কাশ্মীরের পেহেলগামে সশস্ত্র হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে ভারত। পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানাতে ইসলামাবাদও দেরি করেনি। পাকিস্তান এরই মধ্যে বৃহৎ প্রতিবেশীর জন্য নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে, যা কিনা ভারতীয় এয়ারলাইনসের জন্য আর্থিক ও কারিগরি দিক থেকে বড় ধরনের ধাক্কা হতে পারে, এমন আশঙ্কা জানিয়েছেন দেশটির খাতসংশ্লিষ্টরা। খবর দ্য হিন্দু।
পাকিস্তানের আকাশসীমা ভারত বিশেষ করে উত্তর ভারতের শহরগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন দিল্লি থেকে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং এমনকি যুক্তরাষ্ট্রমুখী ফ্লাইটের জন্য পকিস্তানের আকাশ গুরুত্বপূর্ণ একটি করিডোর। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিকল্প রুটে চলাচলের কারণে ভারতীয় এয়ারলাইনসগুলো ক্ষতির মুখে পড়বে, যাত্রীদের গুনতে হবে বাড়তি ভাড়া।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্রিসিল মার্কেট ইন্টেলিজেন্সের সিনিয়র ডিরেক্টর জগন্নারায়ণ পদ্মনাভ বলেন, ‘আকাশসীমা বন্ধ হওয়ায় ভারতীয় এয়ারলাইনসকে বিকল্প দীর্ঘ রুট ব্যবহার করতে হচ্ছে। ফলে ফ্লাইট সময় ও জ্বালানি খরচ বাড়ছে। বিশেষ করে পশ্চিমমুখী দীর্ঘ রুট বেশি প্রভাবিত হচ্ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘কিছু যুক্তরাষ্ট্রগামী ফ্লাইটে জ্বালানির জন্য অতিরিক্ত বিরতি এবং গন্তব্যে পৌঁছতে বেশি সময় লাগতে পারে, যা পরিচালন খরচ অনেকটা বাড়িয়ে দেবে।’
উড়োজাহাজ শিল্প বিশেষজ্ঞ এবং ফ্লাই নাইনটিওয়ানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মনোজ চাকো বলেন, ‘পাকিস্তানের আকাশসীমা নির্ভর না হয়ে অন্য রুট দিয়ে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করা সম্ভব। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আমেরিকার ফ্লাইট বড় চ্যালেঞ্জ হবে না। কিন্তু কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট স্টেটসভুক্ত (সিআইএস) দেশের ফ্লাইট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে।’
পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ হওয়ায় ভারতীয় এয়ারলাইনসের মধ্যে এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানান পরামর্শক সংস্থা মার্টিন কনসাল্টিংয়ের সিইও মার্ক ডি মার্টিন। তিনি বলেন, ‘রক্ষণশীল হিসেবে ধরলে মধ্যপ্রাচ্যগামী টিকিটের দাম কমপক্ষে ৩৫ এবং ইউরোপগামী টিকিটের দাম ৪০ শতাংশের বেশি বাড়বে। পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ ও জ্বালানি খরচও বাড়বে।’
মার্ক ডি মার্টিন আরো বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে সবসময়ই উড়োজাহাজ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবারের পরিস্থিতিও এয়ারলাইনসের আয়ে প্রভাব ফেলবে।’
এরই মধ্যে এয়ার ইন্ডিয়া জানিয়েছে, উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু ফ্লাইটকে বিকল্প দীর্ঘ রুট ব্যবহার করতে হচ্ছে। মাইক্রো ব্লগিং সাইট এক্সে দেয়া এক পোস্টে এয়ার ইন্ডিয়া বলছে, আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঘটে যাওয়া এ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য যাত্রীদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করছি।
