|| নাজমুল হুদা মজনু ||
দুনিয়ার জমিনে মানুষের সবচেয়ে বড় পেরেশানি তার রিজিকের ব্যাপারে। বিভিন্নভাবে মানুষ রিজিকের অন্বেষণ করে থাকে। এ পথে চলতে গিয়ে মানুষ নানা রকম পন্থা অবলম্বন করে। সেই পথচলা কখনো শোভন আবার কখনো নিন্দনীয় হয়।
তবে মানুষ যদি তার সব সমস্যার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভর করে তাহলে সুন্দর সমাধান তার সন্নিকটে। আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য চাইলে যেমন বান্দার প্রতি আল্লাহ তায়ালা দয়া করেন তেমনি তা এবাদত হিসেবে গণ্য হয়। প্রতিটা মুমিনের জন্য জরুরি যে, সে সুখে-দুঃখে আল্লাহ তায়ালার পথে অবিচল থাকবে।
বান্দা যখন আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে তখন তার দীনতা-হীনতা প্রকাশ পায় আর দয়াময় আল্লাহ এতে খুশি হয়ে দুনিয়া ও আখেরাতে তাকে কল্যাণের পথ দেখান। অপর দিকে বান্দা যখন আল্লাহ তায়ালার কাছে হাত না পেতে মানুষের কাছে হাত পাতে তখন আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে সে দূরে সরে যায়।
মানুষের সব সমস্যার সমাধান রয়েছে আল্লাহ তায়ালার কালাম পবিত্র কুরআনুল কারিমে। প্রতিটি মুমিনের উচিত কালামুল্লাহ বেশি বেশি তিলাওয়াত করা এবং সে অনুযায়ী জীবন যাপন করা। কিন্তু মানুষের জ্ঞান ও আমলের সীমাবদ্ধতার কারণে সব মেনে চলা অনেকসময় সম্ভব হয় না।
এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো আল্লাহর তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এসব মুমিন সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যারা বলে, হে আমাদের মালিক, আমরা অবশ্যই তোমার ওপর ঈমান এনেছি, অতঃপর আমাদের (যা) গুনাহখাতা (আছে তা) তুমি মাফ করে দাও এবং (শেষ বিচারের দিন) তুমি আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচিয়ে দিয়ো। (আলে-ইমরান-১৬)
আল্লাহ তায়ালার আনুগত্য করার পাশাপাশি রাসূলুল্লাহ সা:-এর অনুসরণ করাও একান্ত প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর হাবিবের হাদিসে আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত—রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, সেই আল্লাহর শপথ, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তোমাদের কেউ প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষন না আমি তার কাছে তার পিতা ও সন্তানাদির চেয়ে অধিক ভালোবাসার পাত্র হই। (বুখারি-১৪)
এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাহাবা বুহাইলি রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা:কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, 'তোমরা কুরআন পড়ো, কারণ তা কিয়ামতের দিন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হয়ে আগমন করবে।' (মুসলিম)
মানুষ যখন আল্লাহ তায়ালার দরবার ছেড়ে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরে তখন সে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যায়। আর মানুষ যখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ছেড়ে দেয় তখন তার অহঙ্কার প্রকাশ পায়।
কুরআন মাজিদে বর্ণিত হয়েছে- আর তোমরা আল্লাহর ওপরই নির্ভর করো, যদি তোমরা মু'মিন হও। (সূরা আল-মায়িদা-২৩)
অনেক সময় দেখা যায় মানুষ মানুষকে ভয় পায়; অথচ মুমিনের উচিত আল্লাহ তায়ালাকেই ভয় করা। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, যে কেউ আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য (সমস্যা থেকে উত্তরণের) কোনো-না-কোনো পথ বের করে দেন। আর তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দান করবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। যে কেউ আল্লাহর ওপর ভরসা করে, তার জন্য তিনিই যথেষ্ট। আল্লাহ নিজের কাজ সম্পূর্ণ করবেনই। আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের জন্য নির্ধারণ করেছেন একটি সুনির্দিষ্ট মাত্রা। (সূরা আত-তালাক : ২-৩)
রিজিক সন্ধানের অপূর্ব এক বর্ণনা হাদিসে এসেছে - আব্দুর রহমান ইবনে আউফ থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমরা যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আসি, তখন আল্লাহর রাসূল সা: আমার এবং সা'দ ইবনু রাবি রা:-এর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টি করে দেন। পরে সা'দ ইবনু রাবি বললেন, আমি আনসারদের মধ্যে অধিক ধনাঢ্য। আমার অর্ধেক সম্পত্তি তোমাকে বন্টন করে দিচ্ছি এবং আমার উভয় স্ত্রীকে দেখে যাকে তোমার পছন্দ হয় বলো, আমি তাকে তোমার জন্য পরিত্যাগ করব।
যখন সে (ইদ্দত পূর্ণ করবে) তুমি তাকে বিয়ে করবে। আবদুর রহমান রা: তখন বললেন, এসবে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। বরং (আপনি বলুন) ব্যবসা-বাণিজ্য করার মতো কোনো বাজার আছে কি না? তিনি বললেন, কায়নুকার বাজার আছে।
পরদিন আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা: সে বাজারে গিয়ে পনীর ও ঘি (খরিদ করে) নিয়ে এলেন। এরপর ক্রমাগত যাওয়া-আসা করতে থাকেন। কিছুকাল পরে আবদুর রহমান রা:-এর কাপড়ে বিয়ের হলুদ রঙের চিহ্ন দেখা গেল। এরপর আল্লাহর রাসূল সা: তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বিয়ে করেছো?
