আবুল ফাতাহ : স্বনামধন্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সাইদুর রহমান আজ বেশ আগেভাগেই চেম্বার ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আজ তাঁর বিবাহ বার্ষিকী।
দেশের খ্যাতনামা ডাক্তারদের মধ্যে ড. সাইদুর রহমান একজন। সে হিসেবে তাঁর প্রচন্ড ব্যস্ততা থাকার কথা, এবং প্রচুর পরিমাণে সেটা তাঁর আছেও। তবে পরিবারকে সময় দেবার ক্ষেত্রে তিনি কখোনোই কৃপণ নন। পারিবারিক যেকোনো অনুষ্ঠানে তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব নিয়ে উপস্থিত থাকেন। নিয়ম করে মাসে একবার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দূরে কোথাও চলে যান। সময় এবং সুযোগের সংমিশ্রণ ঘটাতে পারলে দেশের বাইরেও যান। এর ধারাবাহিকতায় আজ অনেকটাই কম তার অ্যাপয়েন্টমেন্টের সংখ্যা। অন্যান্য দিন বাসায় ফিরতে রাত হলেও আজ সন্ধ্যা মিলাবার বেশ আগেই সবকিছু গুছিয়ে চেম্বার ছাড়ার প্রস্তুতি নিলেন।
চেয়ার থেকে উঠবেন, ঠিক তখনই দরজায় কম্পাউন্ডার আনিসের মুখ দেখা গেল।
স্যার, এক ভদ্রলোক আপনার সাথে দেখা করতে চান।
বলে দাও, আজ হবে না। অন্য একদিন যেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসেন।
স্যার, বলেছি, কিন্তু... একী! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? অপরিচিত এক লোক আনিসকে একরকম ধাক্কা দিয়ে সাইদুর রহমানের রুমে ঢুকে পড়লেন।
আনিস উত্তেজিত হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সাইদুর রহমান বাঁধা দিলেন।
সাইকিয়াট্রিস্ট হওয়ায় এ ধরনের সমস্যা তাঁর কাছে নতুন না, তবে তিনি তাঁর রোগীদের প্রতি সবসময়ই সহানুভূতিশীল। মানসিক রোগীকে তিনি একজন রোগী হিসেবেই দেখেন, পাগল হিসেবে নয়।
কোনো মানুষের কিছু মানসিক সমস্যা দেখা দিলেই সবাই মিলে তাকে মানুষের কাতার থেকে বের করে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। একজন অন্ধকে সবাই অন্ধমানুষ বললেও একজন মানসিক রোগীকে কেউ পাগল মানুষ বলে না, স্রেফ পাগল!
আনিসকে লক্ষ্য করে ড. সাইদুর রহমান বললেন, তুমি যাও, আমি দেখছি।
আনিস দরজা থেকে অদৃশ্য হতে ড. সাইদুর রহমান এবার আগন্তুক ভদ্রলোকের দিকে মনোযোগ দিলেন।
মাঝবয়সী একজন মানুষ। দুটো কারণে একজন অপরিচিত মানুষের চেহারা মনে থাকে। অধিক কুৎসিত অথবা অধিক সৌন্দর্যের অধিকারী হলে। এর মাঝামাঝি চেহারা মনে থাকার তেমন কোনো কারণ নেই। তবে সামনে দাঁড়ানো বিশেষত্বহীন চেহারার লোকটাকে কেন যেন পরিচিত মনে হচ্ছে ড. সাইদুর রহমানের কাছে।
বসুন আপনি, লোকটার উদ্দেশে সামনে রাখা চেয়ার ইঙ্গিত করলেন তিনি।
ভদ্রলোক বসতে বসতে বললেন, এভাবে ঢুকে পড়ায় আমি সত্যিই দুঃখিত। আসলে আপনার সাথে দেখা করাটা আমার জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল।
দুঃখ প্রকাশের সময় বেশিরভাগ মানুষের চোখদুটো থাকে আবেগবর্জিত। কিন্তু আগন্তুকের চোখদুটোও যেন একই সঙ্গে সাইদুর রহমানের কাছে ক্ষমা চাইল।
