|| মুফতি তাকী উসমানী ||
আব্বাজান হযরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর একটি কথা আমি প্রায়ই বলে থাকি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতবর্ষে (মুসলিমদের জন্য) বিশেষ তিনটি শিক্ষাধারা প্রচলিত ছিল। ক. দারুল উলুম দেওবন্দভিত্তিক শিক্ষাধারা। খ. আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রিক পড়াশোনা গ. দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার সিলেবাস কেন্দ্রিক শিক্ষাধারা।
যথাসম্ভব ১৯৫০ সনে আব্বাজান রাহ. কোনো সাধারণ এক সমাবেশে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছিলেন- ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আমাদের আলীগড়ের শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন নেই, নদওয়ারও প্রয়োজন নেই; এমনকি প্রয়োজন নেই দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষাব্যবস্থারও; বরং আমাদের প্রয়োজন একটি তৃতীয় শিক্ষাব্যবস্থা, যা আসলাফ ও পূর্বসূরীদের ইতিহাসের ধারায় আমাদেরকে সম্পৃক্ত করবে।’
এমন কথা শুনে অনেকেই হয়ত ভ্রু কুঁচকে ফেলবেন। দারুল উলুম দেওবন্দের নুন খাওয়া এক সুবোধ সন্তান, দারুল উলূম দেওবন্দের আস্থাভাজন প্রধান মুফতি কীভাবে এমন কথা বলতে পারেন যে, পাকিস্তানে আমাদের জন্য দেওবন্দের শিক্ষাধারারও প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রয়োজন একটি নতুন শিক্ষাব্যবস্থার!
আব্বাজান রাহ.-এর এ বক্তব্যটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং দূরদর্শিতাপূর্ণ। বিষয়টি না বোঝার দরুন আমাদের এখানে বড় ধরনের ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গিয়েছে। ভারতবর্ষে যে তিনটি ধারা প্রচলিত ছিল তা স্বাভাবিক কোনো ধারা ছিল না; বরং তা ছিল বৃটিশপ্রবর্তিত ধারার প্রতিফল এবং তাদের চক্রান্তের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ বিকল্প মাধ্যম অবলম্বন মাত্র। নতুবা ভারতবর্ষে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রবেশের পূর্বে মাদরাসা এবং স্কুল নামের দুটি বিভাজিত ধারার অস্তিত্ব আপনি খুঁজে পাবেন না। এতদঞ্চলে ইসলামের সূচনা থেকে বৃটিশ পিরিয়ডের আগ পর্যন্ত বিদ্যালয়গুলোতে একসাথে দ্বীনি এবং জাগতিক দু’ধারার শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ছিল।
শরীয়তের বক্তব্যও এমনই; প্রতিটি মুমিনের জন্য আলেম হওয়া ফরজে আইন নয়; বরং তা ফরযে কিফায়াহ। অর্থাৎ কোনো এলাকায় বা কোনো রাষ্ট্রে যদি প্রয়োজন অনুপাতে আলেম প্রস্তুত হয়ে যান, তাহলে অন্যদের থেকে সে দায়িত্ব রহিত হয়ে যায়। কিন্তু দ্বীনের মৌলিক ইলম হাসিল করা ফরজে আইন, প্রত্যেক মুসলমানের উপর তা ফরজ। তো সেসকল বিদ্যালয়গুলোতে সবার জন্য ফরজে আইন ইলমের ব্যবস্থা ছিল। এতে কোনো বিভাজন ছিল না। মুসলমানমাত্রই সে ফরজে আইন ইলম হাসিল করত। আর যে দ্বীনি ইলমে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে চাইত তার জন্য থাকত ভিন্ন এন্তেজাম। আর যে জাগতিক বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চাইত তার জন্য থাকত পৃথক ব্যবস্থা ।
