শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহে ৩১ জনের মৃত্যু, আক্রান্ত ৬২৩০ মসজিদে নববীর আদলে হবে আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: ধর্ম উপদেষ্টা খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনকে বিগত কমিশন থেকে শিক্ষা নিতে হবে: মুফতী ফয়জুল করীম লালপুরে যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে জমি দখল ও বাড়ি ভাংচুরের অভিযোগ জনতার চেয়ারম্যান সৈয়দ তালহাকে সুনামগঞ্জ ৩ আসনে জমিয়তের প্রার্থী ঘোষণা কুরআন-হাদিসের ভিত্তিতেই হতে হবে সংস্কার: বায়তুল মোকাররমের খতিব ইসলামী সঙ্গীত সম্রাট আইনুদ্দীন আল আজাদ রহ.-এর বাবার ইন্তেকাল কুরআন-সুন্নাহর আইন ছাড়া দেশে শান্তি আসবে না : মাওলানা হাবিবুল্লাহ মিয়াজী শীত ও শৈত্যপ্রবাহ নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস

অশুদ্ধ পুরুষ (৩)

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

monir copyমনির প্রধান : লুবনা প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে রিষ্টওয়াচের দিকে তাকায়। দশটা সতেরো বাজে। রাশেদের আসার কথা সাড়ে দশটায়। তার মানে আরো তেরো মিনিট বাকি। আজ একি সাংঘাতিক গরম। মাথার ওপর সূর্য তো নয় যেন আগুনের গোলা। এই অসহ্য গরমে অপেক্ষাটা খুব বিরক্তিকর। যদিও হালকা গোলাপি রঙের একটা ছাতা ময়ূরের মতো পেখম মেলে আছে লুবনার মাথার ওপর। তবুও গরম যায় না। লুবনা ঘেমে উঠতে থাকে দরদর। তারপর আরেক সমস্যা হলো রাশেদ কখনো ঠিক সময়ে আসে না। সবসময় সে লেটার। টাইম মেইনটেইনের ব্যাপারে কিছুমাত্র সচেতনতা তার মাঝে নেই।
জায়গাটা এমন যে আশপাশে তেমন কোনো গাছগাছালি নেই। খানিক দূরে দু’একটা ইউক্যালিপ্টাসগাছ দেখা যায়। লুবনা একটা গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। তেমন লাভ হয় না। পাতাবিহীনগাছ সূর্য থেকে গলে গলে পড়া গরমকে আটকে রাখতে পারে না। আশ্বিন মাসেও যে সূর্য এমন প্রখর হয়, না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ভাগ্যিস কী মনে করে সে ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিল।
লুবনার মনে ভয়ও কাজ করছে কিছুটা। ছোট্ট শহর। এখানে সবাই কমবেশি সবার পরিচিত। না জানি কোন ফাঁকে কে দেখে ফেলে। পঞ্চগড়ের মতো এই ছোট্ট শহরে প্রেম ভালোবাসা এখন পর্যন্ত ভয়াবহ রকমের অপরাধ। প্রেমিক পুরুষকে নিয়ে কারো সামনে পড়ে যাওয়া মানে জীবনে মোটামুটি একটা দাগ লেগে যাওয়া। এই শহরে প্রেম করেও শান্তি নেই। শান্তি আছে বড় শহরে। যেমন ঢাকা শহরের কথাই ধরা যাক। কতো রকম স্পট, কতো কী। পার্কে, উদ্যানে প্রেমিককে নিয়ে একান্তে হারিয়ে গেলেও সমস্যা নেই। সারাবেলা হাত ধরাধরি করে সমস্ত শহর হেঁটে বেড়ালেও কেউ দেখবে না। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কে প্রেম করে, কে আড্ডা দিয়ে বেড়ায়, এমন তুচ্ছ বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেবার মতো সময়ও হয়তো কারো নেই। আর এই ছোট্ট শহরের মানুষগুলোর মনও ছোট ছোট। এমন সব তুচ্ছ বিষয়ে এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা গালগল্পে মেতে থাকে, ভাবলে অবাক হতে হয়।
লুবনা যখন ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেল তখন সে খুবই অবাক হয়েছিল। কী অবাধ স্বাধীনতার একটা শহর। কারো আগে পিছে কেউ নেই। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এমন একটা শহরকেই কি যান্ত্রিক শহর বলে? লুবনা ভেবেছে অনেক। এই যান্ত্রিকতার ভেতর দিয়ে বাস করা কেমন হতে পারে? ভেবেও কোনো কূল কিনারা সে বের করতে পারেনি। তবুও এই শহরের কোনো একটা পাবলিক ভার্সিটিতে তার পড়ার ইচ্ছে ছিল ভীষণ। অবাধ স্বাধীনতা ভোগের জন্য নয়। পরিবার নামক নিকৃষ্ট বলয়ের গ-ি থেকে মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য। পৃথিবীর সব বাবারাই কি তার বাবাটার মতো? একজন শিক্ষিত মূর্খ্য। স্বার্থপর। দারুণ ছোটলোক এবং বদমেজাজি।
কিন্তু কপাল মন্দ। ঢাবি, জাবি, ইডেন কোথাও তার চান্স হয়নি। ভর্তি হতে হয়েছে পঞ্চগড়ের মতো অজোপাড়াগাঁ একটা শহরের সরকারি মহিলা কলেজে।

