শায়খ আহমাদুল্লাহ : পবিত্র মাহে রমজানের অর্ধমাসেরও বেশি সময় অতিক্রম করেছে। চলছে বরকতের দশদিন। বিশেষ আমলের মাধ্যমে রমজানকে কবুল করে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে এখনো।নিম্নে মাহে রমজানকে স্বার্থক ও সফল করার কিছু বিশেষ পরামর্শ দেওয়া হলো,
০১. রমজানের প্রতিটি আমলের সময় সংশ্লিষ্ট আমলের কুরআন-সুন্নাহ বর্ণিত পুরস্কারের কথা স্মরণ করে তা প্রাপ্তির আকাঙ্খা লালন করা। এতে আমলটি পালন অত্যন্ত সহজ ও আনন্দময় হবে, তেমনি আপনি উপযুক্ত হবেন সংশ্লিষ্ট সওয়াব বা পুরস্কারের। কেননা, আমলের সওয়াব নির্ভর করে তার নিয়তের ওপর।
০২. সাহরী ও ইফতারে অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ থেকে বিরত থাকা। একটা কথা প্রচলিত আছে- রমজানের খাবারের কোন হিসাব হবে না। এই ভুল ধারণার কারণে অনেকেই এ মাসে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করে থাকেন। এটা ঠিক নয়। অতিরিক্ত খাদ্যায়োজন যেমন আপনার মহামূল্যবান সময় নষ্ট করবে তেমনি অতি ভোজনের ফলে আমল ও ইবাদতের উদ্যম কমে যাবে।
০৩. ইশার সালাতের পর দেরি না করে ঘুমোতে যাওয়া উচিত। আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা: বলেন- আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে ই’শার পর খোশগল্প-আড্ডার বিষয়ে কঠোরভাবে সাবধান করেছেন। (ইবনে মাজা) সাহরীর সময়টি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসময় আল্লাহ তা’আলা বান্দার দু’আ কবুল করেন। রাতে দেরিতে ঘুমানোর ফলে শেষ রাতে আর কোন নফল নামাজ কিংবা দুআর স্ফুর্ততা ও উদ্যম থাকে না। এমনকি ফজর পরবর্তী মুহুর্ত দু’আ ও যিকিরের সবচে আদর্শ সময়, রাতে দেরিতে শোয়ার কারণে ঘুমকাতর শরীরে আর সেটাও সম্ভব হয় না। এ সময়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নামাজের স্থানে বসেই বিভিন্ন দু’আয় মশগুল থাকতেন। কুরআনের একাধিক স্থানে এ সময়টিতে আল্লাহকে স্মরণের ব্যপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রমজানের মতো গুরুত্বপূর্ণ মাসে এর গুরুত্ব আরো বহুগুন বেড়ে যায়-তা বলাই বাহুল্য। অথচ বেশিরভাগ লোক এসময় ঘুমে লুটিয়ে পড়েন। এ দুরাবস্থা থেকে রক্ষার উপায় হলো রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া।
০৪. এই ফজীলতের মাসে টেলিভিশন, নিউজ পেপার, সামাজিক যোগাযোগের পেজসমূহ ইত্যাদিতে যথাসম্ভব কম সময় ব্যয় করা চাই। পূর্বসূরী মনীষীগণ এ মাসে দ্বীনি ইলম ও হাদীসের দারসও বন্ধ করে দিতেন ব্যক্তিগত ইবাদতের জন্য। আথচ আমাদের উল্লেখযোগ্য অংশ কেটে যায় উপরিউক্ত আনর্থক বা রমজানের ইবাদতে বিঘ্নতা ঘটে এমন সব কাজে।
০৫. রমজান হলো ইবাদতের মাস। এ মাসে যথাসম্ভব নির্জনভাবে ইবাদতে কাটানো উচিত। অথচ আমরা রমজান মাসে যে পরিমাণ সময় মার্কেটিং ও কেনাকাটায় ব্যয় করি, অন্য কোন মাসে এতোটা করা হয় না। রমজানের আহবান যদি কেউ উপলব্ধি করে থাকে, তবে মার্কেটিং ও কেনাকাটায় যথা সম্ভব কম সময় ব্যয় করা উচিত। কারণ, শপিংয়ে বেশি সময় ব্যয় করার ফলে একদিকে আপনার মনে ইবাদতের প্রতি মনোযোগ নষ্ট হবে, অপর দিকে ক্লান্ত শরীর ইবাদতের উপযুক্ত থাকবে না।
০৬. এমনিতে আমরা সারা বছর নানা কারণে শিশুদের নৈতিক ও দীনি শিক্ষা দানের বিষয়ে খুব বেশি সময় দিতে পারি না। রমজানে তাদেরকে দীনি শিক্ষা ও পরিচর্যা করার ব্যপারে যত্নশীল হওয়া উচিত। কারণ বেশিরভাগ শিশুদের এ মাসে পড়াশুনার চাপ কম থাকে।
