মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ।। ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ১ জিলকদ ১৪৪৬


চাঁদনী রাত!

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মুহাম্মাদুল্লাহ শাব্বির।।

জিলহজের দশম রজনী। বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ে খুশির ঢেউ আছড়ে পড়ছে। সে-ঢেউ ছোটো-বড় সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। দশ-ই জিলহজের চাঁদের জোছনা___মিষ্টি মিষ্টি, স্নিগ্ধ স্নিগ্ধ, হালকা হালকা।

নাদিম, ফাহাদ, নাদিয়া, ফারিহা শহর থেকে গ্রামে এসেছে। দাদুর বাড়িতে। ঈদ করতে। খুব মজা মজা! ভীষণ খুশি খুশি। বাগড়াহীন ছুটোছুটি। বাঁধাহীন আনন্দ আনন্দ। বাবার চোখ রাঙানি নেই। মায়ের ধমকি নেই। ছুটে বেড়ানোর কোনও সীমা নেই। স্বাধীন স্বাধীন।

রাতের আকাশ। চাঁদের স্নিগ্ধজোছনা। ঝিরঝির শীতল বাতাস। হাসনাহেনা ফুলের সৌরভ। ডাহুকের ডাক, আর পাতি শিয়ালের হাঁক, থেকে থেকে ভেসে আসা। এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন চাঁদনী রাতের পরিবেশকে আরও বিমোহিত ও বিমুগ্ধ করে তুলেছে। নাদিমদের মনে হালকা ভয় ও শিহরণ জাগিয়ে তুলছে। এতে যেন ওদের খুশির আমেজ আরও একটু বাড়িয়ে তুলেছে।

ইশার সালাত শেষ। মাষ্টার সাহেব বসে আছেন। উঠোনে। মাদুর পেতে। পেয়ারা গাছ‌ তলে। আর চার জোড়া চোখ, তাকে ঘিরে বসে আছে। মায়া মায়া চেহারা। গভীর ভাবাবেগ নিয়ে। গল্প শোনার নেশায়। বহুদিন পর নাদিমরা মাস্টার সাহেবকে বাগে পেয়েছে। ছাড়াছাড়ি নেই। পালাবার কোনও পথ নেই। গল্প বলতেই হবে___নাদিমদের আবদার। ছোট্ট ফাহিম গলা জড়িয়ে ধরেছে। ওনাকে ওঠতে-ই দেবে না। মাস্টার সাহেব সবাইকে শান্ত করলেন। গলা ঝাড়া দিলেন। পান আরেক খিলি মুখে পুরলেন। খানিকটা চুন আংগুলের মাথায় নিয়ে, মজা করে, জিহ্বার ডগায় মাখলেন। নড়েচড়ে বসলেন। গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলেন। বললেন, "কি দাদুরা! আজ তাহলে গল্প শুনবে-ই?"
" জি দাদু!" নাদিমরা মাথা নেড়ে বলে উঠলো।

মাস্টার সাহেব পিস করে, পানের পিক ফেললেন। এরপর বলা শুরু করলেন, "আজ থেকে বহুকাল আগেকার কথা।"

"কতবছর দাদু? একশ বছর হবে দাদু?" নাদিয়া আগ্রহী হয়ে জানতে চাইলো।

"না দাদু! এখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেকার কথা। তখন মক্কায় শুধু ধু-ধু মরু প্রান্তর ছিলো। পাথুরে পাহাড় ছিলো। আর কিছুই ছিলো না সেখানে। এমন বিরাণ ভূমিতে বাস করতেন, নবী হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম, তাঁর পুত্র শিশু নবী হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম, ও তাঁর স্ত্রী হাজেরা আলাইহিস সালাম। ও-ও আর একটা কুপ ছিলো। যমযম। তাঁরা সেখানে থাকতেন আর আল্লাহর ইবাদত করতেন।

এক রাতের কথা। সবাই ঘুমে। গভীর রাত। হযরত ইব্রাহীম আলাইহি সালামও গভীর ঘুমে। তো তিনি একটি বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখলেন। সদা ধবধবে এক লোক। তাঁর সামনে দাঁড়ানো। আগুন্তুক হযরত ইব্রাহীম আলাইহি সালামকে বলছেন, "হে আল্লাহর খলিল! মোবারকবাদ! আপনাকে মহান আল্লাহ তাআলা ফরমান করেছেন, আপনার সবচে প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর রাহে কোরবানি করার জন্য!"