ইটস ওকে, তবে আমি যে আজ আপনাকে সময় দিতে পারব না। আজ আমার অ্যানিভার্সারী। আপনি বরং কাল আসুন।
কথাটা শুনেই আগন্তুক ভদ্রলোক হেসে ফেললেন।
সাইদুর রহমান অবাক হয়ে গেলেন লোকটার হাসিতে। তিনি তো হাসির কিছু বলেননি। '
এনিথিং রং? প্রশ্ন করলেন।
আগন্তুক মুখে উজ্জ্বল হাসি নিয়ে বললেন, না, আপনার মুখে অ্যানিভার্সারী শব্দটা শুনে মজা লাগল। কিছু মনে করবেন না। এই তো মাত্র কয়েকটা দিন আগেও লোকে বিবাহ বার্ষিকীকে ম্যারেজ ডে-ই বলত। কী করে সেটা যেন অ্যানিভার্সারী হয়ে গেল। দুনিয়া খুব দ্রুত বদলায়, তাই না? একটু বিরতি দিয়ে বললেন, আচ্ছা, আমি তাহলে আজ উঠি। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারী।
সাইদুর রহমান খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন। এই লোকের কাছ থেকে এত সহজে উদ্ধার পাবেন তিনি ধারণাও করেননি। সবচেয়ে বড় কথা লোকটাকে তাঁর মানসিক রোগী বলে মনে হচ্ছে না। সাইদুর রহমান তাঁর পেশায় যথেষ্টই অভিজ্ঞ এবং দক্ষ। অন্তত মানসিক রোগী চেনার মত তো বটেই।
এই লোক যদি মানসিক রোগীই না হবে তাহলে কেন এসেছিল তাঁর কাছে? অবশ্য রোগী না হলে তাঁর কাছে আসা যাবে না এমন কোনো কথাও নেই।
দরজায় পৌঁছে যাওয়া আগন্তুককে ডাক দিলেন তিনি, এই যে, শুনুন।
লোকটা ফিরে তাকাতে বললেন, আপনাকে আমি কিছুটা সময় দিচ্ছি, বসুন।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, বসতে বসতে বললেন আগন্তুক।
আপনি আপনার সমস্যাটা বলতে পারেন, ড. সাইদুর রহমান বললেন।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলেন, আমার সমস্যাটা বলতে হলে আমার জীবন বৃত্তান্তও বলতে হয়। আপনি কি ধৈর্য ধরতে পারবেন?
সাইদুর রহমান প্রশ্নটা শুনে রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকালেন একপলক। এখনো সন্ধ্যা মিলায়নি। লোকটাকে ঘন্টাখানেক সময় দেবার পরও জ্যাম ঠেঙিয়ে পারিবারিক অনুষ্ঠানটার বেশ আগেই পৌঁছবার মত সময় তার হাতে থাকবে। বললেন, অবশ্যই, ওটাই তো আমার কাজ।
একজন সাইকিয়াট্রিস্টের প্রধান কাজ তার রোগীর কথা মন দিয়ে শোনা, অন্তত শোনার ভান করা। যেটা সাইদুর রহমান অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে করে থাকেন। ভণিতা নয়, সত্যিকারের একজন শ্রোতা বনে যান তিনি রোগীর সামনে।
যথাসম্ভব সংক্ষেপে বলছি, ভদ্রলোক শুরু করলেন, আমার নাম মনসুর আহমেদ। ছোট বেলাতেই মা-বাবাকে একসঙ্গে হারাই। যথারীতি অভিভাবকহীন বাচ্চাদের অনিবার্য ঠিকানা, এতিমখানায় ঠাঁই হল আমার।
অভিভাবক যে একেবারেই ছিল না তা কিন্তু না। একটা মামা ছিল। মামাটা ছিল পাগলাটে, ভবঘুরে টাইপ। বছরে এক আধবার এতিমখানায় আমাকে দেখতে আসত। তাঁর আত্মাটা ছিল বিশাল। সত্যি বলতে, আমি আমার এই জীবনে তাঁর মত বড় মনের মানুষ দেখিনি। তাঁর সাথে থাকলে আমিও তাঁর মত উড়নচন্ডী হব ভেবেই আমাকে এতিমখানায় পাঠান মামা। প্রতিমাসেই কীভাবে যেন এতিমখানার সুপারের কাছে আমার হাত খরচের জন্য কিছু কিছু টাকা পাঠাতেন।
