মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ।। ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ১ জিলকদ ১৪৪৬


‘তাবলিগের সেই ৪ দিনে যে শান্তি পেয়েছি, জীবনে কখনো তা পাইনি’

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

আমি প্রথম তবলীগে যাই ১৯৯৮ সালে। তখন লন্ডনে ছিলাম। পিএইচডির দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ অবস্থা আমার। পিএইচডি না হলে দেশে ফিরবো না কখনো– এটা ভেবে কান্না আসতো। আত্নহত্যা করবো কিনা এমনকি এই চিন্তাও আসতো মাথায়। কথাগুলো বলছিলেন, ঔপন্যাসিক, রাজনীতি-বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, কলামিস্ট, ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ড. আসিফ নজরুল।

তিনি বলেন, এমন ছিন্নভিন্ন মানসিক অবস্থায় আমার প্রতিবেশী হয়ে আসেন আমার একজন কলিগ। তিনি আইন বিভাগে আমার সিনিয়র শিক্ষক লিয়াকত আলী সিদ্দিকী। ছাত্রজীবনে একসময় বিতার্কিত হিসেবে নাম করেছিলেন। প্রথমদিকে পড়তেন জিনস, টি-শার্ট আর কেডস। অল্পদিন পর থেকে পুরো ইসলামী পোষাক।

তিনি আমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। প্রায় প্রতিদিন ডেকে খাওয়াতে নিয়ে যেতেন, পড়াশোনা নিয়ে বেশী চিন্তা করতে মানা করতেন। তিনি নিজে লন্ডনে মাষ্টার্স শেষ করার একমাস আগে দীর্ঘদিনের জন্য তবলীগে চলে গিয়েছিলেন, ডিগ্রীটা শেষ করেছিলেন ছয় বছর পর।

এ দুনিয়ার সাফল্য, খ্যাতি, অর্জন সত্যি তুচ্ছ তার কাছে। কাজেই তিনি এসব বললে মন দিয়ে শুনতাম। কিছুদিন পর জানা গেল তিনি আবার তবলীগে যাচ্ছেন লীডস্-এ। আমিও যেতে রাজী হলাম। চারদিনের পড়া শিকেয় তুলে রাখার এই সাহস কিভাবে পেলাম জানিনা। ফোনে স্বজনদের জানিয়ে দিলাম কোন যোগাযোগও করতে পারবো না কয়েকদিন।

মক্কার হজযাত্রীদের মতো পবিত্র মনে রওয়ানা দিলাম লীডসের পথে। বাসে সবাই দোয়া দরুদ পড়ছে, আমিও যোগ দিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের মেলা। কাউকে চিনিনা, কিন্তু কয়েক মূহূর্তে এমন আপন হয়ে গেল সবাই। চোখাচোখি হলে হাসে, সালাম দেয়, খাবার নিতে গেলে এ ওকে ঠেলে দেয় আগে, কোন একটা সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকে সবাই।

দিনরাত গোল হয়ে বসি। একজনের পর একজন সুরা পড়ি। কেউ কেউ ধর্মের বয়ান দেন। দোযোখ- বেহেস্তের বিবরণ না, সেখানে শুধু ভালো, নি:স্বার্থ আর সৎ হওয়ার শান্ত আহবান আর সৃষ্টি রহস্যের আকুল অনুসন্ধান।

তাড়া নেই, অপেক্ষা নেই, চিন্তা নেই- আশ্চর্য এক প্রশান্তিময় সময়। ঘুমাতে গেলে ঘুম আসে, গভীর ঘুম অনায়াসে ভাঙ্গে আজানের শব্দে। যেটা খাই অমৃতের মতো লাগে, যতোটুকু খাই মন ভরে থাকে। বুকের ভেতর আচড় নেই, নেই দাহ, হাহাকার! কিসের পিএইচডি, কিসের ঘর-সংসার। মনে হলো যাবো না এজায়গা ছেড়ে কোনদিন আর।

আমার জীবনে তীব্রতম, অবিশ্বাস্য, দু:সাহসী আর অপার আনন্দের বহু স্মৃতি আছে। কিন্তু সবচেয়ে প্রশান্তিময় দিন কেটেছে লীডস্-এর মসজিদে। যে সৃষ্টিকর্তাকে আমি ছোটবেলা থেকে খুজি গাছের নবীন পাতা, আকাশের অবিরাম বদলে যাওয়া, দুর নক্ষত্রের নিশ্চল আলোয় আর মাঝরাতে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ঘোর লাগানো বর্ষণে, লীডস্-এ আমি তাকে অতি সামান্য হলেও অনুভব করতে পেরেছিলাম।

যে শান্তি আমি পেয়েছি সেই চারদিন তা আর পাইনি আগে পরে কখনো। জীবনের সব দায় শোধ হলে আমি একদিন আবার চলে যাবে তার খোঁজে। অনন্তকালের জন্য। জানিনা তিনি আমাকে সে সুযোগ দিবেন কিনা।

লেখক: ঔপন্যাসিক, রাজনীতি-বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, কলামিস্ট, ও অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

-এটি


সম্পর্কিত খবর