তিনি বললেন, হ্যাঁ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, সে কে? তিনি বললেন, জনৈকা আনসারি মহিলা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী পরিমাণ মোহর দিয়েছ? আবদুর রহমান রা: বললেন, খেজুরের এক আঁটি পরিমাণ স্বর্ণ। নবী সা: তাঁকে বললেন, একটি বকরি দিয়ে হলেও ওয়ালিমা করো। (বুখারি-২০৪৮)
জীবন চলার পথে দেখা যায় মানুষ বড়ই তাড়াহুড়াপ্রবণ। অথচ ধৈর্যের ফলে মহান আল্লাহ অনেক নিয়ামত বান্দাকে দান করে থাকেন। এ-সংক্রান্ত অনেক ঘটনা আমরা বাস্তবে দেখতে পাই। এমনও দেখা যায়, জীবনে কখনো যে বিষয় নিয়ে কোনো চিন্তাও করা হয়নি আল্লাহ তায়ালা সেই অজানা উৎস থেকে রিজিক দান করেন।
তাই বলে ঘরে বসে থাকা যাবে না। হালাল রিজিক অন্বেষণ করা আল্লাহ তায়ালার হুকুম। আর বান্দার উচিত আল্লাহর হুকুম মান্য করা। আল্লাহ তায়ালার হুকুম মেনে রিজিকের অন্বেষণ করলে সেটিও এবাদত হিসেবে গণ্য হবে।
মহান আল্লাহ বলেন, সালাত শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলতা লাভ করতে পারো। (সূরা জুমুয়াহ-১০)
হাদিসে এ ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যদিও রিজিক প্রাপ্তি ধীরগতিতে হয়ে থাকুক না কেন, স্বীয় রিজিক ভোগ করা ব্যতীত কোনো প্রাণীই মৃত্যুবরণ করবে না। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুন্দররূপে রিজিক অন্বেষণ করো। হালাল রিজিক গ্রহণ করো এবং হারাম বস্তু ত্যাগ করো। (ইবনে মাজাহ-২১৪৪)
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও আল্লাহর হাবিবের ভালোবাসা দুনিয়া এবং আখেরাতে মুমিনের জন্য বড় পাথেয়। আল্লাহ জাল্লা শানহু কুরআন মাজিদে বলেছেন—
(হে নবী) তুমি বলো, তোমরা যদি আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবাসো, তাহলে আমার কথা মেনে চলো, (আমাকে ভালোবাসলে) আল্লাহ তায়ালাও তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তিনি তোমাদের গুনাহখাতা মাফ করে দেবেন; আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াবান।(আলে-ইমরান-৩১)
অনেকে চালাকি করে বলে যে, 'খাওদাও-ফুর্তি করো; পরে তাওবাহ করা যাবে!'
আল্লাহ তায়ালা তাওবার ব্যাপারে স্পষ্ট করে বলেছেন, 'আর তাদের জন্যে তাওবাহ (করার কোনো অবকাশই) নেই, যারা (আজীবন) শুধু গুনাহের কাজই করে, এভাবেই (গুনাহের কাজ করতে করতে) একদিন তাদের কারো (দুয়ারে) যখন মৃত্যু এসে হাজির হয়, তখন সে বলে (হে আল্লাহ), আমি এখন তাওবাহ করলাম, (আসলে) তাদের জন্যও (কোনো তাওবাহ) নয় যারা কাফের অবস্থায় ইহলীলা সাঙ্গ করল;
এরা হচ্ছে সেসব লোক, যাদের জন্য আমি কঠিন যন্ত্রণাদায়ক আজাবের ব্যবস্থা করে রেখেছি।' এ কারণে দ্রুত তাওবাহ করা উচিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
تُوۡبُوۡۤا اِلَی اللّٰهِ تَوۡبَۃً نَّصُوۡحًا ' অর্থাৎ, তোমরা খাঁটি তাওবাহ করো। (সূরা তাহরিম-৮)
বিশুদ্ধভাবে তাওবাহ করলে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেন। মানুষ তখন আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
দয়াময় আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় বান্দাদের নিয়ামতে ভরপুর জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আমােদ প্রমোদের জন্য 'সেখানে থাকবে আনতনয়না রমণীরা, যাদের কোনাে জিন ও মানুষ ইতঃপূর্বে স্পর্শ করেনি।'
লাবণ্যময়ী ও এত রূপবতী- 'যেন তারা প্রবাল ও পদ্মরাগ সদৃশ রমণী।' এসবই আল্লাহভীরু বান্দার জন্য পুরস্কার, যে এমনভাবে আল্লাহর এবাদত করেছে যেন তাকে দেখতে পেত অথবা অনুভব করত যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে দেখছেন। এভাবে তারা ইহসানের স্তরে পৌঁছেছে।
বস্তুত রাসূলুল্লাহ সা: ইহসানের সংজ্ঞা এভাবেই দিয়েছেন। ফলে তারা তাদের ইহসানের বিনিময়ে আল্লাহর কাছ থেকেও ইহসান তথা বিপুল প্রতিদান পাবে। 'ইহসানের প্রতিদান কি ইহসান ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে!' (সূরা-আর-রহমান)
লেখক : সাংবাদিক
এনএ/