।। হাবিবুল্লাহ ।।
আজ ৭ জানুয়ারি। মধ্যযুগে সুলতানী আমলে বাংলার মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সঙ্কট থেকে মুক্তির দূত, দরবেশ ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব নূর কুতুবুল আলম রহ. এর মৃত্যুবার্ষিকী। ১৪৪৭ সালের এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেন।
১৩৫০ সালের কিছু আগে তৎকালীন বাংলার রাজধানী পাণ্ডুয়ায় তার জন্ম। তার পিতা ছিলেন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ও সুফি শায়খ আলাউল হক রহ.। তার প্রকৃত নাম নূরুদ্দীন নূরুল হক রহ.। ‘নূর কুতুবুল আলম’ তার উপাধি । ইলিয়াস শাহী বংশের তৃতীয় সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহ ছিলেন তার সহপাঠী ও বন্ধু।
নূর কুতুব আলম তাঁর পিতার আমল থেকে সব ধরনের কায়িক শ্রমের অভ্যাস করতেন। দরগায় আগত ফকিরদের কাপড় ধোয়া, লাকড়ি ও পানি বহন, শীতকালে পীরের অজু করার জন্য সর্বদা পানি গরম রাখা, এমনকি খানকাহসংলগ্ন শৌচাগার পরিষ্কার করা প্রভৃতি কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। তিনি তাঁর দুই পুত্র শেখ রাফকাতউদ্দীন এবং শেখ আনোয়ারকে আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেন। সম্ভবত পিতার জীবদ্দশায় শেখ আনোয়ার রাজা গণেশের হাতে সোনারগাঁয়ে শহীদ হন। শেখ নূর কুতুব আলমের অন্য আর একজন প্রধান মুরিদ ছিলেন শেখ হুসামুদ্দীন মানিকপুরী।
১৪১৫ খ্রিস্টাব্দ। রাজা গণেশ নামক একজন হিন্দু শাসক ইলিয়াস শাহি বংশ উত্খাত করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি মুসলমানের ওপর নজিরবিহীন জুলুম-নির্যাতন শুরু করেন। এমনকি শায়খ ও আলেমদের ওপর অবর্ণনীয় অত্যাচার শুরু করেন। এ অবস্থায় শায়খ নূর কুতুব আলম রহ. জৌনপুরের সুলতান ইবরাহিম শর্কিকে বাংলা আক্রমণ করে বাংলাকে গণেশের হাত থেকে রক্ষা করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লেখেন। সুলতান ইবরাহিম শর্কি এই অনুরোধ রক্ষা করে বাংলা আক্রমণের উদ্দেশ্যে পিরোজপুর এসে শিবির স্থাপন করেন। রাজা গণেশ এতে ভয় পেয়ে নূর কুতুব আলম রহ.-এর কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং তাঁকে ক্ষমা করে ইবরাহিম শর্কিকে জৌনপুরে ফিরে যেতে বলার অনুরোধ করেন ।
নূর কুতুব আলম এতে সম্মত হননি, বরং পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি রাজা গণেশকে মুসলমান আহ্বান জানান। গণেশ তাতে সম্মত হন, কিন্তু বিস্তারিত শুনে তাঁর রানি এতে বাধা দেন। গণেশ তখন তার ১২ বছরের ছেলে যদুকে নিয়ে শায়খের কাছে আসেন। যদুকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে জালালুদ্দীন নাম দেওয়া হয় এবং গণেশ তার পক্ষে সিংহাসন ত্যাগ করেন।
শায়খের মৃত্যুর পর গণেশ অবশ্য যদুকে হিন্দু ধর্মে পুনরায় দীক্ষিত করে নিজে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু রাজা গণেশের মৃত্যু হলে যদু জালালুদ্দীন মুহাম্মদ শাহ উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তার দরগাহ সংলগ্ন সরাইখানা ও মাদরাসার ব্যয় নির্বাহের জন্য সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ কয়েকটি গ্রাম দান করেন। দরবেশের মাজার জিয়ারতের জন্য সুলতান বছরে একবার রাজধানী শহর একডালা থেকে পান্ডুয়ায় আসতেন।
শায়খ নূর কুতুব আলম পান্ডুয়ার পীর-আউলিয়ার মধ্যে শীর্ষ মর্যাদার অধিকারীদের অন্যতম। পিতা-পুত্র দুজনই পান্ডুয়ার বিখ্যাত শাশ হাজারি দরগায় শায়িত আছেন। পিতার মতো তিনি চিশতিয়া মতাদর্শের পীর ছিলেন। তাঁর অনুসারী শিষ্যকুল ও দরবেশরা কয়েক শতক ধরে বাংলায় মুসলিম সমাজজীবনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে শায়খ নূর কুতুব আলমের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান বাংলার মুসলিম শাসন রাজা গণেশের হাত থেকে রক্ষা করা।
তথ্যসূত্র: উইপিকিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, শায়েখ আব্দুল হক দেহলভী, আকবারুল উখিয়া ফি আসরারুল আবরার, সোস্যাল হিস্টোরি অফ দ্যা মুসলিম ইন ব্যাঙ্গাল
বিনু/