রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ ।। ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ ।। ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় দ্রুত নির্বাচনের বিকল্প নেই: তারেক রহমান জমিয়তের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হলেন শায়খ মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলন আগামীকাল মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরীর ইন্তেকালে চরমোনাই পীরের শোক প্রকাশ জমিয়ত সভাপতি মাওলানা মনসুরুল হাসান রায়পুরী রহ.-এর বর্ণাঢ্য জীবন কওমি সনদকে কার্যকরী করতে ছাত্রদল ভূমিকা রাখবে: নাছির বড় ব্যবধানে জিতে প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে যাচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা আইফোনে ‘টাইপ টু সিরি’ ফিচার যেভাবে ব্যবহার করবেন  স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক: ধর্ম উপদেষ্টা আল্লাহকে পেতে হলে রাসূলের অনুসরণ অপরিহার্য: কবি রুহুল আমিন খান

শবে মেরাজ: করণীয় ও বর্জনীয়

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার
ফাইল ছবি

|| মাওলানা মুনীরুল ইসলাম || 

শবে মেরাজ শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি বিশেষ মোজেযা ও সম্মাননা। কারণ আর কোনো নবী-রাসুলের মেরাজ হয়নি।

মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল নবুওয়তের ১১তম বছরের ২৭ রজবে। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বয়স ৫১ বছর। মেরাজ হয়েছিল সশরীরে জাগ্রত অবস্থায়। মেরাজের বিবরণ পবিত্র কুরআনের সুরা নাজমে ও সুরা ইসরায় বিবৃত হয়েছে। হাদিসের কিতাব বোখারি শরিফ, মুসলিম শরিফ ও সিহাহ সিত্তাসহ অন্যান্য কিতাবে মেরাজের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য বিশুদ্ধ সূত্রে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘শপথ নক্ষত্রের যখন তা বিলীন হয়। তোমাদের সাথী ( মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বিপথগামী হননি এবং বিভ্রান্ত হননি। আর তিনি নিজে থেকে কোনো কথা বলেন না। (বরং তিনি যা বলেন) তা প্রদত্ত ওহি (ভিন্ন অন্য কিছু) নয়। তাকে শিখিয়েছেন মহাশক্তিধর (জিবরাইল আ.)। সে (জিবরাইল আ.) পাখাবিশিষ্ট, সে স্থিত হয়েছে দূর ঊর্ধ্বে।

অতঃপর নিকটবর্তী হলো, পরে নির্দেশ করল। তারপর হলো দুই ধনুকের প্রান্তবর্তী বা আরও নিকট। পুনরায় তিনি ওহি করলেন তার বান্দার প্রতি যা তিনি ওহি করেছেন। ভুল করেনি অন্তর যা দেখেছে। তোমরা কি সন্দেহ করছ তাকে, যা তিনি দেখেছেন সে বিষয়ে। আর অবশ্যই দেখেছেন তিনি তাকে দ্বিতীয় অবতরণ স্থলে; সিদরাতুল মুনতাহার কাছে; তার নিকটেই জান্নাতুল মাওয়া। যখন ঢেকে গেল সিদরা যা ঢেকেছে; না দৃষ্টিভ্রম হয়েছে আর না তিনি বিভ্রান্ত হয়েছেন; অবশ্যই তিনি দেখেছেন তাঁর রবের বড় বড় নিদর্শনসমূহ।’ -সুরা নাজম : ১-১৮ 


মেরাজ অর্থ ঊর্ধ্বগমন। পরিভাষায় মেরাজ হলো, মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক সশরীরে সজ্ঞানে জাগ্রত অবস্থায় হজরত জিবরাইল আ. ও হজরত মিকাইলের (আ.) সঙ্গে বিশেষ বাহন বোরাকের মাধ্যমে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা হয়ে প্রথম আসমান থেকে একে একে সপ্তম আসমান এবং সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত এবং সেখান থেকে একাকী রফরফ বাহনে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ; মহান রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভ ও জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করে ফিরে আসা। 

মেরাজের একটা অংশ হলো ইসরা। ইসরা অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। যেহেতু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেরাজ রাত্রিকালে হয়েছিল, তাই এটিকে ইসরা বলা হয়। বিশেষত বায়তুল্লাহ শরিফ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফরকে ইসরা বলা হয়ে থাকে। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি পবিত্র (আল্লাহ) যিনি তার বান্দাকে রাত্রিভ্রমণ করিয়েছেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার আশপাশ আমি বরকতময় করেছি। যাতে আমি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখাতে পারি। নিশ্চয় তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ -সুরা বনি ইসরাইল : ১

মেরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করেছেন। এ সময় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিভিন্ন অপরাধের শাস্তি দেখানো হয়। এ রাতে উম্মতের ওপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ ঘোষণা করা হয়। মেরাজের রজনীতে হাবিব ও মাহবুবের একান্ত সাক্ষাতে ১৪টি বিষয় ঘোষণা হয়েছে।

যথা ১. আল্লাহকে ছাড়া কারও ইবাদত করবে না, ২. পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে, ৩. নিকট স্বজনদের তাদের অধিকার দাও; ৪. মিসকিনদের ও পথসন্তানদের (তাদের অধিকার দাও); ৫. অপচয় করো না, অপচয়কারী শয়তানের ভাই, ৬. কৃপণতা করো না, ৭. সন্তানদের হত্যা করবে না, ৮. ব্যভিচারের নিকটেও যেও না, ৯. মানব হত্যা করো না, ১০. এতিমের সম্পদের কাছেও যেয়ো না, ১১. প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করো, ১২. মাপে পূর্ণ দাও, ১৩. অবস্থান করো না যাতে তোমার জ্ঞান নেই, ১৪. পৃথিবীতে গর্বভরে চলো না। এ সবই মন্দ, তোমার রবের কাছে অপছন্দ। -সুরা বনি ইসরাইল : ২২-৪৪ 

শবে মেরাজকে কেন্দ্র করে আমাদের সমাজে বেশ কিছু প্রচলনসহ বিশেষ নামাজ ও রোজা রাখার প্রথাও প্রচলিত রয়েছে। শবে মেরাজ উপলক্ষে কোনো নামাজ বা রোজার বিধান কি আসলেই ইসলামে রয়েছে? ইসলাম কী বলে? 