এমন বিস্ময়কর স্বপ্ন দেখে, হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের ঘুম ভেঙে গেলো। আর খোদার নবীগণ যা স্বপ্ন দেখেন, তা কিন্তু অহী! তা সত্য। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম ভেবে কোনো কূল পেলেন না। কোন বস্তুটা তাঁর সবচে প্রিয়!? অনেক ভেবেচিন্তে একশ উঁট কোরবানি করলেন। পরের রাত্রিতে আবারও সে একা-ই স্বপ্নের অবতারণা। তিনি আবারও একশ উঁট কোরবানি করলেন। পরের রাত্রিতে আবারও...! এভাবে যখন একই স্বপ্ন বারকয়েক দেখলেন, তখন তিনি তাঁর চিন্তার ধরণটা একটু পরিবর্তন করেন। গভীর থেকে ভাবতে লাগলেন। প্রিয় সবকিছুকে চোখের তারায় উপস্থিত করলেন। একে একে। এটা উপস্থিত করলে মনে হয়___নাহ, এটা নয়, সেটা। এভাবে করতে করতে পরিবারের দিকে নজর বুলালেন। চিন্তিত মনে কিছুটা আশার আলো দেখতে পেলো। অনেক গভীর দৃষ্টিতে স্ত্রী-পুত্রকে দেখতে লাগলেন। ভাবনার আকাশজুড়ে উড়ে উড়ে বেড়াতে লাগলেন। হৃদয়ের প্রিয় দু'ব্যক্তিকে ইনসাফের নিক্তিতে মাপা-ঝোকা করতে লাগলেন। কে সেই জন? স্ত্রী, না পুত্র?? চোখের তারায় দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হলো___সেই জন হলো, শিশু পুত্র প্রিয় "ইসমাইল!"

হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম গভীর ভাবাবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। এক দিকে মহান আল্লাহর রেজা ও সন্তুষ্টি, আর অপর দিকে অনেক কান্না ও রোনাযারীর পর‌ মহামহিম আল্লাহর খাস দয়া ও অনুকম্পায় বুড়ো বয়সে এসে, এ-পুত্র সন্তানকে দান করেছেন।

দাদুরা ভেবে দেখো, কেমন মোহাব্বত আর ভালোবাসার পাত্র ছিলেন, শিশু নবী হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম। নবী-মন‌ একবার ভাবেন, মহান আল্লাহর আদেশ ও সন্তুষ্টির কথা, আবার ভাবেন, বুকের ধন প্রিয় পুত্র শিশু‌ ইসমাইলের কথা। খোদার ‌প্রিয় বান্দা ও নবী বলে কথা। শেষমেশ হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মনকে শক্ত করলেন। দৃড়‌ পত্যয় গ্রহণ করলেন। মহান আল্লাহ তায়ালার আদেশ ও সন্তুষ্টিকে সাদরে গ্রহণ করলেন। প্রিয় পুত্রকে কোরবানি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। পরের দিন ভোরবেলা প্রিয় পুত্রকে মায়ের কাছ‌ থেকে সুন্দর করে, পরিপাটি করে, সাজিয়ে নিলেন। এরপর মাকে মহান আল্লাহর নির্দেশর কথা শুনালেন। মা-ও বিদায় দিলেন, বুড়িয়ে যাওয়া, নাড়ি ছেঁড়া ধন প্রিয় পুত্র শিশু ইসমাইলকে।

