ইসলামের ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু কথা
প্রকাশ:
১৯ এপ্রিল, ২০২৫, ০৪:৫৫ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
|| মুফতি সাঈদ আহমদ || ওয়াকফ মুসলমানদের দীন সুরক্ষা ও মানবসেবার এক চমৎকার ব্যবস্থাপনা, যা অন্য ধর্ম বা মতাদর্শীদের কাছে নেই। ওয়াকফ বলা হয় জনকল্যাণমূলক কোনো কাজে অথবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো মুসলমান তার ব্যক্তিগত স্থাবর অস্থাবর সম্পদ দান করে দেওয়া। সম্পদকে ওয়াকফ করে দেওয়ার মাধ্যমে সেই সম্পদে ওয়াকফকারীর মালিকানা চিরতরে রহিত হয়ে যায়। পরবর্তীতে কোনো সময় তার বংশধর তার ওপর মালিকানা দাবি করতে পারে না। এটা আল্লাহর মালিকানায় চলে যায়। ওয়াকফ সম্পদ একজন মোতাওয়াল্লি দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সম্পদ ওয়াকফ করার ধারাবাহিকতা নবীজির যুগ থেকেই শুরু হয়। সর্বপ্রথম প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববী এবং মসজিদে কোবা ওয়াকফ করে দেন। আনসারি সাহাবিরা মুহাজির সাহাবিদের জন্য তাদের জমি খেজুর বাগান ইত্যাদিকে ওয়াকফ করেছিলেন। প্রিয় রাসুলের যুগে সাহাবায়ে কেরাম মদিনার বিভিন্ন কূপ কিনে সবার জন্য ওয়াকফ করেছেন এমন ইতিহাস পাওয়া যায়। মুসলিম শাসনামলে ওয়াকফ বিস্তৃতি লাভ করে। ওয়াকফ সম্পদেই রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে মসজিদ ও দীনি প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠে। আব্বাসি শাসনামলে ইমামদের যুগে ফিকহ রচিত হয়। এবং ওয়াকফসংক্রান্ত নীতিমালাগুলো লিপিবদ্ধ হয়। আমরা দেখতে পাই ইসলামি শাসনামলে মসজিদ মাদরাসা দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়াকফ সম্পত্তি দ্বারাই পরিচালিত হতো। এসব পরিচালনার জন্য বিপুল পরিমাণ সম্পদ ওয়াকফ করা ছিল। মুসলমানদের সভ্যতা বিনির্মাণে দীন সংরক্ষণে ওয়াকফকৃত সম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র পরিচালনায় খলিফাদের বড় একটি শক্তি ছিল ওয়াকফের সম্পদ। ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে সামাজিক চাহিদাগুলো পূরণের ব্যবস্থা করা হতো। বিভিন্ন সরাইখানা রাবাত গড়ে উঠেছিল ওয়াকফের ওপর ভিত্তি করে। হাসপাতাল থেকে জনগণকে ফ্রি চিকিৎসা প্রদান করা হতো। রাবাত এমন সমস্ত প্রতিষ্ঠান যে প্রতিষ্ঠানগুলো বিধবা বৃদ্ধা অসহায় নারীদের আশ্রয় কেন্দ্র ছিল। তাদের সকল খরচ ওয়াকফ আয় থেকে বহন করা হতো। মুসলিম শাসনামলে ওয়াকফ এতটাই শক্তিশালী ছিল যে, এর ব্যবস্থাপনা মুসলিম উম্মাহর অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তান ওয়াকফের জমিতে জন্ম নিয়েছে, ওয়াকফের ব্যবস্থাপনায় লেখাপড়া করেছে, ওয়াকফ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছে। বৃদ্ধ বয়সে ওয়াকফ থেকে ভাতা পেয়েছে, মৃত্যুর পর ওয়াকফের জমিতেই তাদের কবর হয়েছে। ইসলামি খেলাফত ধ্বংসের পর মুসলমানদের ওয়াকফের বিপুল পরিমাণ সম্পদ জাতীয়করণ করা হয়। ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর আজ মসজিদ মাদরাসা ইমাম শিক্ষক শিক্ষার্থী অসহায় সামাজিকভাবে দুর্বল দরিদ্র শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। আজ মসজিদ দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য সমাজের কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করতে হয়। অথচ সোনালি যুগে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিপুল পরিমাণ নিজস্ব আয় ছিল এবং এগুলো পরনির্ভরশীল ছিল না। আমাদের উপমহাদেশে দীর্ঘ মুসলিম শাসনামলে ওয়াকফের বিস্তৃতি ঘটে। অসংখ্য মসজিদ মাদরাসা মাজার কবরস্থান এবং মুসলিম নিদর্শন স্থাপনা গড়ে ওঠে ওয়াকফের সম্পদে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিরা জনকল্যাণে এবং দীনি প্রতিষ্ঠানে তাদের সম্পদ দান করেন। মুসলিম সুলতানদের পতনের পর দীর্ঘ ব্রিটিশ ইংরেজ শাসনামলে মুসলমানদের ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের শিকার হয় মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পদ। তারা বিভিন্ন আইন তৈরি করে বিভিন্ন অজুহাতে বিপুল পরিমাণ সম্পদকে জাতীয়করণ করে। ব্রিটিশদের বিদায়ের পর হিন্দুত্ববাদী ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানরা নানাভাবে আক্রান্ত এবং নির্যাতিত। মুসলমানদের ওয়াকফকৃত সম্পদে রাষ্ট্রীয় অন্যায় হস্তক্ষেপ ধারাবাহিকভাবে চলছে। বিপুল পরিমাণ সম্পদ মুসলমানদের