মাওলানা গোলাম মুহাম্মদ বুস্তানবী রহ. যেন একটি প্রতিষ্ঠান
প্রকাশ: ০৫ মে, ২০২৫, ০৭:৪২ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

|| তাওহীদ আদনান ইয়াকুব ||

সাধারণত যে কোনো মহান ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে বলা হয়—তিনি একাই একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন। এর অর্থ এই যে, তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল বহুমাত্রিক, তিনি ছিলেন বহু গুণের অধিকারী। তিনি কেবলএকটি ক্ষেত্রের নয়, বরং একাধিক ক্ষেত্রে দক্ষতা ও অবদান রেখেছিলেন। 

সাধারণত কর্মময় এই দুনিয়ায় মানুষ একসঙ্গে একাধিক কাজ করতে পারে না। বিশেষত বর্তমান যুগটিকে ‘স্পেশালাইজেশনের যুগ’ বলা হয়। এই যুগে যদি কাউকে সর্বোচ্চ সাফল্যে পৌঁছাতে হয়, তাহলে তাকে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র এবং একক লক্ষ্য নির্বাচন করতে হয়। অন্যথায়, ব্যর্থতাই সঙ্গী হয়।

তবে কিছু আল্লাহপ্রদত্ত যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ থাকেন, যাদের ব্যক্তিত্ব সত্যিকার অর্থেই বহুমুখী হয়। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁরা নিজেদের উপস্থিতি ও প্রভাব অনুভব করিয়ে যান। যেকোনো ময়দানেই তাঁরা যেন বলেন—

“যারা ময়দানে অবিচল ছিল, তাদের কাতারেই আমাকে খুঁজো।”

তাঁদের স্বভাব এমন যে—

“যেখানে আলো কম ছিল, সেখানেই একটি প্রদীপ জ্বেলে দিয়েছেন।”

হযরত মাওলানা গোলাম মুহাম্মদ বুস্তানবী রহ. ছিলেন এমনই এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন মাদ্রাসা থেকে শিক্ষালাভকারী ঐতিহ্যবাহী আলেম, তাসাউফের তরবিয়তের অধিকারী। কিন্তু বাস্তব জীবনে তিনি সেই ঐতিহ্যকে অতিক্রম করে সময়োপযোগী রূপরেখা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন—ভারতে আমাদের সামনে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে—

১. দ্বীনের হিফাজত (রক্ষণাবেক্ষণ)।

২. দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় মুসলিমদের অংশগ্রহণ।

দ্বীনের হেফাজতের জন্য দরকার দ্বীনী শিক্ষা, আর দেশের ব্যবস্থার মধ্যে বসবাসের জন্য এবং সমাজে সম্মানের সাথে টিকে থাকার জন্য দরকার আধুনিক শিক্ষাও। এই উপলব্ধি থেকেই তিনি একটি ছোট মাদ্রাসা শুরু করেন, যেখানে ছোট ছোট শিশুদের কুরআন শেখানো হতো। সময়ের পরিক্রমায় সেই ছোট প্রতিষ্ঠানটি এক বৃহৎ ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আজ তা মহারাষ্ট্র রাজ্যের বৃহত্তম দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র। এখান থেকে বিপুল সংখ্যক দ্বীনের খাদিম ও ধর্মীয় স্কলার তৈরি হচ্ছেন। 

দ্বীনি শিক্ষার প্রচারে তিনি এমন উচ্চ স্থান অর্জন করেন যে, সারা ভারত তাঁকে ‘খাদিমুল কুরআন’ নামে চিনতে শুরু করে। কিন্তু তা এখানেই থেমে থাকেনি। তিনি মাদ্রাসা স্থাপন করেই সন্তুষ্ট থাকেননি, নাম ও খ্যাতি পেয়েই দেয়ালের আড়ালে বসে যাননি। বরং তিনি জাতির সামনে থাকা আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। 