মরক্কোর একটি কারগুজারি শুনুন-
আমি গত বছর মারাকেশ সফরে গিয়েছিলাম। এ বছর মুহতারাম ভাইজান মুফতি মুহাম্মাদ রফী উসমানী ছাহেব সেখান থেকে সফর করে এসেছেন। মারাকেশকে ইংরেজিতে বলে মরক্কো। মরক্কো’র একটি শহর হল ‘ফাস’। আমাদের ফাসে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে জামেয়া কারাউয়্যীন নামে এক জামেয়া এখনও কাজ করে যাচ্ছে।
ইসলামের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ জামেয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পর্যালোচনা যদি আপনি সামনে আনেন তাহলে মৌলিকভাবে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। আর এর প্রথম সারিতে রয়েছে মারাকেশের এই জামেয়া। দ্বিতীয়তে রয়েছে তিউনিসিয়ার জামেয়া যাইতুনিয়া। তৃতীয়তে রয়েছে মিশরের জামেয়া আযহার। আর চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে দারুল উলূম দেওবন্দ। ঐতিহাসিক বিন্যাস এমনই।
তো এর মাঝে সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হল মারাকেশের ফাস শহরে অবস্থিত জামেয়া কারাউয়্যীন। তৃতীয় হিজরি শতাব্দীতে এর প্রতিষ্ঠা। এটা শুধু ইসলামি দুনিয়ার নয়, পুরো বিশ্বের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। তৃতীয় শতাব্দীর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস সম্বলিত প্রস্পেকটাসে পাওয়া যায়, এখানে একদিকে যেভাবে দ্বীনি বিষয় তথা কুরআন, হাদিস, তাফসির, ফিকহ প্রভৃতির পাঠদান হত। পাশাপাশি যেগুলোকে আজ আমরা জাগতিক বিষয় বলি যেমন-চিকিৎসা বিদ্যা, গণিত শাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান ইত্যাদি সেগুলোও পড়ানো হত। ইবনে খালদুন রাহ., ইবনে রুশদ রাহ., কাযী ইয়ায রাহ.-সহ আমাদের বড়দের দীর্ঘ তালিকা রয়েছে, যারা সেখানে দরস দিতেন। তাদের নিকট আজ এ ইতিহাসও সংরক্ষিত রয়েছে যে, কোথায় বসে ইবনে খালদুন রাহ. দরস প্রদান করতেন। কোথায় ইবনে রুশদ রাহ.-এর দরস হত। কোথায় কাযী ইয়ায রাহ. দরস করাতেন। কোথায় ইবনে আরাবী মালেকী রাহ. সবক পড়াতেন। ইতিহাসের এ অনুষঙ্গগুলো আজও তাদের নিকট সংরক্ষিত রয়েছে। এটা ইসলামের ইতিহাসে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। ছোট ছোট বিদ্যাপীঠ তো সবজায়গাতেই ছিল। কিন্তু জামেয়া কারাউয়্যীন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা রাখত। আর তাতে দ্বীনী এবং বৈষয়িক সকল শাস্ত্রের পাঠদান হত।
এই ইউনিভার্সিটিতে তৃতীয়-চতুর্থ শতাব্দীর সায়েন্টিফিক আবিষ্কারের কিছু নমুনাও সংরক্ষিত রয়েছে। এই ইউনিভার্সিটির সন্তানরা সেকালে ঘড়িসহ কী কী সামগ্রি আবিষ্কার করেছে তার নমুনা তাদের নিকট সংরক্ষিত আছে।
আপনি তৃতীয় শতাব্দীর কথা কল্পনা করুন। ঐ যামানার জামেয়া বা বিশ্ববিদ্যালয় এটা। এতে একদিকে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিদগ্ধ আলিম তৈরি হয়েছেন। তেমনি সেখানে তৈরি হয়েছেন ইবনে রুশদের মত দার্শনিক। সেখান থেকে জন্ম নিয়েছেন বড় বড় অনেক বিজ্ঞানী।
সেখানে কী হত?