হাতছাড়া। সর্বশেষ ২০২৪ নতুন ওয়াকফ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে ওয়াকফ কৃত সম্পত্তির মালিকানা মুসলমানদের থেকে কেড়ে নেওয়ার সর্বশেষ আয়োজন সম্পন্ন হচ্ছে। এ নতুন সংশোধনীতে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জানা প্রয়োজন ওয়াকফ আইন নিয়ে ভারতে কী হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে I বর্তমানে ভারতে প্রায় ছয় লাখের বেশি ওয়াক্ফ সম্পত্তি রয়েছে, যার পরিমাণ প্রায় আট লাখ একর জমির সমান। এর মধ্যে বহু মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান ও ইসলামি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সংশোধনী বিল ২০২৪-মুসলিম সমাজের আপত্তির মূল বিষয়বস্তুগুলো হলো: ১. আমরা জানি দলিল দস্তাবেজ ডকুমেন্টেড করার ধারা অনেক আগে হলেও সমাজে মানুষের মধ্যে এর চর্চা বেশিদিন আগেও তেমন ছিল না। মৌখিকভাবেই মানুষ জায়গা-জমি দান করত। এমনকি বেচাকেনাও করত। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ডকুমেন্টেড করলেও এখনকার মতো সেগুলো সব সরকারি নথিভুক্ত করার প্রচলন অত শক্তভাবে ছিল না। স্বাভাবিক কারণেই কোনো সম্পত্তি যদি কোনো কারো মালিকানা দাবি ব্যতীত বহু বছর ধরে ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসত, তবে তাকে ওয়াক্ফ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হতো; কারণ, দীর্ঘ দিনের এই ব্যবহার চলমান থাকা এবং কারো মালিকানা দাবি না করা প্রমাণ করে, এটা অতীতে কেউ না কেউ ওয়াকফ করেছেন। নতুন বিলে এই নীতিকে বাতিল করা হয়েছে। ফলে বহু প্রাচীন মসজিদ, কবরস্থান ও মাদরাসা আর আইনি স্বীকৃতি পাবে না এবং সরকার তা দখল করতে পারবে। ২. অমুসলিম সদস্যদের ওয়াক্ফ বোর্ডে অন্তর্ভুক্তি। নতুন আইনে অমুসলিমদের ওয়াক্ফ বোর্ডে সদস্য হিসেবে রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা মুসলিমদের ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী। মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পদ পরিচালনা বোর্ডে অমুসলিম থাকবে কেন। এর দ্বারা মুসলমানদের সম্পদে নিজেদের স্বকীয়তা নষ্ট হবে। এই আইনের পেছনে বিজেপি সরকারের উদ্দেশ্যগুলো হলো: ১. 'এক জাতি, এক আইন' (Uniform Civil Code) চাপিয়ে দেওয়া। ২. মুসলিমদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করা। ৩. ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব মুছে ফেলা। ৪. ওয়াক্ফ জমি নিজ দলের লুটেরার হাতে তুলে দেওয়া। ওয়াক্ফ (সংশোধনী) বিল ২০২৪ শুধু একটি আইন নয়, এটি মুসলিমদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত অস্তিত্ব ধ্বংসের একটি কাঠামোগত রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ, সংগঠিত ও দূরদর্শী হতে হবে। নতজানু নীতি এই অবস্থা থেকে এই জাতিকে কোনো মুক্তি এনে দেবে না। আজকের পৃথিবীর আন্তর্জাতিক আইন তাদের গণতন্ত্রের বুলি তাদের মানবাধিকার এগুলো মুসলমানদের জন্য না। এটা আমরা ফিলিস্তিনে দেখেছি ইরাকে দেখেছি আফগানিস্তানে দেখেছি। তাদের আইন আদালত মুসলমানদের মুসলমানদের সম্পদের সুরক্ষা দিবে না। ভারতের বাবরি মসজিদ তার চাক্ষুষ প্রমাণ। এ কঠিন পরিস্থিতি সামনে রেখে মুসলিম উম্মাহর সাহসী কর্মসূচি গ্রহণ করা চাই। প্রতিবাদ হওয়া চাই শক্তিশালী। কিছু নিয়ম রক্ষার মানববন্ধন আর মিছিল সমাধান নয়। দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় বলতে চাই, মুসলমানদের এই ওয়াকফ ব্যবস্থাপনা মসজিদ মাদরাসাসহ ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলো সুরক্ষার একটি চমৎকার মাধ্যম। সোনালি যুগে মসজিদসহ সকল দীনি প্রতিষ্ঠান ওয়াক্তের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। এই প্রতিষ্ঠানগুলো সাহায্যের জন্য মানুষের কাছে নতজানু হতো না। আমাদের উচিত মসজিদ পরিচালনার সাথে সাথে নিজেদের সম্পর্কে মসজিদ পরিচালনার জন্য ওয়াকফ করা যেন মসজিদ সাহায্য প্রার্থী না হয়। মাদরাসা গড়ে তোলার সাথে সাথে মাদরাসার জন্য ওয়াকফ সম্পদের ব্যবস্থাপনা করা। এই ওয়াকফ সম্পদ থেকে মাদরাসার শিক্ষকরা ভাতা পাবে। মেধাবী শিক্ষার্থীরাই স্কলারশিপ পাবে। দীনি প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজের বোঝা হবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের বোঝার তাওফিক দান করুন। লেখক: মুদাররিস, জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, মোহাম্মদপুর, ঢাকা এমএইচ/ |