চাইলেই তিনি মাদ্রাসায় আরামে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তাঁর স্বভাব ছিল না থেমে থাকার। তিনি অজস্র শিক্ষিত ও দক্ষ লোকদের একত্র করেন, পরিকল্পনা তৈরি করেন, আল্লাহর ওপর ভরসা করে কাজ শুরু করেন। 

তিনি কেবল দ্বীনি শিক্ষার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং আধুনিক শিক্ষার নতুন দিক ও সম্ভাবনার অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। বিশ্বাস নিয়ে কাজ শুরু করেন— যদি ভ্রমণের সংকল্প থাকে, তবে শৃঙ্খলও ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে তিনি স্কুল, টিচার ট্রেনিং, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, ফার্মেসি এবং আইন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। আজও এসব প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার ছাত্র আধুনিক শিক্ষা গ্রহণ করছে একটি দ্বীনি পরিবেশে। 

তিনি যে আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়— এই সবই একজন ‘মাওলানা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, যাকে সমাজে অচল সদস্য মনে করা হয়। 

মাদ্রাসায় পড়েছেন, খানকাহ থেকে আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন করেছেন, বুযুর্গদের সংস্পর্শে থেকেছেন— তা সত্ত্বেও একা হাতে এত বড় কর্মযজ্ঞ কীভাবে পরিচালনা করলেন? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তিনি তা করে দেখিয়েছেন। 

তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে মুসলিম তরুণ প্রজন্ম উপকৃত হচ্ছে। 

তিনি কখনো পরিস্থিতির আফসোস করে বসে থাকেননি। নিজেদের সরলতা আর অন্যের চতুরতা নিয়ে কেবল বিলাপ করেননি, বিপক্ষের ষড়যন্ত্রে কান্নাকাটি, মাতম করা—এ সব ছিল না তাঁর স্বভাবে। তিনি বলতেন— প্রতিপক্ষ থাকলে তারা তো বিরোধিতা করবেই। তারা তাদের দায়িত্ব পালন করছে। প্রশ্ন তো আমাদের নিজেদের প্রতি— আমরা কী করছি নিজেদের জন্য, জাতির জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য?

তিনি বিশ্বাস করতেন— কেবল অভিযোগ করে, মিছিল-মিটিং করে সমস্যার সমাধান হয় না। সমাধান হল—পরিকল্পিত বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন— মুসলিম জাতির টিকে থাকা ও উন্নতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জ্ঞান। 

দ্বীনী জ্ঞানের আলো দিয়ে অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করতে হবে, আর আধুনিক জ্ঞানের মাধ্যমে জীবনের সমস্যা মোকাবেলার শক্তি অর্জন করতে হবে। এই দুই শক্তির সমন্বয়ে তিনি জাতিকে সজ্জিত করতে চেয়েছেন এবং নিজেকে এই কাজে উজাড় করে দিয়েছেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন— সরকারি সাহায্যের ওপর ভরসা না করে নিজেই নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। তিনি তা করে দেখিয়েছেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি এমন অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন যে, চিন্তাশীল মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে একজন মানুষ একা হাতে এত কিছু কীভাবে করলেন? তাঁর কাজ এত বিস্তৃত, এত মহান যে, তাঁকে ইমাম কাসেম নানুতবী রহ. এবং স্যার সাইয়্যদ আহমদ খান রহ.-এর প্রকৃত উত্তরসূরি বলা যায়। এবং এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এত ব্যাপক ও বহুমুখী শিক্ষা কার্যক্রম আর কেউ সম্পাদন করেছেন কি না, সন্দেহ।

কিছু মানুষ তাঁদের কৃতিত্ব দিয়ে সময়কে অতিক্রম করে যান। তাঁরা হয়ে ওঠেন মানবতার গৌরব, জাতির অহংকার। তাঁদের নাম ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ীভাবে লিখে ফেলা হয়। হযরত মাওলানা গোলাম মুহাম্মদ বুস্তানবী রহ.-ও তাঁর অসাধারণ কীর্তিগুলোর কারণে যুগ যুগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। 

আল্লাহ পাক জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন, আমীন।

এমএইচ/