|| নাজমুল হুদা মজনু ||
আমাদের সমাজে মানুষ মানুষকে এভাবে ভয় পায় যে, তারা যেন সাপ-বিচ্ছু, বাঘ-সিংহ; যেকোনো সময় দংশন অথবা হিংস্র থাবা বিস্তার করে আস্ত গিলে খাবে।
চার পাশে হাজারো অন্যায় অবিচার অসঙ্গতি দ্বন্দ্ব আর সংঘাত সত্ত্বেও আমরা নিশ্চল নির্বিকার নিরুদ্বেগ।
এর মূল কারণ আমরা কুরআন-সুন্নাহ বিমুখ। আমরা আল্লাহর হুকুম মানি না অথবা জানি না। অশুভ অনিষ্টতার আশঙ্কায় আমরা ভীতবিহ্বল। সতত সংশয় সন্দেহ আমাদেরকে তাড়া করে ফিরে। কিন্তু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে কী বলেছেন তা জানার উৎসাহ-উদ্দীপনা যেন নিস্তেজ নিঃশেষ।
আসলে আল্লাহ তায়ালা তৌফিক না দিলে কখনো কারো পক্ষে সম্ভব নয় কোনো নেক আমল করা। ভালো থাকা না থাকা সম্পূর্ণ আল্লাহর এখতিয়ার। তাই তো বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সা. দোয়া করতেন-
হে আল্লাহ! আমি আলস্য, অতি বার্ধক্য, ঋণ আর পাপ থেকে আপনার আশ্রয় চাচ্ছি। হে আল্লাহ! আমি আপনার আশ্রয় চাচ্ছি জাহান্নামের শাস্তি, জাহান্নামের ফিত্না, কবরের সঙ্কট, কবরের শাস্তি, প্রাচুর্যের ফিত্না ও অভাবের ফিত্না থেকে,
হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে মাসিহ দাজ্জালের ফিত্নার ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। হে আল্লাহ! আপনি আমার যাবতীয় গুনাহ বরফ ও শীতল পানি দিয়ে ধুয়ে দিন। আমার অন্তর যাবতীয় পাপ থেকে পরিচ্ছন্ন করুন, যেভাবে শুভ্র বস্ত্র ময়লা থেকে পরিচ্ছন্ন করা হয়। আমার ও আমার গুনাহসমূহের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে দিন যতটা দূরত্ব আপনি পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের মধ্যে করেছেন। (বুখারি-৬৩৭৫)
আল্লাহ তায়ালার হুকুম ছাড়া কোনো উপকার-অপকার করার কারো কোনো ক্ষমতা নেই। সুতরাং একমাত্র আল্লাহ তায়ালাকেই ভয় করতে হবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন-'হে আদম সন্তানরা (শুরুতেই আমি তোমাদের বলেছিলাম), যখনি তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে রাসূলরা আসবে, যারা তোমাদের কাছে আমার আয়াত পড়ে শোনাবে, তখন যারা (সে অনুযায়ী) আমাকে ভয় করবে এবং (নিজেদের) সংশোধন করে নেবে, তাদের কোনোই ভয় থাকবে না, তারা কখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হবে না।' (আল-আরাফ : ৩৫)
কুরআনুল কারিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেন, '(জেনে রেখো,) যদি আল্লাহ তায়ালা তোমাকে কোনো দুঃখে পৌঁছাতে চান তাহলে তিনি ছাড়া আর কেউই (তোমার থেকে) তা দূর করতে পারবে না; অপর দিকে তিনি যদি তোমার কোনো উপকার করেন তাহলে (কেউ তাতে বাধাও দিতে পারে না) তিনি সবকিছুর ওপর একক ক্ষমতাবান! (আল-আনয়াম : ১৭)
এ এই দুনিয়া বান্দাদের পরীক্ষার কেন্দ্র বানিয়েছেন মহীয়ান গরিয়ান সর্বশক্তিমান মহান রাব্বুল আলামিন। মুমিনদেরকে তিনি যেমনি পরীক্ষা নেন তেমনি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পথ ও পন্থা তিনিই প্রদর্শন করে দেন।
সুতরাং হতাশার পঙ্কে নিমজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কেননা মুমিন বান্দাদের তো এ বিশ্বাস বুকে ধারণ করতে হয় যে, আমাদের আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হবে। তাঁর অসীম দয়া ও ক্ষমা আমাদের প্রধান পাথেয়।
রাহমানুর রাহিম আল্লাহ জাল্লা শানুহু কুরআন মাজিদে বান্দাদেরকে কিছু ভয় ও আশা জাগানিয়া নির্দেশনা দান করেন। তাইতো তিনি মুমিনদের উদ্দেশে বলেন,
'আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব সামান্য ভয় ও ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে; আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও যাদের ওপর কোনো বিপদ এলে বলে, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’— নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর আর অবশ্যই আমরা তাঁর কাছে ফিরে যাবো।’ (সূরা বাকারাহ : ১৫৫-১৫৬)