ঐসময় ফরজে আইন পরিমাণ দ্বীনি ইলম সবাইকে শেখানো হত। এরপর কেউ দ্বীনি বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন করতে চাইলে এই ইউনিভার্সিটিরই দ্বীনি দরসের হালকায় বসত। কেউ গণিত শাস্ত্রে পাঠদান করতে চাইলে সেখানে তারও ব্যবস্থা ছিল। চিকিৎসা নিয়ে কেউ পড়তে চাইলে সেখানে তারও সুযোগ ছিল। পুরো ব্যবস্থাপনা এভাবেই চলত।
এই জামেয়া কারাউয়্যীনের মতো তিউনিসিয়ার জামেয়া যাইতুনিয়া এবং মিসরের জামেয়া আযহারের ব্যবস্থাপনাও একই রকম ছিল। এই তিন ইউনিভার্সিটিই আমাদের দূর অতীতের ইতিহাস। এখানে দ্বীনি এবং বৈষয়িক শিক্ষার ব্যবস্থা এভাবে রাখা হয়েছিল।
ইতিহাসের পাতা খুলে দেখুন। হাদিস ও সুন্নাহর ইমাম কাযী ইয়ায রাহ.-এর চাল-চলন, বেশভ‚ষা ও চেহারা-সুরত আপনি যেমন দেখতে পাবেন, দেখবেন ইতিহাস ও দর্শনের ইমাম ইবনে খলদুনের অবস্থাও তাই। তেমন কোনো পার্থক্য আপনার নজরে পড়বে না যে, ইনি দ্বীনের আলেম আর তিনি বৈষয়িক জ্ঞানী। উভয়ের জীবনযাপন, চলাফেরা, বেশভ‚ষা, লেবাস-পোশাক, এমনকি চিন্তাভাবনা এবং কথা বলার ধরন সব ছিল একই রকম। প্রসিদ্ধ মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানী ফারাবী, ইবনে রুশদ, আবু রাইহান আলবেরুনী প্রমুখের জীবনযাপন দেখুন আর মুহাদ্দিস মুফাসসির ও ফকীহগণের বেশভ‚ভূষা দেখুন, উভয়কে একরকম পাবেন। ইনি নামাজ পড়েন তো তিনিও নামাজ পড়েন। ইনি নামাজের মাসায়েল জানলে তিনিও তা জানেন। ইনি রোজার মাসায়েল জানেন তো তিনিও তা জানেন। ইসলামের মৌলিক ফরজে আইন পরিমাণ ইলম সে যুগে সবাই হাসিল করত। আর এই ইউনিভার্সিটিতে সেগুলো পড়ানো হত।
* কখন থেকে বিভাজন শুরু?
বিভাজন শুরু হল তখন থেকে, যখন ইংরেজরা এ দেশে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে একটি শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দিল। আর তা থেকে দ্বীনি বিষয়কে দেশান্তর করে দেওয়া হল। সে সময় আমাদের মুরব্বীগণ মুসলমানদের দ্বীন-ঈমানের ফরজে কিফায়াটুকু হেফাজতের স্বার্থে বাধ্য হয়ে দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেছেন। আলহামদু লিল্লাহ, দারুল উলূম দেওবন্দ খেদমত ও অবদানের যে স্বাক্ষর রেখেছে, ইতিহাসে তার দ্বিতীয়টি বিরল। তবে যাইহোক, এটা ছিল প্রয়োজনের স্বার্থে বিকল্প চিন্তা মাত্র।
বাস্তবতা তাই ছিল, যা ছিল জামেয়া কারাউয়্যীন -এ। জামেয়া যাইতুনিয়া এবং জামেয়া আযহারের প্রথম যুগে যা ছিল, তা-ই ছিল আমাদের বাস্তবতা।
পাকিস্তান যদি সঠিক অর্থে ইসলামি রাষ্ট্র হত এবং তাতে ইসলামি অনুশাসন কার্যকর থাকত তাহলে আব্বাজান রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী আমাদের আলীগড়ের শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ত না, নদওয়ারও না, এমনকি দারুল উলূম দেওবন্দের শিক্ষাব্যবস্থারও না। আমাদের তো প্রয়োজন জামেয়া কারাউয়্যীন, জামেয়া যাইতুনিয়াহর শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের প্রয়োজন এমন বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সকল শাস্ত্র সমানভাবে মর্যাদা পাবে। তাতে সবাই একই রঙে রঙীন হবে, দ্বীনের রঙে। কিন্তু আফসোসের কথা হল, আমাদের উপর এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা মানসিক দাসত্ব ছাড়া আর কিছুই শেখায় না। সেই শিক্ষাব্যবস্থা আমাদেরকে দাস বানিয়ে রেখেছে। আকবর এলাহাবাদী যথাযথ বলেছেন-
