লেখা প্রথম আলোতে ছাপা হয়, নয়াদিগন্তেও হয়।
—হ্যাঁ, কবিকে শক্তিশালী হতে হয়। কবিতাই তার শক্তি। আমি সব কথা কবিতা দিয়ে বলতে চাই, রাজনীতি দিয়ে নয়।
.
—সবার দ্বারা সেটা সম্ভব না-ও হতে পারে?
—কিন্তু ওই যে বলেছি, মূলের কাছে ফিরে যাওয়া। মানুষকে অবশ্যই মূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
.
—এই মূল মানে কি ধর্ম?
—না। ঠিক আমি ধর্ম বোঝাতে চাই নি। তবে আমি ঈশ্বরের নির্দেশ বোঝাতে চাচ্ছি। তোমরা বলো, ফিতরাত। এটা আমি বুঝি। আমি সেই ফিতরাতকেই মূল বলি। ধর্মের কথা তো সবই এক। বিভ্রান্তি এসে সেগুলোকে আলাদা করে। নইলে এর সূত্র একটাই। আমি মুসলিম, এর মানে আমি বাইবেল, তালমুদকে অস্বীকার করি না। পৃথিবীর বহু দেশের মানুষের সঙ্গে আমি মিশেছি। অনেক ধর্মের মানুষ দেখেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, কোথাও তাদের একটা ঐক্য আছে।
.
—আপনার কাছে পৃথিবীর সবচে’ সুন্দর মনে হয়েছে কোন দেশ?
—প্যারিস। প্যারিসের চেয়ে সুন্দর নগরি আমি আর দেখি নি। সেখানে নারীরা সুন্দর। শিল্পীরা সুন্দরের চর্চা করে। আমি আইফেল টাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়েছি। উপরে উঠি নি। আমার ইচ্ছা করে নি।
.
—এখন সুযোগ হলে আপনি কোন দেশে যেতে চাইবেন?
—আমার মক্কা যেতে ইচ্ছে করছে।
.
কবির সাথে আর কথা বলার সুযোগ ছিলো না। একটা বাচ্চা মেয়ে এসে বললো, বাইরে লোকজন এসেছে। আমাদের বুঝতে দেরি হলো না। তবে কবি আমাদের নামগুলো আবার জিজ্ঞেস করলেন। বললেন, মনে থাকবে। তোমাদের সাথে আবার কথা বলবো। এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা কেটে আমরা বেরিয়ে এলাম।
.
[কবি পরিচিতি : আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। তিনি একধারে একজন কবি, ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্প লেখক। সংবাদপত্রে লেখালেখির সূত্র ধরে কবি ঢাকা আসেন ১৯৫৪ সালে। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলায় লেখালেখি শুরু করেন। তিনি পাশাপাশি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। এক বছরের মধ্যে তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পান। কাব্যগ্রন্থ লোক লোকান্তর (১৯৬৩) সর্বপ্রথম তাকে স্বনামধন্য কবিদের সারিতে জায়গা করে দেয়। এরপর কালের কলস(১৯৬৬), সোনালি কাবিন (১৯৬৬), মায়াবী পর্দা দুলে উঠো (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থ গুলো তাকে প্রথম সারির কবি হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। পরে তিনি দৈনিক গণকন্ঠ পত্রিকাত সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় একবার জেল খাটেন । পরে তিনি শিল্পকলা একাডেমীতে যোগদান করেন এবং পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোট গল্পগ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত প্রকাশিত হয়। ১৯৯৩ সালে বের হয় তার প্রথম উপন্যাস কবি ও কোলাহল। আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পুরো নাম মীর আব্দুস শুকুর আল মাহমুদ।]
.
সাক্ষাৎকারটি কবি মহিউদ্দীন মাসুম সম্পাদিত ‘তরনী’ পত্রিকার জুন-আগস্ট ২০১৬ সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছে ।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আরআর