০৭. রোযা কেবল উপবাস থাকার নাম নয়। বরং একজন ঈমানদার তার গোটা শরীরের রোযা রাখবে। অনেকেই রোযা রেখে হাতে হারাম উপার্জন, মুখে মিথ্যা, অনর্থকতা ও পরচর্চা, গানবাজনা শ্রবণ এবং নিষিদ্ধ ক্ষেত্রে চোখের ব্যবহার বন্ধ রাখেন না। তাদের রোযা কেবলই উপবাস থাকা ছাড়া আর কিছু নয়। সিয়াম সাধনা সার্থক করার অন্যতম পূর্বশর্ত হলো এ বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা।
০৮. হাদীসে বর্ণিহ হয়েছে, ৩ব্যক্তির প্রার্থনা ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। তাদের মধ্যে একজন হলেন রোযাদার ব্যক্তি। ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত রোযাদারের দু’আ কবুল হয়। দিনভর নানা ব্যস্ততায় আমরা দু’আয় নিমগ্ন হতে পারি না, এটাই অপ্রিয় বাস্তবতা। তাই অন্তত: ইফতারপূর্ব মুহুর্তে দু’আয় মগ্ন থাকা উচিত। কারণ, এটি নানা কারণে দু’আর জন্য আদর্শ সময়। সন্ধার সময় দু’আ কবুল হয়, ইফতারপূর্ মুহুর্তে দু’আর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিদিন এই সময় জাহান্নাম থেকে বহু লোককে মুক্তির পরোয়ানা ঘোষণা করা হয়। অথচ তখন ইফতারের আয়োজনে আমরা এতোটাই ব্যতিব্যস্ত থাকি, আযান পর্যন্ত আর নিরবে কিছু সময় আল্লাহর নিকট দু’আ ও আযকারে মাশগুল থাকার ফুরসৎ হয় না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এদিকটির প্রকি খেয়াল রাখা উচিত।
০৯. রমজান নেক আমলের বিশেষ মাস, এ মাসের শুরুতে আল্লাহর আহবায়ক সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে আমল ও ইবাদতে আরো অগ্রসর হওয়ার আহবান করে থাকেন। সুতরাং রুটিন আমলের পাশাপাশি রমজানের বিশেষ আমলগুলোর প্রতি যত্ন নেওয়া উচিত। আথচ চরম দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই মাসে বরং আমাদের কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ রুটিন আমলই বাদ যায়। যেমন- আযানের জবাব দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত। মুআযযিন আযানের সময় যে সব বাক্য উচ্চারণ করেন, তার অনুকরণে সেগুলো বলা সুন্নাত। সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-‘মুআযযিন যা বলে, তোমরাও তা বলো’। শুধু হাইয়্যা আলাস সালাহ ও হাইয়্যা আলাল ফালাহ বলার পর ‘লা- হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ’ বলতে হবে। রমজানে আযানের সাথে সাথে আমরা ইফতারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আযানের জবাব দেওয়ার কথা ভুলে যাই। যা কাম্য নয়। এ বিষয়ে বিশেষ যত্নশীল হওয়া দরকার।‘
১০. তারাবীর নামাজে তাড়াহুড়ো করা। আল্লাহর নিকট আমলের পরিমাণের চেয়ে গুনগত মান অনেক বেশি মুখ্য। নামাজের ব্যপারে একাধিক হাদীসে তাড়াহুড়ো না করার নির্দেশ এসেছে। অথচ আমাদের সমাজের সাধারণ চিত্র হলো রমজানে তারাবীর নামাজে ক্বিরাত পাঠ, রুকু ও সাজদা-সব ক্ষেত্রেই তাড়াহুড়ো করা হয়। এতে আমলটির মান অনেক কমে যায়। অনেক সময় আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্যতাই হারায়।
১১. অনেকে ক্লান্তি কিংবা অলসতার কারণে তারাবীর নামাজের দুই রাকআত পরবর্তী বিরতীর পর ইমামের সঙ্গে দাড়িয়ে নামাযে যোগ না দিয়ে বসে বসে ইমামের রুকুতে যাওয়ার অপেক্ষা করে থাকেন। ইমাম যখন রুকুতে যান, তখন জামাতে যোগ দেন। এটা ভুল প্রবণতা। রমজান হলো ইবাদতের সিজন। পেশাদার ব্যক্তি মাত্রই ক্লান্তি ও অলসতা উপেক্ষা করে সিজনের সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করে। তবেই সে সফলতা অর্জন করতে পারে। সালাতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো কিয়াম ও ক্বিরাত। এ ব্যপারে উদাসীন থাকা বুদ্ধিমানের পরিচয় নয়।