পড়াশোনায় আমি বরাবরই ভাল ছিলাম। সন্তোষজনক ফলাফলের মাধ্যমে লেখাপড়ার পাট চুকালাম।
তখন চাকরির বাজার ছিল বেশ ভাল। মামা - খালুর জোর ছাড়াই নিজের যোগ্যতায় একটা ভাল চাকরি পেয়ে গেলাম। বেতনও খারাপ না।
চাকরিতে জয়েন করার কয়েকদিন পরই মামা এসে হাজির হলে বুঝলাম, মামা দুর থেকে আমার সব খবরই রাখতেন।
মামা এসেই আমার বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। যদিও নিজে বিয়ে - শাদীর ধারে কাছেও কোনোদিন ভেড়েননি।
শুরু হল মেয়ে দেখা। বেশি খোঁজাখুঁজি করতে হল না, একটা মেয়েকে পছন্দ হয়ে গেল। মেয়েটা গরীব হলেও রুপবতী ছিল।
আমি বোধহয় ঠিকমত বোঝাতে পারিনি। মেয়েটা শুধু রুপবতী না, অসাধারণ রুপবতী ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, গুণবতী ছিল রেবা। একজন পুরুষ তার স্ত্রীর মধ্যে যে গুণগুলোর প্রতিফলন দেখতে চায় তার সবগুলো গুণই পরিমিত পর্যায়ে ছিল রেবার মধ্যে।
আপনি কি খেয়াল করেছেন, আমি পরিমিত শব্দটা ব্যবহার করেছি? কেন করলাম?
কখনো কখনো পরিস্থিতি মানুষের গুণগুলোকেও দোষের পর্যায়ে নিয়ে যায়। উদাহরণ দেই। মানুষ জীবনের কিছু মূহূর্ত একা কাটাতে চায়, নির্জনতা খোঁজে। ওই মূহূর্তগুলোতে একান্ত প্রিয়জনের উপস্থিতিও অসহ্য লাগে। তার ভালবাসা পরিণত হয় অত্যাচারে।
এই বিষয়গুলো খুব ভাল বুঝত রেবা। আদিখ্যেতা কিংবা ভান ছিল না ওর মধ্যে। আমার পছন্দ-অপছন্দ কিংবা চাহিদাগুলো যেন টেলিপ্যাথির মাধ্যমে জেনে যেত সে।
যাইহোক, আমি তখন মাত্র চাকরিতে জয়েন করেছি। কিছুই সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। বিয়ের পর বউকে কী খাওয়াব সে চিন্তার আগে বিয়েটা কীভাবে করব সে চিন্তা পেয়ে বসল আমাকে। নতুন বউকে নিদেনপক্ষে কিছু গহনা তো দিতে হবে।
এই অবস্থায় মামা আমার হাতে বেশ কিছু গহনা তুলে দিয়ে বললেন, নে, এগুলো তোর বউকে দিবি।
এরপর আমার ইতস্ততভাব দেখে বললেন, এগুলো তো তোরই। তোর মা মারা যাবার আগে আমার কাছে রেখে গিয়েছিল।
মামার কথায় এতটুকু অবাক হইনি। আমি তো জানি আমার এই পাগলা মামা কতটা সৎ।
দেরি করলাম না। অফিস থেকে কিছু লোন নিয়ে যথাসম্ভব আয়োজন করেই বিয়েটা করে ফেললাম।
বিয়ের আগে একটা মেসে থাকতাম। ওখানে তো আর বউকে তোলা যাবে না। মামাই খোঁজাখুঁজি করে পিচ্চি একটা বাসা যোগার করে দিল।
আসবাব বলতে কিছুই নেই। তবুও এই জৌলুসহীন রাজ্যে নিয়ে এলাম আমার রাজকন্যাকে।
মামা যেমন হুট করে এসেছিলেন, আমার একটা গতি করে তেমনি ধুমকেতুর মত কোথায় যেন আবার নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন।
চাকরি, বিয়ে, নতুন বাসা, পুরো ব্যাপারটা মাত্র দুসপ্তাহের মধ্যে ঘটে গেল। কেমন যেন স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হত। জীবনের একুশটা বসন্ত পার হবার পর রেবার কারণে সুখকে চিনতে পারলাম। এতিমখানায় মানুষ হওয়া ছেলেটা ভালবাসার কতটা কাঙাল ছিল সেটা রেবাও প্রতিদিন একটু একটু করে উপলব্ধি করতে পারল।
