শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫ ।। ১৩ বৈশাখ ১৪৩২ ।। ২৮ শাওয়াল ১৪৪৬

শিরোনাম :
বিদেশি সংস্কৃতি চাপানোর চেষ্টা করবেন না: মুফতি ফয়জুল করিম জমিয়তের জাতীয় কাউন্সিলের ৭ নতুন প্রস্তাবনা ‘আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি ব্যতিত জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সংহতি বজায় রাখা সম্ভব নয়’ গুজরাটে ১ হাজারের বেশি বাংলাদেশি গ্রেপ্তার এবার যে ২০ ভাষায় অনুবাদ করা হবে হজের খুতবা সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ ৫ বছরের পক্ষেই জামায়াত স্বামীর টাকায় হজ করলে ফরজ আদায় হবে? ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ ৩০ ফিলিস্তিনি, নেই উদ্ধারের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পেহেলগামে হামলার স্বচ্ছ তদন্তের জন্য পাকিস্তান প্রস্তুত: শাহবাজ শরীফ জমিয়তের সভাপতি আল্লামা ওবায়দুল্লাহ ফারুক মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি

বঙ্গবন্ধু যে মাওলানার প্রচেষ্টায় অল পাকিস্তানের জাতীয় নেতা হয়ে উঠেছিলেন

নিউজ ডেস্ক
নিউজ ডেস্ক
শেয়ার

সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ;

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এড়িয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস জানা সম্ভব নয়। তিনি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান। সবরকম জুলুম-অত্যাচার থেকে এ জাতিকে উদ্ধার করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সঙ্গী ছিলেন বাংলার কিছু দামাল ছেলে। তাদের মধ্য অনেক ছিলেন আলেম। ৪২ বছর মাওলানাদের সেই ইতিহাস গোপন করে রাখা হয়েছিল। তাদেরকে ইতিহাস থেকে আড়াল করে রাজাকার ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিবলে অপপ্রচার কম চালানো হয় নি।

বঙ্গবন্ধুর এমনি এক ঘনিষ্ট সহচরের পরিচয় আজ আপনাদের সামনে তুলে ধরব। যিনি একজন মাদ্রসা পড়ুয়া একজন বড় মাফের আলেম হাফেজ ক্বারী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।

এ জাতির গর্ব, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাওলানা ক্বারি মোহাম্মদ ইউসুফ।১৯৪৩ সালে দৌলতপুর, পটিয়া, চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া মোহাম্মদ ইউসুফ চট্টগ্রামের জিরি মাদ্রাসায় হাফেজ এবং মাওলানা হয়ে পশ্চিম পাকিস্তান গেলেন কেরাতের ওপর উচ্চ ডিগ্রির জন্য। ভর্তি হলেন ‘মাদ্রাসা দারুল কোরআন করাচি’তে। দারুল উলুম দেওবন্দের বানী, মাওলানা ক্বারি তৈয়ব [রহমাতুল্লাহি আলাইহি]-এর নাতি ক্বারি জাহের কাসেমীর পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি বেড়ে ওঠেন।

১৯৬০ সালে পাকিস্তান বেতারে অংশগ্রহণ দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু এবং তার তেলাওয়াতের মাধ্যমেই শুরু হয় পাকিস্তানে টিভি সম্প্রচার। ১৯৬২ সালে মালেশিয়ার প্রেসিডেন্ট টেঙ্কু আবদুর রহমানের নিমন্ত্রণে আন্তর্জাতিক কেরাত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।

সেখান থেকে ফিরে নিজ দেশেও আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেছেন বহুবার। শিক্ষা এবং কর্মজীবনের ১৫টি বছর পাকিস্তান কাটিয়ে তাদের ব্যবহারে অতিষ্ঠ হন। ঘৃণা জন্মে পাকিস্তানি প্রশাসনের প্রতি। একজন আলেম ও বিখ্যাত ক্বারি হওয়ার পরও ‘বাঙালিবাবু’ সম্বোধন তার কাছে ছিল চরম অপমান ও অস্বস্তিকর। অন্যদিকে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালি পাকিস্তানের জনসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি হলেও চাকরি এবং সব ধরনের সুযোগ ছিল নির্যাতিত ও অধিকারবঞ্চিত। প্রতিবাদস্পৃহায় নড়ে ওঠেন তিনি।

