শাহ নাওয়াজ শিমুল : ক্লাস ফোরে থাকাকালীন সাইকেল চালানো শেখার একটা প্রবল নেশা আমাকে পেয়ে বসলো, শুরু হল আব্বুর সাইকেল নিয়ে ঠেলাঠেলি৷ অবশেষে সেটা দু সপ্তাহেই রপ্ত করে ফেললাম৷ তারপর থেকে সাইকেল আমার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে গেল৷ যখনই আব্বুর সাইকেল পেতাম তখনই এদিকে ওদিকে বেড়িয়ে পরতাম৷ আর আশেপাশে চক্কর দেওয়া তো আছেই, নতুন নতুন হলে যা হয় আরকি৷
২০০০ সালের কথা, ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে একদিন সন্ধ্যায় আব্বু আমাকে একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন৷ শহরেরই ভিতরে তবে বাসা থেকে প্রায় দু কিলোমিটার দূরে৷ প্রথম প্রথম অনাবাসিক ছিলাম, মানে সকালে যেতাম আর এশার নামাজের পরে আবার বাসায় আতসাম৷ খুব যে কষ্ট হত তা কিন্তু নয় তবে একা একা রাতের বেলা এত পথ হেঁটে আসাটা খুবই বিরক্তিকর ছিল৷ দুমাসের মাথায় বলেই ফেললাম ‘যদি সাইকেল না দাও তাহলে আমি আর মাদরাসায় যাবো না৷’
একদিন সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় একটা পুরাতন ঝকঝকে এলটাস সাইকেল দেখতে পেলাম, শুধুই দেখলাম, জানতামনা যে এটাই আমার ব্যক্তিগত প্রথম বাহন৷ গোসল করে ব্যাগ গুছিয়ে যখন ঘরের বাহিরে বের হয়ে গেলাম মাদরাসায় যাবো বলে৷ আম্মু পেছন থেকে ডেকে চাবি দিল বলল ‘তোমার সাইকেল, সাবধানে চালাবা, এশার পরে সোজা বাড়ি চলে আসবা৷’ আমার যে কি খুশি সেদিন৷ তারপরে তো শুধুই স্মৃতি তৈরি৷ কত জায়গায় গেলাম, কত কিছু দেখলাম৷ সত্যি দারুন ছিল আমার প্রথম সাইকেলটা৷
তারপর দীর্ঘ চৌদ্দ বছর কেটে গেল, শহরের মাদরাসা ছেড়ে গ্রামে গেলাম। তারপর আবার শহরে এবং সবশেষে ঢাকায়৷ ২০১৪ পরিচয় হল আশরাফ ভাইয়ের সাথে, মিনার মসজিদ মাদরাসায়৷ তিনি একটা ক্যালিস সাইকেল চালাতেন, কুলটুল মডেলের৷ওই সাইকেলটা আমার দারুন লাগে, অনেক দামি আর আমি গরিব মানুষ কিভাবে কিনবো সে পায়তারা করতে লাগলাম৷
সেবার মাহমুদের সাথে বি-বাড়িয়াতে গেলাম ওর কাজিনের বিয়ের দাওয়াতে৷ ফিরছিলাম ১৬ ডিসেম্বর সকালে, যখন আমরা ধানমন্ডি স্টার কাবাবের সামনে এলাম তখন দেখলাম অনেক সাইক্লিস্ট স্টার কাবাবে ‘বিজয় রাইড’ দিয়ে নাস্তা করতে ঢুকছে৷ একসাথে এতগুলো লোকের এত সুন্দর সুন্দর বাইসাইকেল দেখে মাহমুদও ফিদা হয়ে গেল। আমিতো আরো আগে থেকেই৷ এদিকে আমাদের এ নেশা আরেক জনকেও পেয়ে বসল। তার নাম নাকীব কে৷ মোটামুটি তখন তিনজনের একটা টিম, নিজেদের ভিতরে আলাপ চলত কে কোন ধরনের সাইকেল পছন্দ করে সে নিয়ে৷