ধীরে ধীরে আমার এলোমেলো সংসারটাকে গুছিয়ে নিতে লাগলাম। একবছরের মাথায় আমাদের সুখকে বাড়িয়ে দিয়ে আমাদের প্রথম সন্তান রাহাতের আগমন ঘটল পৃথিবীতে।
রাহাতের জন্মের পরই আমার মনে হতে লাগল, নটা পাঁচটা অফিস আমার পোষাবে না। ঠিক করলাম, ব্যবসা করব। বিষয়টা রেবাকে জানাতে যথেষ্ট উৎসাহ পেলাম। তবে উৎসাহ দিয়েই তো আর ব্যবসা শুরু করা যাবে না, পুঁজি দরকার। এই ব্যবস্থাটাও রেবার মাধ্যমে হয়ে গেল। মার সমস্ত গহনা আমার হাতে তুলে দিয়ে ওগুলো দিয়ে ব্যবসাটা দাঁড় করাতে বলল। আত্মবিশ্বাস ছিল আমার। গহনাগুলো ব্যাংকে মর্টগেজ রেখে লোন নিলাম। শুরু করে দিলাম আমার নিজস্ব ব্যবসা।
সৎ থাকলে অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য পাওয়া যায়। আমি সৎ ছিলাম তাই আমার ব্যবসাও ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল আস্তে আস্তে। আমার উন্নতির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আপনার বিরক্তি উৎপাদন করব না। সেটা ইতোমধ্যেই যথেষ্ট করা হয়েছে, একটানা কথা বলে এ পর্যায়ে এসে থামলেন মনসুর আহমেদ।
এতক্ষণ ড. সাইদুর রহমান মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিলেন। এমন নয় যে, মনসুর আহমেদের গল্পটা আহামরি কিছু। কিন্তু লোকটার বাচনভঙ্গি অপুর্ব! যেন কবিতা আবৃত্তি করছেন।
সুখ দুঃখকে সঙ্গী করে একসময় আমাদের দাম্পত্য জীবনের বাইশটা বছর কেটে গেল। এর মধ্যে আমাদের আরো একটা ছেলে এবং একটা মেয়ের জন্ম হয়।
অর্থ বিত্ত নাকি ভালবাসা-সুখ জাতীয় বস্তুগুলোকে কেড়ে নেয়। অন্যদের কথা জানি না, কিন্তু কথাটা আমাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় মোটেও। বাইশ বছর আগে যেভাবে রেবা আর আমি পরস্পরকে ভালবাসতাম, বাইশ বছর পরও সে ভালবাসায় ফাঁটল ধরেনি এতটুকুও। ভালই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো।
এমন সময় আমার ক্যান্সার ধরা পড়ল।
নাটকীয়তা আনার জন্যই বোধহয় একটু বিরতি নিলেন মনসুর আহমেদ।
শুরু হল ক্যান্সারের বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ। রোগটা ধরা পড়েছিল একেবারে লাস্ট স্টেজে। ডাক্তাররা কোনো ভরসার কথা শোনাতে পারলেন না। আমার বিপুল সম্পদের সদ্ব্যবহারের জন্য বিদেশেও নেয়া হল আমাকে।
লাভ হলো না। ওখানকার ডাক্তারদের মুখও কালো করে চার মাসের জীবন হাতে নিয়ে ফিরে এলাম।
জীবনের শেষ চারমাস বাড়ির ভেতরেই নিজেকে বন্দী করে রাখলাম। অনেকেই দেখা করতে আসত। কারো সাথেই দেখা করতাম না। রেবা ছাড়া কারো উপস্থিতি সহ্য হত না।
এক এক করে চারমাস অতিবাহিত হয়ে যাবার পরও যখন বেঁচে রইলাম, মনে হল, বেঁচেই বুঝি গেলাম এ যাত্রায়।
নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। বেঁচে থাকার আনন্দে আমি তখন বিভোর।
কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে চারমাস বার দিনের মাথায় সব শেষ!