যুক্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে। এ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম বৈঠক হয় পাকিস্তান জিএম সাঈদের বাসায়। ড. কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট জহির উদ্দিন ও খন্দকার মোশতাক সেখানে উপস্থিত ছিলেন।বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দ্বিতীয় বৈঠক হয় পাকিস্তানের বিজলাক্সারি হোটেলে। বর্তমান মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ৩য় বৈঠক হয় বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাসায়। সেখানে বঙ্গবন্ধু, ক্বারি ইউসুফ এবং বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ছিলেন।

স্মৃতিচারণ করে ক্বারি ইউসুফ বলেন, আজকের প্রধানমন্ত্রী ‘শেখ হাসিনার মা বড় ভালো মানুষ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে খেতে বসলে আমাদের কলমি শাক দেয়া হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ হাসিনার মাকে বললেন- ‘আরও ভালো কী আছে, নিয়া আসো। পাকিস্তান থেকে মেহমান এসেছেন।’

মাওলানা ক্বারি ইউসুফ বলেন, ‘সেই মিটিংয়ে আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম- আপনি পাকিস্তান চলেন, সেখানে ১০ লাখ বাঙালি আছে। মাথা গেলে আগে আমাদের যাবে, এরপর আপনার। তিনি আমার প্রস্তাবে রাজি হলেন। আমি পাকিস্তান। গিয়ে করাচির নস্তর পার্কময়দানে বাঙ্গিলিদের নিয়ে সমাবেশের আযোজন করি। আমরা বাঙ্গিলিরা জীবনে ঝুকি নিয়ে সব আয়োজন করলাম। বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেয়া হল। সে সমাবেশে ১০ লাখেরও বেশি মানুষের জমায়েত হল।

পাকিস্তনের দৈনিক সমূহে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বড় লীড নিউজ হল। সে সমাবেশে আমি বঙ্গবন্ধুকে ৬ দফা দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনের জন্য তাকে স্বর্ণপদক দিয়েছিলাম। ড. কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট জহির উদ্দিন, তোফায়েল আহমেদ সেখানে ছিলেন। সেই থেকে ঢাকাইয়া লিডার থেকে অল পাকিস্তানি লিডার হলেন বঙ্গবন্ধু।

আন্দোলনের সময় পাকিস্তান বেতারের ডিরেক্টর জিল্লুর রহমান আমাকে ডেকেছিলেন। আমি বললাম- ‘না, পাকিস্তানের পতাকা থাকা পর্যন্ত কোনো প্রোগ্রাম করব না। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পরদিন পাকিস্তান বেতার থেকে চাকরিচ্যুত করে আমার ওপর গ্রেফতারি পরওয়ানা জারি করা হয়। আমি লুকিয়ে থাকি। পরে আমার কিছু ছাত্র ও ভক্তের সহযোগিতায় পাকিস্তানের সর্বশেষ ফ্লাইটে শ্রীলংকা হয়ে বাংলাদেশে আসি। পাকিস্তান কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তির পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে রেসকোর্স ময়দানেও আমি শেখ সাহেবের সঙ্গে ছিলাম।
শেখ সাহেবের আঙ্গুল নাড়া বক্তব্য এখনও চোখে ভাসে।’ বাংলাদেশকে পৃথক রাষ্ট্র করার পেছনে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টিভঙ্গি ও আলেমসমাজের ভূমিকা প্রশ্নে ক্বারি ইউসুফ বলেন, পাকিস্তানের পৈশাচিক আচরণ, অকথ্য জুলুম-নির্যাতন আর স্বৈরাচারে বাধ্য হয়ে শেখ সাহেব বললেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

যার পরিণতিতে আমরা পেলাম একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। প্রথমে আলেমসমাজ চেয়েছেন দেশ বিভক্ত না হোক। পরে পাকিস্তানের বিখ্যাত মুফতি মাহমুদ হাসান আলেমদের ঢাকার নবাব বাড়ি মসজিদে ডেকে শেখ সাহেবের ৬ দফার সমর্থন দেন। এতে আলেমরা মেনে নেন। মুহাদ্দিস মুফতি ওলিউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করার অপরাধে আজিমপুর ছাপরা মসজিদের পাশে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। মাওলানা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ, যশোরের মাওলানা খাইরুল ইসলাম, কুমিল্লার মাওলানা হাবিবুর রহমান, মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী ও মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদসহ বহু আলেম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। জামায়াতের সঙ্গে আলেমদের মিলিয়ে নেয় কেউ কেউ। আসলে এ বিষয়ে এরা কোনো জ্ঞানই রাখে না।

আলেমদের প্রতি শেখ সাহেবের শ্রদ্ধা বিষয়ে বলতে গিয়ে ক্বারি ইউসুফ পুত্র শেখ আহমাদ ইবনে ইউসুফকে দেখিয়ে বলেন, ‘শেখ সাহেব আলেমদের খুব শ্রদ্ধা করতেন। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীর সামনাসামনি দাঁড়াতেন না। তিনি বসে ফরিদপুরীকে জড়িয়ে ধরে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। দেশের জন্য এত কাজ করার পরও আপনি রাষ্ট্রীয় পদ বা মর্যাদায় নেই কেন? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার পর শেখ সাহেব আমাকে রাজনীতিতে যেতে বললে, আমি অস্বীকার করি এবং হজরত হাফেজ্জি হুজুরের দোয়া নিয়ে কোরআনের খেদমতে লেগে থাকি।

এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কোরআন তিলাওয়াত সংস্থা [ইকরা]-এর মাধ্যমে কেরাত প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করেছি ১৪ বার। বিশ্ববিখ্যাত ক্বারিরা এতে অংশগ্রহণ করেছেন। দেশে শুদ্ধ কোরআন চর্চা হচ্ছে। বয়স হয়েছে। এখন আর পারি না। আমার ছেলে শেখ আহমাদ ইবনে ইউসুফ আল আযহারি এখন কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আলেম হওয়ার পর মিসরে হিফজ এবং কিরাত বিষয়ে পড়ে কেবল দেশে নয় বিদেশেও এখন আন্তর্জাতিক কিরাত সম্মেলনে বিচারক হিসেবে কাজ করে।’

দেশে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিষয়ে বুদ্ধিমান, দক্ষ আলেমদের নেতৃত্বে আনার পরামর্শ দিয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান রাখেন তিনি। সব মুসলিম রাষ্ট্রের মতো এ দেশেও বিজ্ঞ আলেমদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড তৈরি করার কথা বলেন, যারা সার্বিক বিষয়ে সরকারকে সহযোগিতা করবে। দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। এই বাণী নবীজী হজরত মুহাম্মদের সা.। তিনি আপন মাতৃভূমিক ভালোবাসতেন। মক্কা ছেড়ে মদীনা যাওয়ার পথে বারবার পেছনে ফিরে তাকিয়েছেন। স্বদেশ ছাড়ার কষ্ট রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেছেন।

বঙ্গবন্ধুও যে ৭২ সালের ১০ জানুয়ারী পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন সেদিন আবেগে কেঁদেছিলেন। সে সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচর হাফেজ মাওলানা কারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ ইউসুফ উপস্থিত ছিলেন। ক্বারি মোহাম্মদ ইউসুফ নবীজীর প্রকৃত উত্তরসূরির পরিচয় দিয়েছেন। তার দেশপ্রেম ও দেশের জন্য আত্মত্যাগ এ কথার স্বীকৃতি দিচ্ছে অবলীলায়। দেশের পুরো আলেমসমাজ এভাবে দেশকে ভালোবাসলে, দেশের জন্য কাজ করলে, শিক্ষা, শান্তি, উন্নতি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় আরও সমৃদ্ধ হবে দেশ।

সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট একজন আলেম মুক্তিযোদ্ধা, আহসান শরীফ, দৈনিক যুগান্তর ১৪ মার্চ ২০১৪ ইংরেজি


সম্পর্কিত খবর



সর্বশেষ সংবাদ