রাশেদ এলো পৌনে এগারোটা ছাড়িয়ে। একুশ মিনিট লেট। লুবনা কিছু না বলে থমথমে চেহারায় রাশেদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দেখেছো, আজ কী গরম, তাই না? বলে রাশেদ পরিবেশটাকে তরল করার চেষ্টা করে। তরল হয় না। কঠিন থেকে কঠিনের দিকে এগোয়।
সুন্দরী গার্লফ্রে- যখন মনোক্ষুণœ হয় তখন প্রেমিক পুরুষটি বীর হলেও তাকে ভেজা বিড়াল সাজতে হয়। রাশেদ দুই কান ধরে ন্যাকামো স্বরে বলে, ওকে, আমি সরি। নেক্স টাইম এমন হবে না। গড প্রমিজ।
আমার কাছে কি মনে হয় জানো, মনে হয়-মানুষকে কথা দিলে কিংবা কোনোকিছু নিয়ে অঙ্গীকার করলে তা যে ঠিক রাখতে হয়, এই বোধটুকু তোমার মধ্যে নেই।
বললাম তো বাবা সরি। আর হবে না তো। এই যে আমার দিকে তাকাও, ট্রাস্ট মি। আর কক্ষনো এমন হবে না। এই দ্যাখো আবার কান ধরছি। প্লিজ...
লুবনা রাশেদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে ফেলে।

কী অবাধ স্বাধীনতার একটা শহর। কারো আগে পিছে কেউ নেই। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এমন একটা শহরকেই কি যান্ত্রিক শহর বলে? লুবনা ভেবেছে অনেক। এই যান্ত্রিকতার ভেতর দিয়ে বাস করা কেমন হতে পারে? ভেবেও কোনো কূল কিনারা সে বের করতে পারেনি।

ফারহি কেমন আছো?
ভালো আছি। স্যার আপনি কেমন আছেন?
আমিও ভালো আছি। জোতি তোমার খবর কি, ভালো আছো তো ?
জোতি কিছু বলে না। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বা না জাতীয় কিছু উত্তর দেয় কি না, তাও ঠিক বোঝা যায় না। মেয়েটি কিছুটা বোকা ধরনের। বুদ্ধিশুদ্ধি কম। মুখে কথা বলার চেয়ে বোকার মতো মাথা নাড়াতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করে। আরাফাতের মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়- দেয় এক চড়। এতো বড় মাথা নাড়াতে কষ্ট হয় না। অথচ এক চিলতে জিহ্বাটুকু নাড়াতে আপত্তি। সে কয়েকদিন বলেছিল, শোন মেয়েরা, সবসময় মাথা এপাশ ওপাশ করে প্রশ্নের উত্তর দেবে না। কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় মাথা নেড়ে। সব প্রশ্নের নয়। বড়দের সাথে সবসময় মাথা নেড়ে কথা বলা খুব অভদ্রতা। মনে থাকবে তো?
ফারহির মাঝে পরিবর্তন এলেও জোতি আগের মতোই। এতো বড় মেয়ে, গায়ে হাত তোলা যায় না বলেই জোতির ভাগ্য ভালো। নইলে কখনো সখনো এমন সব কা- সে করে যে, আরাফাতের হাত নিশপিশ করে।