اب علیگڑھ کی بھی تم تمثیل لو ٭ یا معزز پیٹ تم اس کو کہو-
এবার আলীগড়ের প্রসঙ্গে আসি। একে তুমি সম্মানিত উদরও বলতে পার। কেবলই উদর পূর্তি ও উদর পালনের পথ ও পদ্ধতি আবিষ্কার করার জন্য বৃটিশ বেনিয়ারা আমাদেরকে এ শিক্ষাব্যবস্থা ‘উপহার’ দিয়েছে। আর এর মাধ্যমে মুসলমানদের গোটা ইতিহাস ও ঐতিহ্য বরবাদ করে দেওয়া হয়েছে।
আজকের প্রচলিত এই শিক্ষাব্যবস্থার দরুন অনিবার্যভাবে আমাদের সমাজে দু’টি সম্প্রদায় তৈরি হয়ে গিয়েছে। আর দুই দলের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে বিস্তর ফারাক। বৈষয়িক শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামি শিক্ষা না থাকার দরুন ফরজে আইনের ইলমও তাতে হাসিল হচ্ছে না। ফলে স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটির অধিকাংশ ছাত্র জানে না দ্বীনের ফরজ বিধান কী?
* সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসন
দ্বিতীয়ত তাদের মাঝে এই চিন্তা পুশ করে দেওয়া হয়েছে যে, উন্নতি যদি করতে চাও তবে তোমাকে পশ্চিমে তাকাতে হবে। তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। মোটকথা, তাদের মাথায় একথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এই দুনিয়ায় যদি উন্নতি করতে চাও তবে পশ্চিমের চিন্তায় তোমাকে চিন্তা করতে শিখতে হবে। অগ্রগতি লাভ করতে চাইলে তাদের মতো পরিবেশে, তাদের মতো করেই তা লাভ করতে হবে।
আফসোস এবং আশ্চর্যের বিষয় হল, এই নতুন শিক্ষাব্যবস্থা থেকে যারা গ্রাজুয়েট করে, ডক্টর, প্রফেসর হয়ে বের হয় তারা আমাদের মতো তালেবে ইলমদের উপর জোর আপত্তি তোলে যে, কুরআন-সুন্নাহ এবং ফিকহের একটি বড় বিষয় ছিল ইজতিহাদ। কিন্তু এই মৌলবীরা ইজতিহাদের দরজা বন্ধ করে রেখেছে। এরা ইজতিহাদ করে না।
কিন্তু যেসকল বিষয়ে ইজতিহাদ ও গবেষণার দরজা-জানালা চতুর্দিক থেকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত তা তো এসকল বৈষয়িক বিষয়াবলিই তাই নয় কি! সাইন্স, টেকনোলজি, গণিতসহ এসকল বিষয়ে তো কেউ ইজতিহাদের কপাট রুদ্ধ করেনি। আলীগড়ের মাধ্যমে কিংবা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আপনি কেন এমন মুজতাহিদ ও গবেষক তৈরি করলেন না, যারা পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারে? আপনি তাতে এমন উদ্ভাবক কেন প্রস্তুত করলেন না, যে চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে? যেখানে গবেষণা ও আবিষ্কারের চতুর্মুখ উন্মুক্ত সেখানে ইজতিহাদ করলেন না আর যেখানে কুরআন-সুন্নাহর পাবন্দি রয়েছে, কুরআন-সুন্নাহর বেঁধে দেওয়া সীমানায় থেকে যেখানে ইজতিহাদ করতে হয়, সেখানে আপনার আপত্তি হল, উলামায়ে কেরাম ইজতিহাদ কেন করেন না?
এই তো কয়েকদিন আগে এক ভাই আমার নিকট একটি ক্লিপ পাঠালেন। তাতে একজন আলেমে দ্বীনের নিকট প্রশ্ন রাখা হচ্ছিল- মাওলানা, উলামায়ে কেরামের খেদমত তো ঠিক আছে। কিন্তু আলেমদের কেউ তো বিজ্ঞানী হতে পারেননি। তাদের কেউ তো চিকিৎসক হতে পারেননি। তাদের কেউ কোনো আবিষ্কার দেখাতে পারেননি। বলুন, আলেম-সমাজের নিকট এর কি কোনো উত্তর আছে?