অন্যদিকে ইন্ডিগো বলেছে, পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধের কারণে আমাদের কিছু আন্তর্জাতিক ফ্লাইট প্রভাবিত হয়েছে। আমরা বুঝতে পারছি এতে যাত্রীদের অসুবিধা হতে পারে। আমাদের টিম সে অসুবিধা কমিয়ে আনতে প্রাণপণে কাজ করছে।
প্রতিবেশীর আকাশসীমা বন্ধ হওয়া ভারতের জন্য নতুন কোনো ঘটনা নয়। ২০১৯ সালের বালাকোট এয়ারস্ট্রাইকের পরও একই অভিজ্ঞতা হয়েছিল দেশটির এয়ারলাইনসগুলোর। তখন উপসাগরীয় অঞ্চল, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাগামী ফ্লাইটগুলো প্রভাবিত হয়েছিল।
প্রতিবেদন অনুসারে, দীর্ঘ ফ্লাইট সময়, বেশি জ্বালানি খরচ ও সীমিত ফ্লাইট সক্ষমতার কারণে ২০১৯ সালে ভারতীয় এয়ারলাইনস শিল্প বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ে। বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আন্তর্জাতিক পরিষেবা দেয় এমন বড় প্রতিষ্ঠানগুলো। ওই সময় রাষ্ট্রায়ত্ত এয়ার ইন্ডিয়ার দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬ কোটি রুপি। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপগামী অনেক ফ্লাইটের যাত্রীদের একত্রে বহন করত এয়ার ইন্ডিয়া। দিল্লি-ওয়াশিংটন ফ্লাইট প্রথমে মুম্বাই গিয়ে থামত, এরপর দীর্ঘ রুট হয়ে চূড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছত। এ সময় দিল্লি-নাজাফ, দিল্লি-মাদ্রিদ, দিল্লি-বার্মিংহাম ও দিল্লি-অমৃতসর-বার্মিংহাম ফ্লাইট বাতিল হয়।
শিল্পসংশ্লিষ্টদের মতে, এবার পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধের আর্থিক আঘাত ২০১৯ সালের তুলনায় আরো ‘মারাত্মক’ হতে পারে। কারণ এখন ভারতীয় এয়ারলাইনসগুলোর আন্তর্জাতিক কার্যক্রম অনেক বড় এবং ভবিষ্যতে আরো সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
দিল্লি বিমানবন্দরকে একটি আন্তর্জাতিক হাব হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। চলমান পরিস্থিতি সে পরিকল্পনাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে বলে মত বিশ্লেষকদের।
এ পরিস্থিতিতেও কিছু এয়ারলাইনস প্রতিনিধি এবং ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (এমসিএ) আত্মবিশ্বাসী। তারা বলছেন, ২০১৯ সালের অভিজ্ঞতা এবারের পরিস্থিতি সামাল দিতে সহায়ক হবে।
২০১৯ সালে উত্তর ভারত থেকে ইউরোপ ও আমেরিকাগামী ফ্লাইট মুম্বাই হয়ে আরব সাগর দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) আকাশপথে প্রবেশ করত। তখন ইউএইর শারজা ও অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাকে ভারতীয় ফ্লাইট পরিচালনার জন্য টেকনিক্যাল স্টপ তৈরি করা হয়েছিল।
পেহেলগামে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে ২২ এপ্রিল। ওই হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হন। এ ঘটনায় দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামে একটি সংগঠন দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি ভারতীয় গণমাধ্যম ও নিরাপত্তা সংস্থার। টিআরএফের পেছনে পাকিস্তানের সমর্থন আছে বলে অভিযোগ নয়াদিল্লির। যদিও ইসলামাবাদ এ দাবি উড়িয়ে দিয়েছে। এতে নয়াদিল্লি সিন্ধু পানি বণ্টন চুক্তি স্থগিতসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ার পর পাল্টা পদক্ষেপ নেয় ইসলামাবাদ। বাণিজ্য ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্থগিত এবং ভারতীয় উড়োজাহাজের জন্য আকাশসীমা বন্ধের ঘোষণা দেয় পাকিস্তান।
এনএইচ/