তাজিম সারোয়ার : মহান আল্লাহ হাদিসে কুদসিতে বলেন, আস্সাওমুলি ওয়ানা আজজি বিহী, অর্থাৎ রোজা আমার জন্য, আমিই তার প্রতিদান দিয়ে থাকি। মানবজীবনে রোজার গুরুত্ব অপরিসীম। রোজা মানুষকে পাপমুক্ত জীবন গড়তে সাহায্য করে। মানুষকে মানুষের কাছে এনে দেয়। পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন মজবুত করে দেয়।
রমজানে মানুষ আল্লাহর ইবাদতে একাগ্র হয়। কোরআনুল কারীম বেশি বেশি তেলাওয়াত হয়। এ জন্য মানুষের মন আল্লাহমুখি হয়। এতে মানুষ আল্লাহ নৈকট্যের কাছাকাছি চলে যায়। আসুন আমরা জেনে নিই পৃথিবীজুড়ে মুসলিম কীভাবে রমজান পালন করে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের কাঙ্ক্ষিত পবিত্র মাহে রমজান। এটি আত্মশুদ্ধির মাস। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব রকম পানাহার থেকে বিরত থাকেন রোজাদাররা। প্রাকৃতিকভাবে সূর্যের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ও দেশে রোজা রাখার সময় কম-বেশি হয়। দেশের ভৌগোলিক অবস্থানের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হয় এই সময়।
এ কারণেই সময়ের তারতম্য হয়ে থাকে। কোথাও ২২ ঘণ্টা আবার কোথাও ১০ ঘণ্টারও কম। সোমবার থেকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পবিত্র মাহে রমজান শুরু হয়েছে। চলতি বছরে গত ৩০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সিয়াম পালন করতে হবে সুমেরীয় অঞ্চলের মুসলিমদের। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে এবার ২০ ঘণ্টার বেশি সময় তাদের পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে। অথচ শীতকালে এ অঞ্চলের মুসলিমদের সিয়াম সাধনা করতে হয় মাত্র আট ঘণ্টার মতো। অন্যদিকে আমাদের বাংলাদেশে রোজার সময় হবে প্রায় ১৪ ঘণ্টা। যুক্তরাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় উপোস থাকতে হবে স্কটিশ হাইল্যান্ডস ও আয়ল্যান্ডের বাসিন্দাদের। এখানে সূর্য অস্ত যায় না বললেই চলে।
রমজান সংস্কৃতি;
সৌদি আরব
সেখানে রমজান উপলক্ষে বিভিন্ন কোম্পানির জিনিসে থাকে বিশেষ ছাড়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য থাকে হাতের নাগালে। আর ক্রয়-অক্ষম মানুষদের জন্য বাদশার পক্ষ থেকে দেওয়া হয় গিফট বক্স। যাতে থাকে তেল-চিনি-দুধসহ অন্যান্য দ্রব্য।
মহিমান্বিত রমজান মাস পালনে সৌদিতে মাস দুয়েক আগ থেকে চলে প্রস্তুতি। একে অপরে দেখা হলেই ‘শাহরু আলাইকা মোবারাকা’ বলে কুশল বিনিময় করেন। রমজান শুরু হওয়ার সপ্তাহ-দশ দিন আগে থেকেই এখানে রাস্তার পাশে কিংবা বাজার-মার্কেটে শোভা পায় সারি সারি তাঁবু।
অনেকগুলো আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। রোজাদারদের ইফতার করানোর জন্যই তৈরি করা হয় এসব। তাঁবুগুলোতে ব্যবস্থা করা হয় ভালো ইফতারের। খেজুর, বোতলজাত পানি, জুস, মাঠা, ফল, কফি, চিকেন বিরিয়ানি, এলাকাভিত্তিক ঘরোয়া খাবার ইত্যাদি। পুরো রমজান মাসে ভিনদেশি শ্রমিকদের ইফতার বা সেহেরি কখনো কিনতে হয় না। এসব কাজ পুরোপুরি নিজস্ব উদ্যোগেই হয়ে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্র
এখানে আছে প্রায় ৭০ লাখ মুসলমান। বেশির ভাগ মুসলমান বাস করেন ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক, নিউজার্সি, ইলিনয়েস, ইস্তিয়ানো, মিশিগান. টেক্সাস, ভার্জিনিয়া ও মেরিল্যান্ড অঙ্গরাজ্যগুলোতে। এশিয়ান মুসলিমরা যারা এখানে বসবাস করেন তারা তাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে পায়জামা, পাঞ্জাবি, কাবুলি সেট কোর্তা পরিধান করেন এবং মহিলা ও শিশুরা মেহেদি দিয়ে হাত রাঙান।