আল্লাহর বান্দা! এই প্রশ্ন তো আপনি আপনাকে করা উচিত ছিল। আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় এমন কেউ কি তৈরি হয়েছে, যে কিছু আবিষ্কার করেছে? না, সেখানে আবিষ্কার করা যাবে না! সেখানে তো আবিষ্কারের দরজা এভাবে খিল দিয়ে রাখা হয়েছে যে, ইংরেজরা যা বলবে তাই চূড়ান্ত কথা! পশ্চিমারা যে থিউরি দেবে সেটাই শেষ থিউরি! তারা যে ওষুধ বলে দেবে সেটাই একমাত্র ওষুধ! তারা যদি কোনো জিনিসের ব্যাপারে বলে দেয়, এটা সুস্থতা ব্যাহত করে। ব্যস, এখন এটাই চুড়ান্ত কথা। তা মানা আরম্ভ করে দেয়। ডিমের কুসুমের ব্যাপারে বছরকে বছর একথা বলা হচ্ছিল, এটা কোলেস্টরল তৈরি করে। হার্টের জন্য ক্ষতিকর। হঠাৎ করে এখন ডাক্টাররা বলা শুরু করেছেন, ডিমের কুসুম খাবেন। এতে কোনো সমস্যা নেই। কেন? পশ্চিম থেকে খবর এসেছে, তাদের থিউরি পরিবর্তন হয়েছে। আর আপনি তা গ্রহণ করে নিয়েছেন!
আমাদের দেশে ওষুধী গাছের অভাব নেই। আপনি তা নিয়ে কতটুকু গবেষণা করেছেন? আপনি গবেষণা করে এমন কোনো ফলাফল সামনে আনতেন যে, অমুক গাছের এই উপকার। অমুক গাছন্ত সেবনে অমুক অমুক রোগ সারে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালোজিরার উপকারিতার কথা বলেছেন। আপনি এটা নিয়ে গবেষণা করতেন!
কিন্তু বাস্তবতা হল, যেটা গবেষণার বিষয় সেখানে গবেষণা পুরোপুরি বন্ধ। সেখানে গবেষণার কোনো খবর নেই, ফিকির নেই। আর কুরআন-সুন্নাহ ও দ্বীনি বিষয়াবলি যত গবেষণার ক্ষেত্র!
বন্ধু! এটা হল চিন্তাগত দাসত্বের ফলাফল, যা আমাদেরকে এ পর্যন্ত এনে দাঁড় করিয়েছে।
* দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে
প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে আমাদের ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে জ্ঞান আহরণ ও বিদ্যা অর্জনের ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি একরকম ছিল। অর্থাৎ জ্ঞান একটি মহৎ গুণ। এর উদ্দেশ্যই ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণে অংশগ্রহণ করা। এর মাধ্যমে যদি কিছু জীবিকাও হয়ে যায়, তবে তা হত গৌণ পর্যায়ের। মুখ্য ছিল মূলত মানবতার সেবা।
কিন্তু আজ দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে গেছে পুরোই উল্টো। অর্থ উপার্জন জ্ঞান-বিদ্যার মূল উদ্দেশ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। এখন দৃষ্টিভঙ্গি হল, এ পরিমাণ জ্ঞান অর্জন কর, যাতে মানুষের পকেট থেকে বেশি থেকে বেশি পয়সা হাতিয়ে নেওয়া যায়। তোমার জ্ঞান ও বিদ্যা তখনই ফলপ্রসূ ও উপকারী বলে গণ্য হবে যখন তুমি অন্যদের চেয়ে বেশি পয়সা কামাই করতে পারবে।
আপনি লক্ষ করুন, বর্তমানে শিক্ষার হার কত বেড়েছে! কতজন গ্রাজুয়েশন করছে, মাস্টার্স করছে! বিভিন্ন রকমের ডিগ্রি অর্জন করছে! তাদের ভাবনার কাছে আপনি প্রশ্ন রাখুন, কেন পড়া-লেখা করছেন? জবাব মিলবে, ক্যারিয়ার যাতে উন্নত হয়। ভালো চাকরি পাওয়া যায়। ভালো পয়সা কামানো যায়। মোটকথা, শিক্ষার সকল মহৎ উদ্দেশ্য ধামাচাপা দিয়ে এ ভাবনা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে, জ্ঞান অর্জনের একমাত্র মৌলিক উদ্দেশ্য হল, টাকা কামানো আর পয়সা হাতানো। জ্ঞান অর্জন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রাখবে, এ দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অনুপস্থিত। ফলশ্রুতিতে যা হয়েছে, সবাই অর্থের পিছনে ছুটছে। না দেশের স্বার্থের প্রতি ভ্রুক্ষেপ, না সমাজ ও জাতির কল্যাণচিন্তা। আর না সৃষ্টির সেবায় নিবেদিত হওয়ার কোনো ফিকির। রাত-দিন একটাই চিন্তা, কীভাবে টাকা কামানো যায়, টাকা বাড়ানো যায়। আর এর জন্য যতসব দৌড়ঝাঁপ! তাই এখন আর হালাল-হারামের তোয়াক্কা নেই! নীতি নৈতিকতার খবর নেই!!