১২. অনেকেই কোন বেরোজদার কিংবা নেক আমলে পিছিয়ে থাকা লোকদের দেখে নিজের আমল ও ইবাদতে আত্মপ্রসাদ ও গর্ববোধ করে থাকেন। যা কোন কোন সময় নিজের আমলকে নষ্ট করে দেয়। সুতরাং এমন ক্ষেত্রে নিজের আমলে আহংকারী না হয়ে আল্লাহর দেওয়া তাউফীকের কথা স্মরণ করে বরং শোকরগুযার থাকার চেষ্টা করতে হবে। অন্যথা সবই বৃথা হয়ে যাবে।
১৩. রমজানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্ত হলো শেষের দশ দিন। বোখারীর বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই দশ দিনে ইবাদতের জন্য যতোটা সাধনা করতেন জীবনের অন্য কোন সময় ততটা করতেন না। এই দশকে তিনি নিজে কোমর বেঁধে আমল শুরু করতেন এবং পরিবারের লোকদেরও ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। অথচ আমরা প্রথম দুই দশকের তুলনায় শেষের দশকে বেশি গাফেল হয়ে পড়ি। ঈদের কেনাকাটা এবং অন্যান্য ব্যস্ততায় এই মূল্যবান দশকে আমরা ইবাদতের ধারাবাহিকতা হারিয়ে ফেলি। রমজান সাধনা সার্থক করতে হলে এই দশককে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ইবাদত করতে হবে।
১৪. আয়শা রা: বলেন- রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমৃত্যু প্রতি বছর রমজানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন। (বোখারী) ই’তিকাফ আমাদের সমাজের সবচে অবহেলিত আমলের একটি। শবে কদর প্রাপ্তি ও শেষ দশকের ইবাদতে পরিপূর্ণভাবে নিমগ্ন থাকার আশায় যেখানে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জীবনের প্রতিটি বছর ইতিকাফ করতেন, সেখানে আমরা বেশিরভাগ লোক জীবনে এই আমলটি একবারও করতে পারিনি! রমজানের অন্যতম সেরা বৈশিষ্ট্য হলো এই মাসে শবে কদর রয়েছে, আর শবে কদরেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে। কোন ব্যক্তি যদি ইতিকাফ করেন, তবে তিনি শবে কদরে রাত জেগে ইবাদত করতে না পারলেও শবে কদর লাভের মর্যাদা অর্জন করবেন।
১৫. রমজানের শেষে যাকাতুল ফিতর বা ফিৎরা নামক বিশেষ সাদাকাহ বা দানের নির্দেশ করেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। আর এই সাদাকার দু’টি উদ্দেশ্য তিনি বর্ণনা করছেন- একটি হলো (ঈদ উপলক্ষে) দরিদ্রদের অন্যদান, আর অপরটি হলো ফিৎরা রোযাদের কথা ও কাজে অনর্থকতা ও ভুল-ত্রুটির কাফফারার ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ রোযাকে বিশুদ্ধ করে। (সুনানে আবু দাঊদ) ফিৎরা আদায়ে আমাদের দু’টি ত্রুটি বেশ লক্ষনীয়। প্রথমটি হলো, সময় মতো সাদকাতুল ফিতর না দেওয়া। সাদকাতুল ফিতর আদায়ের মূল সময় হলো ঈদের চাঁদ দেখার পর হতে ঈদের নামাজের পূর্ব পর্যন্ত। এর পর আদায় করলে সেটা নিছক সাধারণ দানে পরিণত হবে। সাদকাতুল ফিতর আদায় হবে না। অথচ অনেকেই এটা ঈদের পর আদায় করে থাকেন। যা জঘণ্য ভুল। আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সাদকাতুল ফিতরের অন্যতম উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন, গরীবদের খাদ্যদান-সেহেতু নগদ অর্থ না দিয়ে খাদ্য দেওয়াই শ্রেয়। তিনি নিজেও আজীবন খাদ্যদান করেছেন।
এমন আরো বেশ কিছু বিষয় আছে, সিয়ামকে সার্থক করতে হলে যেগুলোর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের সিয়াম ও রামাজানের সাধনা যদি যথাযথভাবে হয়, তবেই সাধিত হবে সিয়ামের মূল লক্ষ্য-তাকওয়া অর্জন। আর তবেই আশা করতে পারবো জান্নাতের বিশেষ গেইট ‘রাইয়ান’ দিয়ে জান্নাতে প্রবেশের, অন্যথা নয়। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সিয়াম ও রমাজান সাধনাকে কবুল ও সার্থক করুন। আমীন।
লেখক : সৌদি আরব, দাম্মাম থেকে