ফারহি গতকাল কী পড়িয়েছিলাম?
এই তো স্যার, এই দুই পেজ।
পড়া ঠিক করেছো?
জি করেছি।
আরাফাত মনোযোগের সাথে তাকিয়ে রইলো ফারহির দিকে। তার মন বলছে ফারহির মন আজ ভয়ংকর খারাপ। খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে। কিছুই বলবে না। অল্প বয়সের মেয়েরাও যে দারুণ বুদ্ধিমতী হয়ে উঠতে পারে ফারহি তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ। মেয়েটির গায়ের রং ফর্সা হলে কেমন হতো ভাবলেই আরাফাতের গা শিউরে ওঠে। হাজারবার না চাইলেও নির্ঘাত সে প্রেমে পরতো এই মেয়ের। কিন্তু আজ মেয়েটার হয়েছে কি? ক’দিন পর পরই পড়াতে এলে সে দ্যাখে ফারহির মন খারাপ। জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যাবার মতো নয় ছয় কোনো কিছু বলে। মেয়েটা ভেতরে কি কোনো কষ্ট লালন করে? এইটে পড়া এইটুকুন মেয়ে, কষ্ট লালনের বিষয়টা এই বয়সের সাথে ঠিক যায় না। না, তার এই ধারণাটা হয়তো বা সঠিক নয়। কষ্টের সম্পর্কটা বয়সের সাথে নয়, অনুভব ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত। যার অনুভব ক্ষমতা যতো বেশি তার কষ্টও ততো বেশি।
ফারহির বয়সে আরাফাতের মনেও এমন চাপা কোনো কষ্ট ছিল কি না, আরাফাত মনে আনতে চেষ্টা করে। কয়েকটা মোটা দাগের কষ্টের কথা মনে পড়ে। যেমন বাবা না থাকার অনুভূতি। এই অনুভূতি কি পনেরো বছর বয়সের একটা ছেলেকে আদিগন্ত কষ্টে ডুবিয়ে রাখে না? তবে বাবা না থাকার কষ্ট এই পৃথিবীতে তার একার নয়। আরো অনেকের আছে। এছাড়াও আলাদা একদম সূক্ষ্ম কোনো কষ্ট কি তার বুকের ভেতর সবসময় খাঁ খাঁ করে বেড়াতো? যা সচরাচর সবার থাকে না। যা ভেবে অনেক দীর্ঘরাত সে বালিশ ভিজিয়েছে চোখের জলে!

ফারহি আজ বোধহয় তোমার মন খারাপ? আমি কি ঠিক বললাম?
ফারহি চুপচাপ। হ্যাঁ না কিছু বলে না।
আচ্ছা ঠিক আছে। না বলতে চাইলে না বলবে।
সরি স্যার। ব্যাপারটা আমাদের পারিবারিক। বলতে পারবো না। খুব লজ্জার একটা বিষয়। ফারহি আবার বিষণœ সুরে বলে, স্যার আজ আমার পড়তে ইচ্ছে করছে না। না পড়লে আপনি কি রাগ করবেন?
আমি রাগ করবো না। তবে তোমার বাবা-মা হয়তো রাগ করতে পারেন। তারা মনে করবেন আস্ত বাজে এক মাষ্টার রেখেছি। ঠিকঠাক পড়ায় না। শুধু ফাঁকি দেয়।
আরাফাত ভেবেছিল এইবার ফারহি কিছু বলবে। কিন্তু মেয়েটি কিছুই বলে না। মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে। কিংবা হতে পারে পড়তে না চাওয়ার অপরাধবোধ তার মাথাকে নুইয়ে রাখে।
ফারহি আজ আমি যাচ্ছি। পড়া ঠিক করে রেখো। আর একদম মন খারাপ করে থাকবে না। সবার জীবনেই দুঃখ কষ্ট আছে। দুঃখ কষ্টকে এড়িয়ে শুধু সুখটুকু অনুভব করতে শিখলে বেঁচে থাকাটা হয় আনন্দের। কষ্ট পুষে রাখার জিনিস নয়। অভিজ্ঞতা অর্জনের এবং শিক্ষা নেবার উপকরণ মাত্র। কথাগুলো তোমার কাছে ভারী মনে হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি ভালো। কি বললাম মনে থাকবে?
জি স্যার।

