মুহাম্মাদ লুতফেরাব্বী, অতিথি লেখক : আল্লাহ তায়ালা মানুষের উপর যে কয়টি মৌলিক বিধান ফরজ করেছেন তার অন্যতম হলো যাকাত। ধনীদের মালের একটি নির্দিষ্ট অংশ প্রয়োজনগ্রস্ত মানুষের মাঝে বণ্টনের মাধ্যমে সমাজে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
যাকাত কাকে দেয়া যাবে, এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে সুরা তাওবার ৬০ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, সদকা হলো কেবল ফকির, মিসকিন, যাকাত উসুলকারী, যাদের মনোরঞ্জন প্রয়োজন এবং দাস-মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে জেহাদকারী এবং মুসাফিরের জন্য...।
মানুষের প্রয়োজন ও বিপদ বিবেচনা করে ইসলামি শরিয়তে যাকাতের জন্য এই আটটি মাসরাফ বা প্রদানক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। খুলাফায়ে রাশেদিন ও ইসলামি খেলাফতের স্বর্ণযুগে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে যাকাত সংগ্রহ ও সকল খাতে সুষম বণ্টনের ব্যবস্থা ছিল। হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. এর যুগে সমাজের অবস্থা এমন উন্নত পর্যায়ে পৌঁছে ছিল যে, যাকাত গ্রহণ করার মত কোন লোক পাওয়া যেত না। ফলে যাকাতের টাকায় গম কিনে পাহাড়ের চূড়ায় ছড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে মুসলমানের দেশে কোন পাখিও অভুক্ত না থাকে...।
কিন্তু পরবর্তীতে খেলাফতের বিলুপ্তি ও মানুষের মাঝে দ্বীনের ব্যাপারে উদাসিনতার দরুণ সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। একদিকে সামাজিক বৈষম্য দিনদিন বেড়েছে, অন্য দিকে যাকাত প্রদানে মানুষের অনিহা ও ক্ষেত্রবিশেষ অনেক অজ্ঞতা, ভুল বুঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। সাধারণভাবে অনেকেই নির্দিষ্ট কিছু খাতে যাকাত দিলেও প্রয়োজনীয় বিভিন্ন খাতে যাকাত দেন না বা দেয়া যাবে বলে মনে করেন না। নিম্নে তেমনি কিছু খাতের উল্লেখ করা হলো।
১. নওমুসলিম পুনর্বাসন
এটি অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়, যেখানে খৃষ্টান মিশনারীগুলো প্রচুর অর্থ ও নানা সুযোগ সুবিধার লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করছে, সেখানে একজন নওমুসলিম ভাই অথবা বোনকে মসজিদের দরজায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। অথচ পবিত্র কুরআনে বর্ণিত মাসরাফ সমূহের মধ্যে ‘মুয়াল্লাফাতি কুলুবুহুম বা যাদের মনোরঞ্জন প্রয়োজন’ দ্বারা এই শ্রেণিকেই বুঝানো হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুনাইন যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমতের উল্লেখযোগ্য অংশ মক্কার নওমুসলিমদের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছিলেন [যাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ধনীরাও ছিল]। বর্তমান সমাজে নওমুসলিমরা অনেকভাবে উপেক্ষিত। ধর্ম পরিবর্তনের ফলে পরিবার ও সমাজ থেকে প্রত্যাখ্যাত এই ভাই বোনদের মুসলিম সমাজে সম্মানজনক পুনর্বাসন জরুরি।
২. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত মাসরাফ সমূহের অন্যতম হলো ‘গারিমিন’ বা ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি। অর্থনৈতিক টানাপোড়নের কারণে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের অনেকে বাধ্য হয়ে বিভিন্ন সমিতি বা প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। পরবর্তীতে সময়মত কিস্তি অনাদায়, সুদের হার বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে দাতাপক্ষের চাপ বাড়তে থাকে। অনেককে ভিটা-বাড়ি হারাতে হয়। অনেকের স্থান হয় জেলে। বিশেষত এই দুরাবস্থার শিকার হোন গ্রামীণ এনজিওগুলো থেকে ঋণগ্রহীতা নারীরা। পত্রিকার পাতা উল্টালেই এসংক্রান্ত হৃদয়বিদারক নানা খবর দেখা যায়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সব সময় দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ্! আমি আপনার কাছে ঋণের বোঝা ও মানুষের রূঢ়তা থেকে পানাহ চাই।’ সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ১৫৫৫
উল্লেখ্য, আয়াতে শুধু দরিদ্র ঋণগ্রস্তের কথা বলা হয়নি; বরং বিপদে পড়া সচ্ছল ব্যক্তিও এর অন্তর্ভুক্ত। উপরন্তু তারা অনেক ক্ষেত্রে সাহায্যের বেশি মুখাপেক্ষী হয়। কারণ সামাজিক মর্যাদার কথা ভেবে তারা কারো কাছে হাত পাততে পারেন না, আবার ঋণের বোঝা ও মানুষের রূঢ়তাও সইতে পারেন না। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা অনেকগুলো আত্মহত্যার কারণ শুধু এটাই।
৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার ব্যক্তি ও পরিবার
প্রতিদিন সড়ক ও নৌপথে অসংখ্য মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। মুহূর্তেই তছনছ হয়ে যাচ্ছে সাজানো গোছানো একটি পরিবার। এছাড়াও রয়েছে ক্ষরা-মঙ্গা-বন্যাসহ নানা মৌসুমি দুর্যোগের আক্রমণ। অনেক সচ্ছল মানুষ এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হয়ে শারীরিক অক্ষমতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক দৈন্যতার সম্মুখীন হচ্ছেন। স্বামী হারিয়ে বিধবা হচ্ছেন অনেকে। বৃদ্ধ পিতা-মাতা ও এতিম বিধবার এই সংসার কিভাবে চলছে তা ভুক্তভুগী ছাড়া কারো পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়।
৪. হাসপাতালের মূমুর্ষ রোগী
দুর্ঘটনায় আহত মানুষের পাশাপাশি হাসপাতাল-ক্লিনিকের বেডে প্রতিনিয়ত কাতরাচ্ছে দুরারোগ্য বিভিন্ন ব্যাধিতে আক্রান্ত অনেক মানুষ। চিকিৎসার আকাশচুম্বী ব্যয়ভার টানতে গিয়ে অল্প সময়ে রিক্তহস্ত হচ্ছে অনেক পরিবার। এছাড়াও রুগীর সাথে সময় দেয়ার ফলে পরিবারের অন্যান্যদের স্বাভাবিক জীবিকা নির্বাহের উপায়ও ব্যাহত হচ্ছে। জীবন–মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো এই মানুষগুলো অনেক ক্ষেত্রে যাকাতের বেশি হকদার।
৫. খেটে খাওয়া মানুষ
পথফকিরকে অনেকে ভিক্ষা দিলেও রিকশাওয়ালাকে দুই টাকা অতিরিক্ত ভাড়া খুব কম মানুষই দেয়। অটো, সিএনজি, বাস সর্বত্র ভাড়া নিয়ে ঝগড়া করে মানুষ।
দোকান-অফিসের কর্মচারী, হোটেলবয়, ফেরিওয়ালা, কুলি-মজুর, দারোয়ান, ঝাড়ুদার, পিয়নসহ নিম্ন পেশার অনেকেই আর্থিক সংকটে ভুগেন। কিন্তু কাজের চাপ, কিছুটা লজ্জাবোধের কারণে দশজনের কাছে হাত পাততে পারেন না। সমাজের এই অসহায় মানুষগুলোকে ভিক্ষার অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখতে তাদের পাশে দাঁড়ানো সবার নৈতিক দায়িত্ব।
৬. অবহেলিত মেধা ও স্বল্পোদ্যোক্তা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘বনে কাঠ কেটে পিঠে করে বয়ে এনে (তা বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করা) কারো কাছে হাত পাতার চাইতে উত্তম।’ সহিহ বুখারি ২০৭৪
আমাদের সমাজে অনেকে আছেন যারা খোদাপ্রদত্ত্ব মেধা ও কঠোর পরিশ্রম করে বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করেছেন। সমাজ ও জাতির কল্যাণে অনেক পরিকল্পনা তাদের আছে। অনেকে আবার নিজের যৎসামান্য পুঁজি বিনিয়োগ করে কোন প্রকল্প দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা না থাকায় তারা ‘শিক্ষিত বেকার’ বা ‘ব্যর্থ উদ্যোক্তা’ এর অভিশাপ মাথায় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কেউ কেউ পেটের দায়ে জড়িয়ে পড়ছেন নানা অসৎ কাজে।
৭. বিয়েযোগ্য পাত্রপাত্রীর খরচ যোগানো
হযরত উমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. এর যুগে ঘোষণা দেয়া হত- ‘আইনান নাকিহুন!’ বিয়ে করতে ইচ্ছুক যুবকেরা কোথায়! সরকারি খরচে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে।
বর্তমান সমাজে বিয়ের নানা প্রতিবন্ধকতা ও উচ্চমূল্যের কারণে অনেকের পক্ষেই সময়মত বিয়ে করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সমাজে অশ্লীলতা–ব্যভিচার বেড়েই চলেছে। তাই যাকাতের অর্থ এই খাতে ব্যয় করা অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয়।
এখানে উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি খাতের কথা বলা হলো, এছাড়াও অনেক অভাবগ্রস্ত মানুষ রয়েছেন যারা আত্মসম্মানবোধের কারণে শত কষ্ট সত্ত্বেও কোন দিন মুখ ফুটে তা প্রকাশ করে না। কুরআনের ভাষায়, ...অজ্ঞ লোকেরা সংযমের কারণে তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদেরকে তাদের লক্ষণ দিয়ে চিনবে। তারা মানুষের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ভিক্ষা চায় না.. ‘ সূরা বাকারা – ২৭৩
তাই সমাজের বিত্তশালীদের উচিৎ খুঁজে খুঁজে এসব শ্রেণির লোকদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা।
লেখক : এমফিল গবেষক। আল আজহার বিসশ্ববিদ্যালয়, মিসর
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম /আহসান