আপনি বলুন, প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে যারা পড়ালেখা করে যাচ্ছেন জাতিকে তারা কতটুকু দিতে পেরেছেন? নিঃস্বার্থভাবে তারা জাতির কতটুকু উপকার করতে পেরেছেন?
আমাদের নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আমাদেরকে এ দোয়া শিখিয়েছেন-
لَا تَجْعَلِ الدّنْيَا أَكْبَرَ هَمِّنَا وَلَا مَبْلَغَ عِلْمِنَا.
আয় আল্লাহ, আমাদের জন্য দুনিয়াকে আপনি এমন বানিয়েন না, যাতে সারাদিন আমাদের চিন্তা-ভাবনা এ নিয়েই আবর্তিত থাকে। আর (দ্বীন উপেক্ষা করে) দুনিয়াকেই আমাদের জ্ঞানের চূড়ান্ত চর্চার বিষয়ও বানিয়েন না। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৩১
কিন্তু প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের আখেরাতমুখী দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করে সম্পূর্ণ বস্তুবাদি বানিয়ে দিয়েছে।
আব্বাজান হযরত মুফতি মুহাম্মাদ শফী ছাহেব রাহ. যা বলেছেন, তার উদ্দেশ্য এটাই যে, বৃটিশদের দাসত্বের ‘কল্যাণে’ শিক্ষার যে ধারা পরিবর্তিত হয়েছে তা ফিরিয়ে ঐ পথে নিয়ে আসো, যা জামেয়া কারাউয়্যীন আমাদেরকে দেখিয়েছে। জামেয়া যাইতুনিয়া যা দেখিয়েছে। শুরুর দিকে জামেয়া আযহার যা দেখিয়েছে। আমি প্রথম যামানার কথা এজন্য বলছি যে, জামেয়া আযহারেরও বর্তমান ধারা পরিবর্তিত হতে চলেছে। তাই শুরুর দিককার কথা বলছি।
এতদঞ্চলে রাষ্ট্রীয়ভাবে সে ধারা কার্যকর হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে আমরা এ প্রচেষ্টায় রয়েছি যে, অন্তত দারুল উলূম দেওবন্দের ধারাটা যেন সংরক্ষিত থাকে। আলহামদু লিল্লাহ, এ উদ্দেশ্য নিয়েই মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্র পরিচালনানীতি এবং রাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষের প্রতি বর্তমানে আমাদের আস্থা ও ভরসা নেই। অদূর ভবিষ্যতেও আস্থা তৈরি হওয়ার কোনো অবকাশ এবং প্রত্যাশাও দেখা যাচ্ছে না। তাই যতদিন পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজ করবে, ততদিন পর্যন্ত আমরা আমাদের মাদরাসাগুলোর সম্পূর্ণ হেফাজত করব। দারুল উলূম দেওবন্দের নীতি ও আদর্শের উপর যেভাবে আমাদের আকাবির ও মুরব্বীগণ মাদরাসাগুলোকে প্রতিষ্ঠিত রেখে গেছেন আমরা সেভাবেই তার সুরক্ষা দেব। এর উপর কোনো প্রকার আঁচড় লাগুক, আমরা তা বরদাশত করব না, ইনশাআল্লাহ। তবে আমরা চাই, ধীরে ধীরে এ জাতি তার ঐতিহ্যে ফিরে আসুক। এরই ধারাবাহিকতায় হেরা ফাউন্ডেশনের এ ক্ষুদ্র পরিকল্পনা আপনাদের খেদমতে।