সব শেষ মানে? প্রবল বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলেন ড. সাইদুর রহমান।
সবশেষ মানে আমি মারা গেলাম, অবলীলায় ভয়ংকর কথাটা বলে ফেললেন মনসুর আহমেদ।
ড. সাইদুর রহমান বুঝতে চাইলেন এটা কোনো রসিকতা কিনা। না, কোনো ধরনের রসিকতার ছাপ নেই মনসুর সাহেবের চেহারায়।
এবার ড. সাইদুর রহমান মনসুর রহমানের সমস্যাটা ধরতে পারলেন। ভদ্রলোক নিজেকে মৃত ভাবেন। এক ধরনের সিজোফ্রেনিয়া এটা।
মনসুর আহমেদ যেন ড. সাইদুর রহমানের মনের কথা পড়তে পেরেই করুণ একটু হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললেন, আপনি বোধহয় ভাবছেন, নিজেকে মৃত ভাবাটাই বোধহয় আমার রোগ, তাই না?
সাইদুর রহমান চুপ করে থাকলেন।
না, ডাক্তার সাহেব, আমি নিজেকে মৃত ভাবি না। আমার সমস্যা আরেকটু জটিল।
আমি খুব ভাল করেই জানি আমি বেঁচে আছি। আর এই বেঁচে থাকাটাই আমার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাখ্যা করি, আমি আপনাকে এতক্ষণ যা বললাম সেটা বাস্তব না, একটা মেগা সিরিয়ালের কাহিনী এটা। মনসুর আহমেদও আমার আসল নাম না। আমার নাম শরীফ মাহমুদ। আমি একজন অভিনেতা। মনসুর হল এ নাটকের প্রধান চরিত্র, যেটাতে আমি রুপদান করেছি।
মনসুর সাহেবের মুখে তাঁর মৃত্যুর কথা শুনে যতটা না অবাক হয়েছিলেন, তাঁর এইমাত্র বলা কথাগুলো তারচাইতে ঢের বেশি অবাক করল সাইদুর রহমানকে। তবে এতক্ষণে ভদ্রলোককে চেনা চেনা মনে হবার রহস্যটা পরিষ্কার হল। সাইদুর রহমান টিভি তেমন একটা দেখেন না, নয়ত ভদ্রলোককে আরো আগেই চিনে ফেলতেন।
ঠিক আছে বুঝলাম, আপনি এতক্ষণ একটা নাটকের কাহিনী বলছিলেন। কিন্তু এর সাথে আপনার সমস্যা কীভাবে জড়িত?
সাইদুর রহমান বুঝতে পারছেন না তাঁর বিরক্ত হওয়া উচিত কিনা। অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত কেস এর আগেও তাঁর কাছে এসেছে, কিন্তু এই কেসটা যেন কেমন। একেবারেই অন্যরকম।
সত্যি বলতে সাইদুর রহমান এখন খানিকটা আগ্রহই বোধ করছেন সামনে বসা লোকটার প্রতি।
বলছি, তার আগে একটু পানি খাওয়াতে পারবেন? অনুরোধ করলেন শরীফ মাহমুদ।
সাইদুর রহমান বেল টিপে আনিসকে ডেকে বললেন, একগ্লাস পানি দিয়ে তুমি বাসায় চলে যাও।
আনিস পানির গ্লাসটা সামনে রাখতে এক নিশ্বাসে পুরোটা শেষ করে ফেললেন শরীফ মাহমুদ, পরম তৃষ্ণার্ত একজন মানুষের মত।
এই প্রথম সাইদুর রহমান লোকটার অস্তিত্ব জুড়ে একধরনের তৃষ্ণা দেখতে পেলেন, যে তৃষ্ণাটা পানিতে মিটবার নয়।
আমি, অর্থাৎ মনসুর আহমেদ মারা যাবার পরও নাটকটা চলতে লাগল, গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলতে শুরু করলেন শরীফ মাহমুদ। মনসুর আহমেদের মৃত্যুর পরের পর্বগুলোতে দেখা যেতে লাগল তাঁর পরিবারের সম্পুর্ণ ভিন্ন এক রুপ।
