|| মুফতি মুহাম্মাদ জাকারিয়া ||
ঈদ মুসলিম উম্মাহর জাতীয় উৎসব। ঈদুল ফিতরের দিন প্রতিটি মুসলমানের জীবনে অশেষ তাৎপর্য ও মহিমায় অনন্য। রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানের সিয়াম সাধনার শেষে শাওয়ালের এক ফালি উদিত চাঁদ নিয়ে আসে পরম আনন্দ ও খুশির ঈদের আগমনী বার্তা।
‘ঈদ’ শব্দটি আরবি, শব্দ মূল ‘আউদ’, এর অর্থ এমন উৎসব যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়। এর অন্য অর্থ খুশি-আনন্দ। উচ্ছল-উচ্ছ্বাসে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত।
ঈদ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মুসলিম উম্মার জন্য বড় উপহার তাই মুমিনের কর্তব্য হল, পবিত্র ঈদের দিনে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পূণ্য ও কল্যাণ প্রাপ্তির জন্য আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের বাতলানো পথে ঈদ উদযাপন করা। ঈদ আনন্দ উৎসব উদযাপনের নামে বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচার অনুসরণে পাপ এবং গর্হিত কাজে লিপ্ত না হওয়া।
■ ইসলামে ঈদের সূচনা
عَنْ أَنَسٍ، قَالَ قَدِمَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الْمَدِينَةَ وَلَهُمْ يَوْمَانِ يَلْعَبُونَ فِيهِمَا فَقَالَ " مَا هَذَانِ الْيَوْمَانِ " . قَالُوا كُنَّا نَلْعَبُ فِيهِمَا فِي الْجَاهِلِيَّةِ . فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " إِنَّ اللَّهَ قَدْ أَبْدَلَكُمْ بِهِمَا خَيْرًا مِنْهُمَا يَوْمَ الأَضْحَى وَيَوْمَ الْفِطْرِ " .
আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত-
তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাদীনাহ্তে এসে দেখেন মাদীনাহ্বাসীরা নির্দিষ্ট দু’টি দিনে খেলাধূলা ও আনন্দ করে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করলেনঃ এ দু’টি দিন কিসের? সকলেই বললো, জাহিলী যুগে আমরা এ দু’ দিন খেলাধূলা করতাম। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, মহান আল্লাহ তোমাদের এ দু’ দিনের পরিবর্তে উত্তম দু’টি দিন দান করেছেন। তা হলো, ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিত্বরের দিন। সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ১১৩৪
■ যেভাবে আপনি ঈদ উদযাপন করবেন
১.সাধ্য অনুযায়ী ঈদের রাতে ইবাদত বান্দেগী করা। রাসুল সা ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সওয়াবের আশায় দুই ঈদের রাতে ( ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা) জাগ্রত থেকে ইবাদত- বান্দেগী করবে, তার কলব সেদিন (কঠিন কিয়ামতের দিন) মরবে না (নিস্তেজ হবে না) । যেদিন ( ভয়াবহ পরিস্থিতির কারণে) সমস্ত কলব মারা যাবে ( নিস্তেজ হয়ে যাবে)। সুনানে ইবনে মাজাহ ১/১২৭, হাদীস : ১৭৮২, বায়হাকী – শুআবুল ঈমান, হাদীস :৩৭১১
২.খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা।
৩. গোসল করা ।
৪.সামর্থ্য থাকলে নতুন পোশাক পরিধান করা।তা সম্ভব না হলে ব্যবহৃত পোশাকের মধ্যে উত্তম পোশাক পরিধান করা।
৫. খুশবু ব্যবহার করা।
৬. ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে খুরমা অথবা খেজুর খাওয়া এবং বিজোড় সংখ্যক খাওয়া। খুরমা -খেজুর না থাকলে অন্য কোন মিষ্টি দ্রব্য খাওয়া।
৭.ঈদের নামাজ ঈদগাহে পড়া। ওজর থাকলে মসজিদে আদায় করা যাবে।
৮. ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া।
৯. ঈদগাহে এক রাস্তায় যাওয়া এবং অন্য রাস্তায় ফিরে আসা।হাদিসে বর্ণনা করা হয়েছে, 'নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন' (সহিহ বুখারি: ৯৮৬)
১০.অসহায়দের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করা। এবং ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সদাকায় ফিতর আদায় করা।
، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ فَرَضَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم زَكَاةَ الْفِطْرِ طُهْرَةً لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ وَطُعْمَةً لِلْمَسَاكِينِ مَنْ أَدَّاهَا قَبْلَ الصَّلاَةِ فَهِيَ زَكَاةٌ مَقْبُولَةٌ وَمَنْ أَدَّاهَا بَعْدَ الصَّلاَةِ فَهِيَ صَدَقَةٌ مِنَ الصَّدَقَاتِ .
ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সদাক্বাতুল ফিতর ফরয করেছেন- অশ্লীল কথা ও বেহুদা কাজ হতে (রমাযানের) সওমকে পবিত্র করতে এবং মিসকীনদের খাদ্যের ব্যবস্থার জন্য। যে ব্যক্তি (ঈদের) সলাতের পূর্বে তা আদায় করে সেটা কবুল সদাক্বাহ গণ্য হবে। আর যে ব্যক্তি সলাতের পরে আদায় করে, তা সাধারণ দান হিসেবে গৃহীত হবে।
সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ১৬০৯
■ ঈদে আমাদের যা বর্জনীয়
১.ঈদের দিন রোজা পালন করা:
ঈদের দিন রোজা পালন করলে ঈদের দিনের কাজসমূহ যথাযথ পালন করা যাবে না। সেজন্য হাদিসে ঈদের দিন রোজা পালন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এসেছে। সহিহ বোখারি ও মুসলিমে বর্ণিত আছে, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ সা. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন।’ সহিহ মুসলিম: ২৭৩০
২.বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন:
বিজাতীয় আচরণ মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে গান-বাজনা করা, অশ্লীল সিনেমা ও নাটক দেখা- যা ইসলাম অনুমোদন করে না, তা থেকে বিরত থাকতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَشۡتَرِي لَهۡوَ ٱلۡحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ ٱللَّه
(لقمان: ٦
‘মানুষের মাঝে কেউ কেউ এমন আছে যে আল্লাহর রাস্তা (ইসলাম) থেকে বিচ্যুত করার জন্য অসার কথা খরিদ করে’
সূরা লুক্বমান, আয়াত: ৬
ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আল্লাহর কসম করে বলেছেন, উক্ত আয়াতে ‘অসার কথা’ বলতে গানকে বুঝানো হয়েছে।
৩.বেহুদা কাজে সময় ব্যয় করা:
অনেকে বেহুদা কাজে ঈদে রাত জাগরণ ও দিনে বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করে থাকে। সেজন্য বেহুদা কাজে সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকা দরকার। কোরআনে মুমিনের গুণাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর যারা অনর্থক কথা-কর্ম থেকে বিমুখ থাকে। সূরা মুমিনুন: ০৩
৪.অপচয় ও অপব্যয় করা:
ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে এ উপলক্ষে সব কিছুতেই অপচয় ও অপব্যয় করা হয়। অথচ কোরআনে বলা হয়েছে, আর তোমরা কোনভাবেই অপব্যয় করো না, নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। -সূরা বনি ইসরাঈল: ২৬-২৭
৫.জুয়া খেলা ও আতশবাজি:
এগুলো শরিয়ত বিরোধী কাজ। আল্লাহ-তায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ, নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা-বেদী ও ভাগ্য-নির্ধারক তীরসমূহ তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। সূরা মায়িদা: ৯০
■ ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়
মুসলিম পরস্পরে সাক্ষাৎ হলে একে-অপরকে সালাম দেবে- এটাই তো উত্তম আদর্শ। এরচেয়ে উত্তম আর কোনো অভিবাদন হতে পারে না।
তাছাড়া সালামের রয়েছে অনেক ফযীলত। যেমন, হাদীস শরীফে এসেছে, সালামের মাধ্যমে পরস্পরের মধ্যে মিল-মহব্বত পয়দা হয়, ঈমানের পূর্ণতা লাভ হয় এবং জান্নাতে দাখেল হওয়ার পথ সুগম হয়। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫১৯৩
অতএব আমাদের জন্য শ্রেষ্ঠতম শুভেচ্ছা ও আদর্শ অভিনন্দন হল সালাম। এটাকে আমরা আঁকড়ে ধরব। সালামের বেশি বেশি প্রচলন ঘটাব, বিশেষ করে ঈদ ও অন্যান্য আনন্দের মুহূর্তগুলোতে।
সালামের পর আমরা একে-অপরের জন্য দুআ করতে পারি। ঈদের দিন সাক্ষাৎ হলে রাসূলের সাহাবীগণ যে শব্দ-বাক্যের মাধ্যমে একে-অপরের জন্য দুআ করতেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও শিক্ষণীয়। এতেই নিহীত আছে- মুসলিমের প্রকৃত ঈদ ও খুশি কী এবং কীসের মাধ্যমে ঈদ-আনন্দ পূর্ণতা লাভ করে এবং কীসে সফলতা ও কল্যাণ। আর তা হল, আল্লাহর কবুলিয়াত; তাঁর দরবারে আমাদের আমল কবুল হওয়া এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভ হওয়া। তাই তো সাহাবীগণ সবাই সবার জন্য এই কবুলিয়াতের দুআই করতেন। সাঈদ ইবনে জুবায়ের রাহ. বলেন-
كان أصحاب رسول الله صلى الله عليه وآله وسلم إذا التقوا يوم العيد يقول بعضهم لبعض : تَقَبّلَ اللهُ مِنّا وَمِنْكُمْ.
ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরাম মিলিত হলে একে-অপরের উদ্দেশে বলতেন-
تَقَبّلَ اللهُ مِنّا وَمِنْكُمْ.
আল্লাহ কবুল করুন আমাদের থেকে এবং আপনাদের থেকে (সকল আমল)। -ফাতহুল বারী ২/৪৪৯; আলজাওহারুন্নাকী ৩/৩২০
লেখক: উস্তাজুল হাদিস, জামিয়া ইসলামিয়া হোসাইনিয়া (মাদ্রাসা) বরিশাল
কেএল/