মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ।। ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ১ জিলকদ ১৪৪৬


আকাবির চিন্তার ধারক ছিলেন মুফতি কেফায়েতুল্লাহ বিন নূর

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

মাসউদুল কাদির।।

আনোয়ার লাইব্রেরী থেকে প্রকাশিত আমার গল্পগ্রন্থ মরু প্যাসেঞ্জার বইটির প্রথম গল্পটি যার অনুপ্রেরণায় লিখেছিলাম সেই মুফতি কেফায়েতুল্লাহ বিন নূর চলে গেছেন পৃথিবীর আলো বাতাস ছেড়ে। আমার জীবনের বেশ কিছু রঙিন মুহূর্ত আছে এই প্রাজ্ঞজনের সঙ্গে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খ্যাতিমান আলেমেদ্বীন জামিআ ইউনুসিয়ার সাবেক প্রিন্সিপাল মুফতি নুরুল্লাহ রহ.- তনয় মুফতি কেফায়েতুল্লাহ স্বভাবতই শাইখুল ইসলাম সাইয়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানীর ভাব শিষ্য ছিলেন। তারই চিন্তাধারা রক্ত ছিলো তার দেহে। আকাবির ও আসলাফের চিন্তা যেমন নিজে লালন করতেন তেমনি অন্যকে তা দারুণভাবে বুঝাতে পারতেন। দারুল উলূম দেওবন্দের চিন্তা ও আদর্শকে পথচলার পাথেয় মনে করতেন।

আমি জানি না, লেখালেখির এ সময়ে এসেও আলেমদের কোনো বিজ্ঞজনকে পেলেই জিজ্ঞেস করতে মন চায় একাত্তরে আপনার ভূমিকা কী ছিল? আপনার বাবা তখন কোথায় ছিলেন? উদ্দেশ্য এমন, একজনও যদি পাই দেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভেবেছেন, কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন তাহলে তা প্রচার করবো। জাতির সামনে উপস্থাপন করবো।

আমার এক বয়োবৃদ্ধ আলেম উস্তাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানলাম, তিনি এই ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই ১৯৫২ সালে মিছিল করেছিলেন, নুরুল আমীনের কল্লা চাই, রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। পরে অবশ্য তিনি সেই পাকিস্তানের করাচিতকে পড়াশোনা করে এসেছেন। উর্দূ ভাষার প্রতি আলেমদের একটা ভালোবাসা আছে। সেটা দ্বীনের কারণে। দ্বীনী ইলমের অনেক অনুষঙ্গ এ ভাষা থেকে সহজে গ্রহণের সুযোগের কারণেই উর্দুকে ভালোবাসেন তারা।

ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপুরী রহ. এই উর্দূ ভাষার প্রতি মনোযোগী হতেও আহ্বান জানিয়েছিলেন। কারণ, দারুল উলূম দেওবন্দে এই উর্দূর প্রচলন। দেওবন্দের সঙ্গে রাবেতা বা সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্যও উর্দূ জানা জরুরি। কিন্তু ১৯৫২ সালে পাকিস্তান ভুলভাবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল উর্দূ। ছয় দফা থেকে যেমন ১৯৫২ এসেছে তেমনি ৫২ থেকে ১৯৭১-এর প্রেক্ষাপট তৈরী হয়েছে।

মুফতী কেফায়েতুল্লাহ রহ.-এর সঙ্গে আলাপে মগ্ন হতে খুবই ভালো লেগেছিল তিনি মুফতি নুরুল্লাহ রহ.-এর বড় সাহেবজাদা। সহসাই তার সঙ্গে কথা বলে কেউ স্বাদ পাবে না বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু রাগিয়ে দিতে পারলে তিনি দারুণ বলতে পারেন। আমার মনে আছে, অসংখ্যবার জমিয়ে আড্ডা দিতে পেরেছি। দেশের অনেক গুরুত্ব ক্রান্তিকালীয় সমস্যা নিয়েও তিনি কথা বলেছেন। সবকথা বলবার মতো সুযোগও নেই। কারা শাইখুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর পরিবারকে সিলেটে ঘেরাও করে রেখেছিল। এখনো কারা খেলাফত ভবন দখল করে রেখেছে। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশীয় জমিয়ত উলামার পার্থক্য। পাকিস্তান জমিয়েত উলামার প্রতিষ্ঠা কারা করেছেন? একাত্তরে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে কারা জড়িত। যাক ওসব আলোচনা এখানে করতে চাই না।

