শাহাদাত হোসাইন : মালয়েশিয়ান মুসলমানরা মসজিদ ও ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সাজসজ্জা করার মাধ্যমে রমজানকে স্বাগত জানায়। এ উপলক্ষে মহিলারা ঘরের ব্যবহার্য আসবাবপত্র কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শাবানের ২৯ তারিখে অধীর আগ্রহে রমজানের চাঁদ দেখার চেষ্টা করতে দেখা যায় অনেককে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চাঁদ দেখার ব্যবস্থাপনা থাকে। চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গেই রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে ঘোষণা দেয়া হয় এবং রোজা রাখার আহ্বান জানানো হয়।
রমজান পদার্পণের সঙ্গে সঙ্গেই মালয়েশিয়ার প্রধান সড়কগুলোর চেনা রূপ পাল্টে যায়। এমনিতে সারা বছর সড়কগুলো থাকে পরিচ্ছন্ন, তার ওপর রমজান উপলক্ষে বাড়তি সাজসজ্জা ও পরিচ্ছন্নতা অভিযানের ফলে সড়কগুলো ঝকঝক করতে থাকে। সড়কবাতির পাশাপাশি রমজানের সম্মানে আলোকসজ্জার ফলে দেশজুড়ে বিরাজ করে অনন্য মায়াবী রূপময়তা।
রমজান উপলক্ষে সেখানকার মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময়ের সংস্কৃতি বেশ পুরনো। অভিবাদনস্বরূপ তারা ‘শাহরুন মুবারাকুন’, রমজান ও রোজার আয়াত বা হাদিসসংবলিত খামসমেত প্রীতিকার্ড বিনিময়ের মাধ্যমে খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করে থাকে, যা অধিকাংশই লেখা থাকে আরবি ভাষায়। এছাড়াও গ্রামে মসজিদে মসজিদে পবিত্র রমজানের আগমন উপলক্ষে বিশেষ আলোচনা ও ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামীণ ভাষায় ‘ডোক’নামীয় বিশাল আকারের সাইরেনের মাধ্যমে রমজান আগমনের বার্তা দিগ্বিদিক ছড়ানো হয়।
[caption id="attachment_3270" align="alignnone" width="800"] রমজানের চাদ দেখছেন মালয়েশিয়ান মুসলিমরা[/caption]
মালয়েশিয়ান সরকার রমজান উপলক্ষে রোজাদারসম্পৃক্ত সব স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। অসহায়, গরিব ও দুস্থদের জন্য থাকে বিশেষ সহায়তা। সাহরি, ইফতার ও রোজাসংশ্লিষ্ট অন্যান্য আমলে দুর্ভোগ বা সমস্যা চিহ্নিতকরণে সরকারি মনিটরিং ব্যবস্থা থাকায় সেখানকার অধিবাসীরা পরম শান্তিতে সিয়াম পালন করতে পারেন। সরকারের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও নিত্যপণ্যে মূল্যহ্রাস বা বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করে থাকে। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে দেশব্যাপী রমজানসংশ্লিষ্ট সামগ্রী বিতরণ করা হয়। আয়োজন করা হয় হিফজ ও কেরাত প্রতিযোগিতাসহ ধর্মীয় শিক্ষামূলক প্রতিযোগিতা এবং পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। এতে থাকে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর জীবনী, সাহাবাদের জীবনী, ফিকাহ, আহকাম ও তফসিরসহ রমজান ও রোজাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফাজায়েল ও মাসায়েল বিষয়ের বৈচিত্র্যময় সমাহার। এর মাধ্যমে জনসাধারণের মাঝে জ্ঞানের অভূতপূর্ব অনুশীলন হয়ে থাকে। এ মাসে মসজিদগুলো মুসলি্লতে কানায় কানায় ভরপুর থাকে। বিশেষ করে এশা ও ফজরে থাকে লক্ষণীয় ভিড়। বাংলাদেশে আমরা যেখানে রমজানে ফজরের পরপরই ঘুমের বিছানায় নুইয়ে পড়ি, মালয়েশিয়ান মুসলমানরা সেখানে ফজরের পর অনুষ্ঠিত বিশেষ ধর্মীয় আলোচনা সভায় সানন্দে অংশ নেয়। সূর্যোদয় পর্যন্ত চলতে থাকে এ আলোচনা। এরপর তারা নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে পড়ে। অধিকাংশ মানুষ বিশেষ করে যারা দ্বীনদার তারা ফজরের পর কখনও ঘুমান না।
মালয়েশিয়ার অধিকাংশ মসজিদে ২০ রাকাত তারাবি পড়া হয়। পুরুষ-মহিলা, যুবক-বৃদ্ধ, ছোট-বড় সবাই জামাতে নামাজ আদায় করে থাকে। তারাবি শেষে ধর্মীয় শিক্ষামূলক আসর অনুষ্ঠিত হয়।
মালয়েশিয়ান মুসলমানরা শহরে ও গ্রামে পহেলা রমজান থেকেই এলাকাভিত্তিক নৈশপ্রহরী নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সে রাতে সারা মহল্লা চক্কর দিতে থাকে। সাহরির সময় হলে সবাইকে জাগিয়ে তোলে। প্রতিদিনই ফজরের আগ পর্যন্ত সবাইকে সে ডেকে যায়। এখানকার মুসলমানদের আরও একটি অভ্যাস হচ্ছে_ তারা সাহরি খাওয়ার পর ‘কোলাক’নামীয় এক ধরনের পানীয় পান করে। এতে পিপাসা নিবারণ হয়, দিনে শরীরের ক্লান্তি দূর হয় এবং রোজা মৌসুমে নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতে শক্তি সঞ্চার হয়।
[caption id="attachment_3272" align="alignnone" width="809"] মসজিদে কুরআন পড়ছেন নারীরা[/caption]
আমাদের মতো তাদেরও প্রধান খাদ্য ভাত। সঙ্গে তারা মুরগির গোশত, ডিম ও হালুয়াজাতীয় খাবার সাহরিতে খেয়ে থাকে। পরিবার-পরিজন নিয়ে সাহরি করলেও অধিকাংশ মালয়েশিয়ান পুরুষ ইফতার করে থাকেন মসজিদে। মাগরিবের সময় হলেই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী খাদ্য ও পানীয় নিয়ে মসজিদে চলে আসেন। লম্বা বিছানায় সারি সারি ইফতারির পসরা। সবার জন্য উন্মুক্ত একই দস্তরখানায় সবাই মিলে ইফতার করেন।
ইফতার সাধারণত খেজুর দিয়ে শুরু করা হয়। এছাড়াও নাসি আয়াম, নাসি লেমাক, লাকসা, আয়াম পারসেক নামের খাদ্যগুলো থাকে ইফতার তালিকায়; যা চাল, নারকেল, মশলা ও আখের রস দিয়ে তৈরি। ইফতার সেরে মাগরিবের নামাজ আদায় করে তারা ঘরে গিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশীয় ভোজন পর্ব সারেন। এরপর গায়ে আতর বা সুগন্ধিদ্রব্য মেখে মসজিদ অভিমুখে রওনা হন। সঙ্গে নিয়ে যান ফলমূল ও পানীয়, যেন দীর্ঘ সময় মসজিদে অবস্থানকালে ক্ষুধা-পিপাসার বেগ পেলে কষ্ট করতে না হয়।
রমজান উপলক্ষে মালয়েশিয়াজুড়ে বিরাজ করে তাকওয়ার অপার্থিব পরিবেশ। প্রতিটি মসজিদে কোরআন, তফসির, হাদিস, ফিকাহ, আকাইদ ও মাসায়েলসহ ধর্মীয় নানা বিষয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন চোখে পড়ার মতো। ছেলে-বুড়ো, যুবক-যুবতীদের সরব অংশগ্রহণে এসব অনুষ্ঠান থাকে প্রাণবন্ত। শেষ দশকে মসজিদগুলো হয়ে ওঠে আরও জীবন্ত। কেউ নামাজ পড়ছে, কেউ কোরআন তেলাওয়াতে মগ্ন, কিছু লোক জিকির করছে, কেউবা ইতিকাফে এভাবেই এক জান্নাতি পরিবেশ বিরাজ করে সেদেশে।
/আরআর