অনেককে শবে মেরাজ উপলক্ষে বিশেষ নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে সমবেত হতে দেখা যায়। বহু নারীও সেই রাতে নামাজ আদায় করার পদ্ধতি কী জানতে চান। বহু মুসলমান এই রাত উপলক্ষে মেরাজের রোজা রাখতে চান বা রাখার বিধান জানতে চান। নামাজ আদায় করা ও রোজা রাখা অবশ্যই পুণ্যের কাজ। কিন্তু শবে মেরাজ উপলক্ষে বিশেষ কোনো নামাজ ও রোজার বিধান ইসলামি শরিয়তে নেই। এ ব্যাপারে আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি রহ. তৎপ্রণীত লাতায়েফ ও মাআরেফ গ্রন্থে বলেন, ‘রজব মাসের সঙ্গে সম্পর্কিত বিশেষ কোনো নামাজ নেই। রজব মাসের প্রথম জুমায় সালাতুর রাগায়েব প্রসঙ্গে যেসব হাদিস বর্ণিত হয়েছে সেগুলো ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও বানোয়াট।’ 

অধিকাংশ আলেমের মতে, শবে মেরাজ উপলক্ষে নামাজ বিদআত। পরবর্তী যুগের আলেমগণের মধ্যে যারা এই মত ব্যক্ত করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আবু ইসমাঈল আনসারি, আবু বকর সামআনি, আবুল ফযল ইবনে নাসির ও আবুল ফারায ইবনে জাওযি রহ.সহ আরও অনেক আলেম।

শবে মিরাজ উপলক্ষে সুনির্দিষ্ট কোনো নামাজ আল্লাহর রাসুলের হাদিসের মাধ্যমে অথবা সাহাবিদের আমলের মাধ্যমে অথবা তাবেয়িদের আমলের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়নি। এ রাতের কোনো ইবাদত আল্লাহর রাসুলের কোনো হাদিসের মাধ্যমে সাব্যস্ত হয়নি। ভিন্ন কোনো নামাজ, বিশেষ কোনো নামাজ আদায় করার কোনো প্রয়োজন নেই। অন্যান্য রাতের মতোই এ রাতে নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে পারেন। সেটা স্বাভাবিক নিয়ানুযায়ী আগে যেভাবে আদায় করতেন সেভাবেই আদায় করবেন। 

আবার অনেক মুসলিম ভাই ও বোনেরা শবে মেরাজ উপলক্ষে ১২ রাকাত, কেউ ২০ রাকাত নামাজ আদায় করেন। ইসলামি শরিয়তেও শবে মেরাজের নামাজ বলে কিছু নেই। নফল নামাজ পড়া সওয়াবের কাজ কিন্তু শবে মেরাজ উপলক্ষে নফল নামাজ আদায়ের কোনো ভিত্তি ও প্রমাণ ইসলামে নেই। কাজেই শবে মেরাজের নামে নফল নামাজ আদায় করা এবং এর ব্যবস্থা প্রণয়ন করা মানে ইসলামি শরিয়তে নিজের পক্ষ থেকে কিছু সংযোজন করা। আর এ ব্যাপারে আল্লাহর  রাসুল বলেছেন, যে আমাদের ধর্মে এমন কিছু সংযুক্ত বা উদ্ভাবন করবে, যা তার (শরিয়তের) অংশ নয়- তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (সহিহ বোখারি: ১/৩৭১)

আমাদের অনেক মুসলিম ভাই ও বোনেরা শবে বরাত ও শবে কদরের সঙ্গে মিলিয়ে শবে মেরাজেও নফল রোজা রেখে থাকেন। একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য- নফল রোজা যখন ইচ্ছা তখন রাখা যায় কিন্তু কোনো উপলক্ষে নফল রোজা রাখতে হলে অবশ্যই আগে জেনে নিতে হবে, আমি বা আমরা যে উপলক্ষে নফল রোজা রাখছি শরিয়ত সেটাকে অনুমতি দিয়েছে কিনা। 

শবে মেরাজ উপলক্ষে নফল রোজা রাখার কোনো বর্ণনা কুরআন-হাদিসের কোথাও নেই। আল্লাহর রাসুল ও তার অনুসারীরা এই দিনে বিশেষভাবে কোনো রোজা রেখেছেন এমনে কোনো বর্ণনা ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই এই দিনে শবে মেরাজ উপলক্ষে রোজা রাখা কোনো ইবাদত হিসেবে গণ্য হবে না। সুতরাং শবে মেরাজ উপলক্ষে আলাদা বিশেষ নামাজ-রোজা আদায় করা থেকে বিরত থাকা উচিত এবং এটাই প্রকৃত মুসলিমের পরিচয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সঠিক বুঝ দান করুন।

লেখক: সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী লেখক ফোরাম

এনএ/


সম্পর্কিত খবর


সর্বশেষ সংবাদ