আল্লাহ তায়ালা কারো প্রতি কখনো কোনো জুলুম করেন না। সহজ সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করে তিনি তাঁর হাবিবের উদ্দেশে বলেন,
(হে মুহাম্মদ,) তুমি (তাদের) বলে দাও, (এক) আল্লাহ তায়ালাকে বাদ দিয়ে তোমরা আর যাদের গোলামি করছো, আমাকে তাদের গোলামি করতে নিষেধ করা হয়েছে; তুমি (তাদের এও) বলে দাও, আমি কখনো তোমাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করি না, (তেমনটি করলে) আমি নিঃসন্দেহে গোমরাহ হয়ে যাবো এবং আমি আর সত্যের অনুসরণকারী দলের সাথে থাকব না। (আল-আনয়াম : ৫৬)
দ্বীনের দাওয়াত দিতে গিয়ে অনেকসময় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সংশয় দেখা দেয়; আর তখন আল্লাহ তায়ালাই দাঈদের অবিচল থাকতে সাহায্য করে সঠিক পথ বাতলে দেন।
পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন-সেসব লোকদের তুমি (আল্লাহর বিচারের জন্য) ছেড়ে দাও, যারা তাদের দ্বীনকে নিছক খেল-তামাশায় পরিণত করে রেখেছে এবং এ পার্থিব জীবন যাদের প্রতারণার জালে আটকে রেখেছে, তুমি এ (কুরআন) দিয়ে (তাদের আমার কথা) স্মরণ করাতে থাকো, যাতে করে কেউ নিজের অর্জিত কর্মকাণ্ডের ফলে ধ্বংস হয়ে যেতে না পারে, (মহাবিচারের দিন) তার জন্য আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোনো সাহায্যকারী বন্ধু এবং সুপারিশকারী থাকবে না ।
সে যদি নিজের সবকিছু দিয়েও দেয়, তবু তার কাছ থেকে (সে দিন তা) গ্রহণ করা হবে না; এরাই হচ্ছে সে (হতভাগ্য) মানুষ, যাদের নিজেদের অর্জিত গুনাহের কারণে তাদের ধ্বংস করে দেয়া হবে, আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকার করার কারণে তাদের জন্য (আরো থাকবে) ফুটন্ত পানি ও মর্মন্তুদ শাস্তি। (আল-আনয়াম : ৭০)
হাজারো প্রতিকূলতা ভেদ করে মুমিনের চলার পথ করুণাময় আল্লাহ তায়ালা নিজের দয়ায় সহজ করে দেন, সান্ত্বনা দিয়ে আশান্বিত করে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআন মাজিদে বলেন, 'আমি তো রাসূলদের (জান্নাতের) সুসংবাদবাহী ও (জাহান্নামের) সতর্ককারী ছাড়া অন্য কোনো হিসেবে পাঠাই না, অতঃপর যে ব্যক্তি (রাসূলদের ওপর) ঈমান আনবে এবং (তাদের কথা মতো) নিজেকে সংশোধন করে নেবে, এমন লোকদের (পরকালে) কোনো ভয় নেই এবং তাদের (সে দিন) কোনো রকম চিন্তিতও হতে হবে না। (আল-আনয়াম : ৪৮)
নিশ্চয় আল্লাহ খরিদ করে নিয়েছেন মু’মিনদের থেকে তাদের জান ও তাদের মাল এর বিনিময়ে যে, অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর পথে, কখনো হত্যা করে এবং কখনো নিহত হয়। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে এ সম্পর্কে সত্য ওয়াদা রয়েছে। আল্লাহর চেয়ে নিজের ওয়াদা অধিক পালনকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা আনন্দ কর তোমাদের সে সওদার জন্য যা তোমরা তাঁর সাথে করেছো। আর তা হলো বিরাট সাফল্য।
তারা তাওবাহকারী, ‘ইবাদতকারী, আল্লাহর প্রশংসাকারী, রোজাদার, রুকুকারী, সিজদাকারী, ভালো কাজের আদেশদাতা, মন্দ কাজে বাধা প্রদানকারী এবং আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা হিফাজতকারী; (এসব গুণে গুণান্বিত) মুমিনদেরকে তুমি সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। (আত-তাওবাহ : ১১১-১২)
তাওবাহ করে বান্দা যখন পাক-ছাফ হয়ে যায় তখন মহা দয়ালু আল্লাহ তায়ালা তাদের পুরস্কারের যে প্রতিশ্রুতি দান করেন তা বাস্তবায়ন করতে থাকেন। কুরআন মাজিদে বলা হয়েছে—
'আর যারা তাদের রবকে ভয় করেছে তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। অবশেষে তারা যখন সেখানে এসে পৌঁছবে এবং এর দরজাসমূহ খুলে দেয়া হবে তখন জান্নাতের রক্ষীরা তাদেরকে বলবে, ‘তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা ভালো ছিলে। অতএব স্থায়ীভাবে থাকার জন্য এখানে প্রবেশ করো’। (সূরা জুমার-৭৩)
লেখক : গবেষক, সাংবাদিক
এনএ/