এখানে রঈসুল জামেয়ার সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়েছে। আমিও এ কথা প্রায়ই বলার চেষ্টা করি যে, আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে পাকিস্তানে দ্বীনি মাদারেসের সংখ্যা প্রয়োজন অনুসারে মোটামুটি হয়েছে। কিন্তু সকল মাদারাসা ফরজে কিফায়ার ইলম শিক্ষা দিচ্ছে। পুরো দেশের জনসংখ্যা অনুপাতে মাদরাসামুখী তালিবে ইলমের পরিমাণ শতকরা এক ভাগ হওয়াটাও মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। অবশিষ্ট নিরানব্বই ভাগ জনগণ কোন্ শিক্ষাব্যবস্থার অধীনে সমর্পিত হচ্ছে, কীভাবে ইংরেজদের মানসিক দাসত্ব বরণ করে নিচ্ছে, এর হিসাব-নিকাশের পর্বটা আপনি নিজেই সেরে নিতে পারেন।
আমি একথা বার বার বলেছি এবং বলেই যাচ্ছি, আল্লাহর দোহাই লাগে, আপনি আপনার প্রজন্মকে পশ্চিমাদের মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করুন। আমি এ চেতনা জাগ্রত করতে চাই, আলহামদু লিল্লাহ, আমরা একটি স্বাধীন সম্প্রদায়। আমরা চিন্তা-চেতনায় তাই লালন করি, যা লাভ করেছি আমাদের নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে।
মানসিক দাসত্বের এই যে প্রবণতা, উন্নতি অগ্রগতি পশ্চিমের পথেই রয়েছে। পশ্চিম থেকে আমদানি করেই আমরা সফলতা লাভ করব। আল্লাহর দোহাই, এমন মানসিকতা থেকে আপনার সন্তানের মগজ পবিত্র করুন। তাদের মাঝে দ্বীনি মানসিকতা জাগ্রত করুন। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখেই আমরা এ প্রতিষ্ঠান আরম্ভ করেছি।
পশ্চিমের সকল বিষয় ঢালাওভাবে পরিত্যাজ্য নয়। ভালো ভালো বিষয়ও রয়েছে তাদের কাছে। ভালোগুলো গ্রহণ করুন। খারাপগুলো বর্জন করুন। এভাবে যদি বাছ-বিচার করে চলতে পারেন তাহলে গন্তব্যে পৌঁছা সহজ হবে, ইনশাআল্লাহ।
* কবি ইকবাল সুন্দর চিত্রায়ন করেছেন-
কবি ইকবাল ভারি চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন। পশ্চিমা দুনিয়ার এই ‘অস্বাভাবিক উন্নতি’র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি যে কবিতা রচনা করেছেন আমাদের জন্য তা আজও দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
তিনি বলেন-
قوت مغرب نہ از چنگ ورباب ٭ نے ز رقص دختران بے حجاب۔
পশ্চিমের উন্নতি এজন্য নয় যে, সেখানে বাদ্যযন্ত্র আর বেপর্দা নারীর নৃত্যের অবাধ প্রচলন রয়েছে।
نے ز سحرساحران لا لہ روست٭ نے زعریاں ساق و نے قطع موست۔
এজন্যও নয় যে, সেখানে সুন্দরী রমণীর উন্মত্ত ও অবাধ নগ্ন বিচরণ রয়েছে।
قوت مغرب از علم و فن است٭ از ہمیں آتش چراغش روشن است۔
পশ্চিমের উন্নতি তো কেবল জ্ঞান-বিজ্ঞানে অক্লান্ত পরিশ্রম করার কারণে সাধিত হয়েছে। আর এই আলোয় তাদের বাতি আলোকিত হয়েছে।