মুফতি কেফায়েতুল্লাহ রহ. খুব আফসোস করে বলতেন, বাংলাদেশে আমরা কেবল শাইখুল ইসলাম সাইয়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানীর দারস ও তাদরিসকে ধরে রাখতে সচেষ্ট। তার যে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন তা নিয়ে আমাদের কোনো চর্চা নেই। ভারত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাকে নিয়ে আমাদের কোনো অগ্রসর চিন্তাও নেই।

একদিন এক আলোচনায় মুফতি কেফায়েতুল্লাহ রহ. বলেছিলেন, অতি উদারনৈতিক চিন্তার ফলে আমরা অনেক কিছু হারিয়েছি। আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো, এ দেশের মানুষের সামনে ইংরেজ খেদাও আন্দোলনের আলেম সিপাহসালারদের তুলে ধরতে পারিনি। দারুল উলূম দেওবন্দের চিন্তাধারাটাও এ দেশের মানুষের সামনে স্পষ্ট করতে পারিনি। ফলে বিদ্যাবুদ্ধির বালাই নেই, গায়েগতরে কোনো সুরত নেই তারাই এ দেশের ইসলামের ঠিকাদার হয়ে গেছে।

আজ বিপন্ন সময়ে মুফতি কেফায়েতু্ল্লাহকে বড় মনে পড়ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুফতি নুরুল্লাহ রহ. স্মৃতি বিজড়িত সেই তাদের বাসায় আমি গিয়েছি। সেখানে মাদানী দস্তরখানে বসবার সৌভাগ্যও লাভ করেছি। যত জায়গায় তার সঙ্গে বসেছি, পথ চলেছি, সবখানে তিনি শাইখুল ইসলামের সংগ্রামী চেতনাকে সামনে রেখেছেন।

আখাউড়া সীমান্তের কাছে একজন মাদানী ভক্ত আশেকে রাব্বানী আছেন। সীমান্তে তার অতটাই জানাশোনা যে, দেওবন্দের এমন কোনো শায়খ নেই যিনি তার বাড়ির মেহমান হননি। মুফতি নুরুল্লাহ রহ.-এর আধ্যাত্মিক শিষ্য তিনি। তাসাওফের এই পথে এমনভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন, হক্কানী উলামায়ে কেরামের পদভার যেনো তার জীবনের বিভা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সবশেষে লকডাউন পড়ার আগে আমিও একদুপুরে মেহমান হয়েছিলাম তার ঘরে। আমি আর মুফতি শফিক ভাই তার ঘরে ঢুকেই একটা নুরানিয়্যাত লক্ষ্য করলাম। আমার মনে একটা ভয়ও কাজ করলো, এখানে তো অনেক বড় বড় আলেম এসেছেন। আজ আমি এলাম। সেই আখাউড়ার ভাই কেফায়েতুল্লাহ সাহেবের অনেক দেওবন্দ ভালোবাসার গল্প শোনালেন। তিনি কীভাবে ছুটে যেতেন কোনো একজন দেওবন্দী আলেম ত্রিপুরায় এলে। আমি বুঝলাম, আল্লাহর অলিদের ঘরে জন্ম নেন সেরকম ব্যক্তিগণই।

করোনাকালের এই করুণ সময়ে মুফতি কেফায়েতুল্লাহ বিন নূরও চলে গেলেন পরপারে। আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাআলা মরুহুমের আখেরাতকে সুন্দর করুন।

লেখক: প্রেসিডেন্ট, শীলন বাংলাদেশ (সাহিত্য ও সামাজিক সংগঠন)ড

-এএ


সম্পর্কিত খবর