ফারহির বাবা নাজমুল হুদা সাহেব গতকাল রাতেও স্ত্রীকে মেরেছিলেন। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে চার বছর আগে। বয়স তার শারীরিক গঠনকে এখনো কাবু করতে পারেনি। দাঁড়ি পাকলেও সব চুল এখনো কালো। শক্তি সামর্থও বত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের মতো অনুভব করেন। রাতের বিছানায় এখনো তিনি সবল পুরুষ।

রশন আরার ঘুম ভেঙেছে সীমাহীন আতঙ্কের সাথে। যতক্ষণ না তার মাঝে পুরোপুরি চেতনাবোধ ফিরে এসেছিল, তার মনে হয়েছে-অতি প্রাকৃতিক কোনো কিছু তার ঘুমন্ত অসাড় দেহটাকে জাপটে ধরে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। চেতনাবোধ ফিরে আসার পর তার কেমন লেগেছিল?

গতকাল রাতে একই কারণে রওশন আরা মার খেয়েছেন। রাত আড়াইটার সময় নাজমুল হুদা তার বেডরুমে গিয়েছিলেন। রওশন আরা ছিলেন ঘুমিয়ে। ঘুমের মধ্যেই নাজমুল হুদা তাকে জড়িয়ে ধরেছেন।
হঠাৎ ঘুমের ভেতর ভারী কোনো কিছু যদি গায়ের ওপর এসে ওঠে তাহলে অবস্থাটা হয় কেমন। রশন আরার ঘুম ভেঙেছে সীমাহীন আতঙ্কের সাথে। যতক্ষণ না তার মাঝে পুরোপুরি চেতনাবোধ ফিরে এসেছিল, তার মনে হয়েছে-অতি প্রাকৃতিক কোনো কিছু তার ঘুমন্ত অসাড় দেহটাকে জাপটে ধরে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। চেতনাবোধ ফিরে আসার পর তার কেমন লেগেছিল? এ এমন এক সময়, যখন বিস্ময়বোধের ক্ষমতাটুকু হারিয়ে যায়। রি রি করে জেগে ওঠে শুধু একরাশ ঘৃণা।
রওশন আরা এক ঝটকা মেরে স্বামীকে গায়ের ওপর থেকে সরাতে চেয়েছেন। পারেননি। নাজমুল হুদার গায়ে ঢের শক্তি। রওশন আরার জন্য কাজটা এতো সহজ নয়।
তোমাকে না বলেছি, সপ্তাহে শুধুমাত্র দু’দিন আসবে আমার বেডরুমে। গলার আওয়াজটা গোঙানির মতো বেরিয়ে আসে রওশন আরার মুখ দিয়ে।
নাজমুল হুদার সেদিকে কোনো খেয়াল আছে বলে মনে হয় না। তিনি অনবরত স্ত্রীর শরীর নিয়ে মেতে ওঠেন নিজের ইচ্ছে মতো। রিপুর তাড়না মানুষকে মনুষত্ব থেকে নামিয়ে পশুর কাতারে এনে দাঁড় করায়। নাজমুল হুদা ক্ষুধার্ত সিংহ এবং মেষ সাবকের মাঝের দৃশ্যটি চিত্রায়িত করতে থাকেন। নিজের শব্দ ছাড়া আলাদা কোনো শব্দ তার কানে পৌঁছয় না।
নাজমুল স্টপ। প্লিজ স্টপ ইট। গতকালই আমি তোমাকে সঙ্গ দিয়েছি। আজ পারবো না। খুব সকালে আমাকে স্কুল যেতে হবে।
নাজমুল হুদা প্রচ- শক্তিতে তিন চারটা চড় কষেছেন রওশন আরার গালে। তারপর বাথরুমে ঢুকে পাঁচ মিনিট কাটিয়ে ফিরে গিয়েছেন নিজ বিছানায়।

আগের পর্ব পড়তে : অশুদ্ধ পুরুষ ২

আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /এসএস


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