এরপর ইকবাল মরহুম বড় চমৎকার সত্য বলেছেন-
حکمت از قطع و برید جامہ نیست ٭ مانع علم وہنرعمامہ نیست۔
পোশাক আশাকের ঠাটবাটের মাঝে প্রজ্ঞা নিহিত নয়। কেউ স্যুট বুট পরে স্যার বাবু সেজে গেল মানে শিক্ষিত হয়ে গেল, উন্নতি করে ফেলল! আর পাজামা-পাঞ্জাবি পাগড়ী পরল মানে উন্নতির ছোঁয়া বঞ্চিত সেকেলে হয়ে গেল- বিষয় এমন নয়।
কিন্তু আফসোস হল, তুমি এসব বিষয়কেই ভাবছ উন্নতি অগ্রগতির উপলক্ষ। তাই ছুটছ সেগুলোর পিছে। নিজেও ছুটছ বরবাদির দিকে আর সন্তানদেরও পরিচালিত করছ সে পথে। বন্ধু! একটু ফিকির কর। নিজেকে অন্তত হেফাযত কর।
ہاں دکھادے اے تصور پھر وہ صبح وشام تو ٭ دوڑ پیچھے کی طرف اے گردش ایام تو۔
কেউ বলতে পারে, এটা হল পশ্চাতপদতা। কিন্তু ইকবালের মতো যুগসচেতন কবি বলছেন, তুমি একটু পিছন দিকে তো হেঁটে দেখ!
হাঁ, সেই পিছন দিকে জামেয়া কারাউয়্যীন, জামেয়া যাইতুনিয়াহ-এর ইতিহাসে প্রত্যাবর্তিত হতেই আমাদের এ আয়োজন। এই উদ্দেশ্যেই ‘হেরা ফাউন্ডেশন স্কুল’। হযরত ওয়ালিদ ছাহেব রাহ.-এর নির্দেশনার ভিত্তিতেই আমাদের এ উদ্যোগ গ্রহণ। আলহামদু লিল্লাহ, আরো অনেকে এ দিকে মনোযোগী হয়েছেন। অনেক স্কুলও চালু হয়েছে, যাতে আমরা ঐতিহ্যে ফিরে যেতে পারি।
আপনারা এর কিছু কার্যক্রম লক্ষ করতে পেরেছেন। আলহামদু লিল্লাহ, ছুম্মা আলহামদু লিল্লাহ, অল্প ক’দিনেই আল্লাহ তায়ালা বেশ ফায়দা পৌঁছিয়েছেন। বলা ঠিক নয়, দোয়া নেওয়ার জন্য বলছি, আমার ছেলে মাওলানা আশরাফ উসমানী এবং তার সহকর্মীরা দিনরাত মেহনত করে সুচিন্তিতভাবে এর কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের মেহনতের কিছু ঝলক আপনারা দেখতে পেয়েছেন।
আমরা বাধ্য হয়ে এর সিলেবাস ইংলিশ মিডিয়াম রেখেছি। এখন তো জোয়ার চলছে। যারা এই জোয়ারে গা ভাসিয়ে সেই শিক্ষাব্যবস্থার দ্বারস্থ হন তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এ প্রোগ্রাম ইংলিশ মিডিয়ামে রাখা হয়েছে। নতুবা শিক্ষাব্যবস্থা মাতৃভাষাতেই হওয়া উচিত।
আমাদের এখানে পাশাপাশি হিফজুল কুরআন এবং আরবি ক্লাসের ব্যবস্থাও রয়েছে। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উর্দূও পড়ানো হয়। আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করি, তিনি একে কবুল করুন। নিজ মেহেরবানিতে আমাদের নিয়তে ইখলাস দান করুন। আমাদের চলার পথ মসৃণ রাখুন। সকল অনিষ্ট ও ফেতনা থেকে নিরাপদ রাখুন। তিনি তার সন্তুষ্টি মোতাবেক এ প্রোগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যান। মহান রবের দরবারে এই আমাদের মিনতি।
(লেখাটি মাসিক আলকাউসার নেওয়া হয়েছে)
এনএ/