ততদিনে মনসুর আহমেদের সন্তানেরা পরিণত বয়সে পৌঁছেছে। বাবার মৃত্যুর মাত্র একদিন পরই তাদের মাঝে নীরব স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল সম্পত্তি নিয়ে। একমাসের মধ্যেই সমস্ত সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা শেষ। এই একমাস তারা সবাই আমাকে, আইমিন, মনসুর আহমেদকে ভুলে থাকল।
চল্লিশ দিনের মাথায় কাঙালী ভোজ ধরনের একটা অনুষ্ঠান করে আমার প্রতি তাদের দায়িত্বের সীমা পার করে ফেলল।
এরপরই শুরু হল রেবার কাহিনী। রেবাকে যখন আমি বিয়ে করি তখন ওর বয়স ছিল মাত্র ষোল। আমার মৃত্যুর সময় সেটা আটত্রিশে গিয়ে পৌঁছে। আটত্রিশের রেবাকে আমার কাছে পচিঁশ বছরের তরুণীর মতই লাগত। হয়ত আমার বন্ধু ফারুকের
কাছেও লাগত। যে কারণে আমার এই বিপত্নীক বন্ধু রেবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসল। এবং আমার মৃত্যুর চারমাসের মাথায় তাদের বিয়ে হয়েও গেল।
ওদের বিয়ের মাধ্যমে সিরিয়ালটার সমাপ্তি ঘটলেও আমার সমস্যাও শুরু ওখান থেকেই। আবার থামলেন শরীফ সাহেব।
তারপর থেকে পরিবর্তন দেখা দিল আমার বাস্তব জীবনে। যে জীবনে আমি শরীফ মাহমুদ নামে একজন অভিনেতা। কিন্তু নিয়তির অদ্ভুত খেয়ালে শরীফ মাহমুদের জীবনটা একাকার হয়ে গেছে মনসুর আহমেদ নামে এক কাল্পনিক চরিত্রের সাথে।
ডক্টর, এ ঘটনার পর থেকে আমি আর আমার নিজের স্ত্রী-সন্তানদের আগের মত ভালবাসতে পারি না। আমার স্ত্রীর মাঝে রেবা আর ছেলে মেয়েদের মাঝে মনসুরের সন্তানদের ছায়া দেখতে পাই।
আজ আমি মারা গেলে তো মনসুর আর শরীফের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকবে না। আমার পরিবারও তো ভুলে যাবে আমাকে। এত ভালবাসা তাহলে কাদের দেব? শেষের দিকে এসে শরীফ সাহেবের গলা কেঁপে উঠল যেন।
এতক্ষণ সামনে ঝুঁকে শরীফ সাহেবের কথা শুনছিলেন ড. সাইদুর রহমান। কথা শেষ হতে রিভলবিং চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে বললেন, সামান্য একটা নাটক আপনার জীবনে এতটা প্রভাব ফেলল কেন? এমন ঘটনা তো নতুন কিছু নয়। আমাদের চারপাশে অহরহ ঘটছে। পরম ভালবাসার মানুষটিই মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই অপাংক্তেয় হয়ে পড়ে।
হুমম, সেটা আমিও স্বীকার করছি। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে এ ধরনের ঘটনাগুলো আমার মনে কখনই আঁচড় কাটতে পারেনি। কিন্তু এই ঘটনাটা আমাকে প্রচন্ড ধাক্কা দেয়। মনসুরের চরিত্রে রুপদান করাই হয়ত এর কারণ। নিজেকে অজান্তেই মনসুরের স্থানে বসিয়ে ফেলেছি। টিভির সামনে বসে যখন মনসুরকে তার পরিবারের ভুলে যাওয়া দেখতাম তখন মনে হত আমি যেন কবরে বসে আমার পরিবারের আমাকে ভুলে যাওয়া দেখছি।
আচ্ছা, নাটকটাতে কাজ করার আগে স্ক্রিপ্ট পড়ে নেননি? প্রশ্ন সাইদুর রহমানের।
হ্যাঁ, পড়েছিলাম তো।
গল্পটা তো আগে থেকেই জানতেন তাহলে, সেক্ষেত্রে এতটা শকড্ হবার মানে কী?