শুরুহল পুরাতন সাইকেলের খোঁজ, দামে কম যত হয়৷ ফেসবুক ভিত্তিক সাইকেল রিলেডেট যত গ্রুপ পেইজ আছে সব গুলাতে ঢু মারতে মারতে অবশেষে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লাম৷ নাকীব ওর বাসার লোকদেরকে রাজী করিয়ে ফেলল, ওর টাকাও ম্যানেজ হয়ে গেল৷ একদিন শুক্রবার বিকালে ধানমন্ডি ‘সাইকেল লাইফ এক্সক্লুসিভ(CLE)’ থেকে ও একটা ভেলোস লিজিয়ন টেন মডেলের একটা সাইকেল ১৩৫০০দিয়ে কিনে নিয়ে এল৷ ও যখন কিনেছিল তখন ও ভালমতন চালাতে পারতো না৷ আমি মাহমুদ আর নাকীব তিনজনাই গিয়েছিলাম৷ মাহমুদ আর নাকীব রিক্সা করে বাড়ি ফিরল আর আমি নতুন সাইকেলে৷ আমার মনে মনে তখন খুব আফসোস হচ্ছিল, কারণ আমার সাইকেল নাই৷ তার দু সপ্তাহ পরে কিনলো মাহমুদ৷ ঐ একই দোকান থেকে, ও কিনলো ভেলোস লিজিয়ন ফোর্টি মডেলের, দাম পড়ল ১৭৫০০৷ মাহমুদও তখন ভাল চালাতে পারতোনা সুতরাং নতুন ঘোড়াটাকে চালিয়ে বাসায় আনার দায়িত্বটা এবারও আমার৷
মাহমুদ নাকীব দুজনার কেউই তখনো ভালমতন চালাতে পারতোনা, মেইন রোডে তো নয়ই৷ অবশেষে আমি অধম ওদেরকে উত্তমরুপে সাইকেল আয়ত্ব করানোর দায়িত্ব নিলাম৷ এলাকার গলিতে বিকাল হলেই ওদেরকে সাইলেক চালানো শিখাতাম৷ নাকীবের আগে মাহমুদ মোটামুটিভাবে আয়ত্ব করতে পারলো৷
শুরুহল আমার আর মাহমুদের চক্করবাজী, মাহমুদ নিজের সাইকেলে আর আমি নাকীবেরটা নিতাম৷ এভাবে কিছুদিন গেল, মন মানলোনা অবশেষে ধার-কর্জ করে কিনে ফেললাম একটা৷ সেইম মডেলের মানে ‘ভেলোস লিজিয়ন ফোর্টি’, তারপর বাকিটা ইতিহাস৷
আমি আর মাহমুদ যখন চক্করবাজী দিয়ে পুরা ঢাকা চষে বেড়াচ্ছিলাম কয়েক ঘন্টার ভিতরে তখন আমাদের সার্কেলের আরো কয়েকজনার বাসা থেকে টি এস সি আসতেই তত সময় লাগলো৷ মানে তানভীরের কথা বললাম আরকি৷
তানভীরের দলে আরেকজনও ছিল, নাম মাহবুব৷কেউই সাইকেল চালাতে পারতো না৷ এবার টার্গেট নিলাম ওদেরকেও শেখাবো৷ প্রতিদিন সকালে আমার প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু হত বেলা দশটা নাগাদ৷ এলাকার গলিতেই৷ কোন কোন দিন আমরা চলে যেতাম ঢাকা উদ্দ্যান কোনদিন আবার সোহরাউর্দি উদ্দ্যানে, শিখাতাম ওরা মাহবুব, তানভীর শিখতো৷
এবার মাহবুবের আগে তানভীর ভালভাবে রপ্ত করতে পারলো, সাইকেল কেনা ওর জন্য এবার ফরজ হয়ে গেল৷ ও একটা আপল্যান্ড ভ্যানগার্ড হান্ড্রেড কিনলো লায়ন সাইকেল স্টোর ধানমন্ডি ব্রাঞ্চ থেকে, দাম পড়ল ২৩৫০০৷ এর সপ্তাহ খানেকের ভিতরেই মাহদীও কিনলো একটা আপল্যান্ড৷ আমাদের টিমে তখন ৬ সদস্য, আমি মাহমুদ তানভীর মাহদী আশরাফ ভাই আর নাকীব৷ মাহদী খুব বেশী একটা বাসা থেকে বের হতনা৷ ওকে নিয়ে আমাদের দুরে যাওয়া বলতে শুধুমাত্র জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, আর এদিকে ভাকুর্তা পর্যন্ত৷
আওয়ার ইসলাম টোয়েন্টিফোর ডটকম / আরআর