অন্যদিকে আফ্রিকান মুসলিম যারা এখানে থাকেন তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করেন। আমেরিকায় ইফতারসামগ্রীর মধ্যে খেজুর, খোরমা, সালাদ, পনির, রুটি, ডিম, গোশত, ইয়াগার্ট, হট বিনস, স্যুপ, চা ইত্যাদি থাকে। রমজান মাসে হোয়াইট হাউসে ইফতার পার্টি প্রথম শুরু করেছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। এটা বর্তমানে একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কানাডা
রাজধানী অটোরায় সর্বাধিক মুসলমান বসবাস করে, সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার। অটোয়া ছাড়াও সাসকেচুয়ান, অল্টারিও, সিনেটোবা, টরেন্টো, কুইবেক রাজ্যগুলোতে মুসলমানরা বসবাস করেন।
রমজানে ইফতার পার্টির আয়োজন চলে মহাসমারোহে এবং প্রতি শনিবার অটোয়া ইসলামিক সেন্টারের ইফতার পার্টিতে দেশ- বিদেশের অসংখ্য মুসলমান হাজির হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘দ্য মুসলিম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ইফতার পার্টির আয়োজন করে। ইফতারিতে খেজুর, খোরমা, পনির, সালাদ, ফল, স্যুপ, জুস, রুটি, ডিম, গোশত, চা-কফি ইত্যাদি থাকে।
ইতালি
দেশটির অধিকাংশ অধিবাসী ক্যাথলিক খ্রিস্টান, তা ছাড়া বৌদ্ধ ও ইহুদি আছে। সমগ্র জনসংখ্যার ১% হলো মুসলমান। এই অল্পসংখ্যক মুসলমান রমজানকে ঘটা করে স্বাগত জানায়। ইফতারিতে তারা বার্গার জাতীয় খাদ্য, নানাবিধ ফল যেমন- মাল্টা, আপেল, আঙ্গুর, বিভিন্ন ফলের রস খান। সেহেরিতে বার্গার ও বার্গার জাতীয় খাদ্য বেশি পছন্দ করে থাকে।
জার্মানি
এখানে প্রায় ৩০ লাখ মুসলমান, যাদের বেশির ভাগ শ্রমিক এবং তারা বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে এসেছে। বর্তমানে এ দেশে দুই হাজার মসজিদ আছে। শীত মৌসুমে এখানে সূর্য উঠে সকাল ৮টায় এবং সূর্য ডুবে বিকাল ৪টায়। তাই কাজের মধ্যেই ইফতারির সময় হয়ে যায়। বড় বড় প্রতিষ্ঠানসমূহে মুসলমান শ্রমিকদের জন্য ইফতারের আয়োজন করা হয়।
সুদান
আফ্রিকা মহাদেশের বড় একটি মুসলিম দেশ হলো সুদান, যার রাজধানীর নাম হচ্ছে খার্তুম। এখানে ইফতারি সাধারণত খেজুর দিয়ে শুরু করা হয়। তা ছাড়া ‘হামড়া’ ‘লাহমা’ নামক গোশত দিয়ে তৈরি খাদ্য খেয়ে থাকে। চালের তৈরি ‘আছিদা’ এক ধরনের পিঠা তারা খায়।
গোশত ও সস দিয়ে তৈরি ‘মুলাহ’ নামক খাদ্যও ইফতারিতে খায় এবং একই সঙ্গে ‘গাওয়া’ নামক চা জাতীয় পানীয় তারা পান করে। সুদানিরা ‘শোরবা’ নামক স্যুপ, মাংস দিয়ে তৈরি ‘মুহাম্মার’ নামক খাবার, দুধ ভাত দিয়ে তৈরি ‘রুসবিল হালিব’ সালাদ দিয়ে খায়। তদুপরি পায়েশ, ক্ষির, ফিরনি এগুলো তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে থাকে।
মিসর
রমজানে এখানে অফিসের কর্মঘণ্টা কমানো হয় যাতে সিয়াম পালনকারীরা মসজিদে ইবাদতে পর্যাপ্ত সময় পান। দিনের কাজকর্ম করে তারা রাতে কিয়ামুল লাইল, তারাবি এবং কোরআন তিলাওয়াত করে কাটিয়ে দেন। জোহরের সালাতের পর থেকে ‘বাজারের শহর’ নামে খ্যাত রাজধানী কায়রো শহরের অলিগলিতে ঢাকার চকবাজারের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ে হরেক রকম ইফতারের আয়োজন। ইফতারে ঐতিহ্যবাহী পানীয় ‘শরবত কামার আল দীন’ সব বয়সীরা পান করে থাকে।
মরুভূমির এই দেশে ইফতারিতে খেয়ে থাকে ‘কানাফা’ নামক পিঠা যা আটা, বাদাম, মধু, কিশমিশ ও চিনি দিয়ে তৈরি করা হয়। আরেক ধরনের গোলাকার ছোট পিঠা ‘তায়েফ’ তাতে বাদাম ও কিশমিশ বেশি থাকে তাও খেয়ে থাকেন।
মিসরীয় শিশুদের কাছে রমজান মাসটি সবচেয়ে বেশি আনন্দময়। তারা এ সময় আমাদের দেশের বাচ্চাদের মতো পিতা-মাতার কাছে সিয়াম রাখার জন্য দাবি জানায়। মিসরের মুসলমানরা ইফতার করেন আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাসায়।
রমজানের রমজানের দাবি অন্যায় মুক্ত পৃথিবী গড়া। কাটাকাটি হানাহানি মুছে ফেলা। পরস্পর হৃদ্যতা গড়ে তোলা। এসব গুণাবলি অর্জন হলেই বলা যায় রমজানের স্বার্থকতা এসেছে। আমরা পারবো তো? আল্লাহ সহায় হোন।
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম/এইচএ