প্রিয় পুত্র, প্রিয় পিতার হাতের আঙ্গুল ধরে হাঁটছেন। সে-ই হাঁটতে কী দারুণ সৌন্দর্যৈর অবতারণা ঘটে ছিলো, তা শুধু তখনকার মক্কার আকাশ, সূর্য, পাথুরে পাহাড়, আর মরু সাগর অবলকন করে ছিলো। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য‌ে, প্রিয় পুত্র শিশু ইসমাইলকে, কোরবানির কথা, মিনা‌ প্রান্তরে, ভীষণ ভাবাবেগ নিয়ে বললেন, "পুত্র আমার! আমি স্বপ্ন দেখছি যে, তোমাকে জবই করছি। এবং এটা মহান আল্লাহর নির্দেশরও।"

প্রিয় পুত্র শিশু ইসমাইল পিতাকে বললেন, " ইয়া আবী! আপনি চিন্তিত হবেন না। চোখের অশ্রু মুছে ফেলুন। মহান আল্লাহর আদেশ পালন করুন। আপনি আমাকে উত্তম ধৌর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন ইনশাআল্লাহ! আমার হাত-পা শক্ত ভাবে বাঁধুন। আমাকে ঊপড় করে শোয়ান। যাতে আমার চেহারার মায়া আপনাকে ধোকায় না ফেলতে পারে। পিত্তৃতের আবেগ আপনার ভেতর জেগে না ওঠে। পাছে আপনি মহান আল্লাহর আদেশ পালনে বিলম্ব না করে বসেন।"

সে-দিন হয়তো আসমানের ফেরেশতারা নেমে এসেছিলো মিনা প্রান্তরে। মহান আল্লাহর অমন‌ হুকুম পালনের সুদৃশ্য অবলকন করার জন্য। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম মনে পাথর বাঁধলেন। সংগে করে আনা ধারালো ছোরাটা বের করলেন।

প্রিয় পুত্রকে হাত-পা বেঁধে শোয়ালেন। এরপর সমূহ শক্তি দিয়ে প্রিয় পুত্রের গলায় ছুরি চালালেন। কিন্তু, নাহ! একটা পশমও কাটলো না। আবার দেহে শক্তি সঞ্চার করে, নব উদ্যমে ছুরি চালালেন। এবারও ব্যর্থ হলেন। আবারও...! আবারও ব্যর্থ হলেন।

এদিকে হযরত জিবরিল আলাইহিস সালাম হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামকে টান‌‌ দিয়ে একটা জান্নাতি দুম্বা দিয়ে দিলেন ছুরির নিচে। তা কোরবানি হয়ে গেলো। এরপর হযরত জিবরিল আলাইহিস সালাম সুসংবাদ দিলেন,‌ "ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ! আপনার পুত্র যাবিহুলাহ! মহামহিম আল্লাহ তাআলা আপনার ওপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। আপনি আর আপনার পুত্র আল্লাহর নিকট তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।"

সেদিন জান্নাতি সুখ ও শান্তি, সুন্দর ও সৌন্দর্য নেমে এসেছিলো মিনা প্রান্তরে। পিতা-পুত্রের আলিঙ্গনাবদ্ধে আসমান থেকে ঝরে ঝরে পড়ছিলো, রহমতের শিশির। খুশির শবনম। আনন্দের ঝিরিঝিরি বাতাস।"

ছোট্ট ফারিহা গল্পের তালে তালে মাস্টার সাহেবের কোলে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো, তা কেউ টের পায়নি। নাদিমরা এখনও গল্পের তন্ময়তা কেটে ওঠতে পারিনি। মাস্টার সাহেব আরেক খিলি পান মুখে পুরে বললেন, "দাদুরা! ওঠো! ওঠো!! অনেক রাত হয়েছে। তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো। দেখি আমি কিছু আমল করতে পারি কিনা!

ঈদের রাত ইবাদতের রাত। নাদিমরা‌ এ-গল্প থেকে আসমান সম শিক্ষা আর সৌন্দর্য নিয়ে, ইতি টানলেন আজকের মতো গল্পের আসরে। তবে আবারও গল্প শোনার প্রতিশ্রুতি নিলো মাস্টার সাহেব থেকে নাদিমরা।

এনটি


সম্পর্কিত খবর