পুরোটা জানতাম না। মনসুরের মৃত্যুর মধ্য দিয়েই সিরিয়ালটা শেষ হবার কথা ছিল। পরবর্তীতে নাটকটার জনপ্রিয়তা দেখে কাহিনী লম্বা করা হয়।
কিছুক্ষণ নীরবতার পর ড. সাইদুর রহমান বললেন, দেখুন, আপনার সমস্যাটা একটা কমন সমস্যা। সাধারণত ধর্ম মানুষকে বৈরাগ্যের দিকে টেনে নিলেও অন্যান্য কারণেও জীবন বা সংসারের প্রতি বিরাগভাব আসতে পারে। তবে আমাদের ধর্ম কিন্তু বৈরাগ্যকে সমর্থন করে না। পরিবার পরিজনের অধিকারের ব্যাপারে আমাদের নবীর (সা.) বেশ কিছু চমৎকার হাদীস আছে।
একটা ব্যাপার তো জানেনই, সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের ভেতরই যেহেতু জীবনের অর্থ, সুতরাং জীবনটারও কারো জন্য থেমে থাকবার কথা নয়।
আপনি যদি সত্যিই আপনার পরিবারকে ভালবেসে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই চাইবেন না শুধুমাত্র আপনার স্মৃতি নিয়েই তারা জীবনটা পার করে দিক।
মনসুরের মৃত্যুর পর রেবা কী নিয়ে থাকত সারাটা জীবন? তারচাইতে বিয়ে করে সংসারী হওয়াটাই ভাল হলো না? ভালবাসার মানুষের সুখটাই তো সবার কাম্য। সেই সুখের সন্ধান একেকজন একেকভাবে পায়।
তাছাড়া আপনার পরিবার বেঁচে থাকতেই তাদের প্রতি আপনার ভালবাসায় টান পড়েছে। আপনার মৃত্যুর পর যদি তারা আপনার প্রতি ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ ঠিকমত ঘটাতে না পারে তবে তাদের অতটা দোষ দেয়া যায় না, কী বলেন?
আপনার চিকিৎসা আপনারই হাতে। পরিবারকে বেশি করে সময় দিন। দূর থেকে ঘুরে আসতে পারলে আরো ভাল হয়। আর প্রতিদিন কমপক্ষে একঘন্টা করে মেডিটেশন করবেন, এতে মানসিক অস্থিরতা দুর হবে।
আপাতত কোনো ওষুধ দিচ্ছি না। একসপ্তাহ পর আবার একবার আসবেন। তবে এবার অবশ্যই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে, শেষের কথাটা বলতে গিয়ে হেসে ফেললেন ড. সাইদুর রহমান।
শরীফ মাহমুদও পাল্টা হাসি দিয়ে বললেন, অবশ্যই, অন্তত চেষ্টা করব আরকি!
***
শরীফ মাহমুদ চলে যাবার পর কামরাটাতে নিস্তব্ধতা নেমে এল। স্তব্ধতাটা জমাট বাঁধতে পারত যদি দেয়াল ঘড়িটা একঘেয়ে স্বরে টিক-টক, টিক-টক করে না চলত।
ঘড়ির দিকে তাকালেন সাইদুর রহমান। ফ্যামিলি পার্টিটাতে অ্যাটেন্ড করতে চাইলে তাঁর এখনই রওনা দেয়া উচিৎ, তবে চেয়ার ছাড়ার তেমন কোনও লক্ষণ দেখা গেল না তাঁর মধ্যে।
সেলফোনটা সাইলেন্ট থাকায় টের না পেলেও তিনি জানেন, ডিসপ্লেতে ব্যার্থকলের লম্বা একটা তালিকা ভেসে রয়েছে। তিনি সেটাও দেখলেন না। রিভলবিং চেয়ারটাকে পরম আশ্রয় মনে হচ্ছে। অজানা এক জড়তা তাঁকে চেয়ারটার সঙ্গে চেপে ধরছে আরও বেশি করে। তিনি জানেন না, কেন তাঁর বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না।
তিনি আরো যেটা জানেন না সেটা হল, শরীফ সাহেবের মানসিক রোগটা তার মাঝে চলে এসেছে।
ঘড়িটা টিক -টক, টিক -টক করেই চলেছে।
টিক-টক...
টিক-টক...
টিক-টক...
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /এসএস