রংপুর ব্যুরো
খেজুরের রস দেখলেই স্বাদ নেওয়ার ইচ্ছা হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। পায়েস বা পিঠা যদি খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি করা হয়, তার মজাই তো আলাদা। ভোরের কুয়াশা ভেদ করে পূর্ব দিগন্তে আভা ছড়াতে শুরু করেছে সূর্য। এরই মাঝে টাটকা রসের স্বাদ নিতে শীত আর কুয়াশা উপেক্ষা করে বাগানে ভিড় করছেন রসপ্রেমীরা। এদিকে শিশিরসিক্ত নরম ঘাস মাড়িয়ে হাঁড়িভরা খেজুরের রস গাছ থেকে নামিয়ে আনছেন গাছিরা। সেই রস জ্বাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু খেজুরের গুড়। এমন দৃশ্য চোখে পড়ে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নারগুন ইউনিয়নের বোচাপুকুর গ্রামের খেজুরবাগানে।
জানা যায়, ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের ১৬ বিঘা জমিতে রোপণ করা সাত শতাধিক ছোট বড় খেজুরের গাছ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বাগান। বাগানটি সাড়ে ৮ লক্ষ টাকা দিয়ে দুই বছরের জন্য লিজ নিয়েছেন মো. সেলম নামে এক ব্যক্তি।
গাছিরা বলেন, ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয়। পরে টিনের বড় তাওয়ায় জ্বাল দেওয়া হয় রস। আস্তে আস্তে রস শুকিয়ে রূপ নেয় সুস্বাদু গুড়ে। বিশেষ কিছু প্রক্রিয়া সেরে একপর্যায়ে তরল গুড় ঢালা হয় নির্দিষ্ট পাত্রে। পরে জমাট বেঁধে তৈরি হয় ঐতিহ্যবাহী হাজারী, পাটালি, নার্কেলী, দানা, ঝোলাসহ হরেক রকমের গুড়। প্রতি কেজি গুড় বাগানে বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে।
শনিবার ভোরে বোচাপুকুর এলাকায় দেখা যায়, শীতের সকালে কাঁচা রসের স্বাদ নিতে ভোররাত থেকে বিভিন্ন যানবাহনে করে ছুটে এসেছে খেজুর রসপ্রমীরা। ভোরের আলো ফোটার আগে মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয় বাগানের এলাকা। এদিকে খেজুরের রসকে নিরাপদ করার জন্য গাছের রস নামানোর জায়গাটি জাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে।
হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিব, সায়েম সোয়াইব বলেন, অনেক দূর থেকে কুয়াশার মধ্যে তাজা রসের স্বাদ নিতে ছুটে এসেছেন তারা। দল বেঁধে রস পান করা বেশ উপভোগ্য।
এসময় স্কুলশিক্ষক সালেহ আহমেদ বলেন, খেজুরের খাঁটি রস শহরে পাওয়া যায় না, এমনকি গ্রামেও এখন সচরাচর দেখা যায় না। ঠান্ডায় বের হতে কষ্ট হলেও রস খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে চলে এসেছি বাগানে।
সেতাবগঞ্জ থেকে আসা ব্যবসায়ী জামিরুল খন্দকার বলেন, ভোর ৪টার দিকে রওনা দিয়ে ৬টার দিকে এসে পৌঁছে রসের বেশ চাহিদা থাকায় কাঁচা রস পান করতে পারেননি তিনি। তবে পরিবারের জন্য পিঠা তৈরির জন্য খেজুরের গুড় নিয়ে যাবেন। খেজুরের রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির জন্য নাটোর থেকে আনা হয়েছে গাছি শরিফুল ইসলামসহ সাত সদস্যের দল।
গাছি শরিফুল ইসলাম বলেন, শীত মৌসমে টানা তিন থেকে চার মাস ধরে রস ও গুড় তৈরর প্রক্রিয়া চলবে। তারা দৈনিক মজুরি পান ১ হাজার ২০০ টাকা। গুড় তৈরির মৌসুম শেষে ফিরে যাবেন স্বজনদের কাছে। গাছি জাকির হোসেন বলেন, প্রতিট খেজুর গাছ থেকে ১০ থেকে ১২ লিটার রস হাঁড়িতে পড়ে। ৫ থেকে ৬ হাজার লিটার রস থেকে গুড় তৈর হয় প্রায় ১০০ কেজি।
এ বিষয়ে বাগান লিজ গ্রহণকারী মো. সেলম বলেন, এই বাগানের খেজুরের গুড়ের স্বাদ ও মিষ্টতা খেজুরের গুড় উৎপাদনকারী প্রসিদ্ধ জেলাগুলোর মতোই। কাঁচা রস বিক্রির পাশাপাশি নির্ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি করা হচ্ছে। প্রতিদিন বাগানে বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার গুড় ও রস।
ঠাকুরগাঁও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাসায়নিকমুক্ত নিরাপদ গুড় তৈরিতে উদ্যোক্তাদের সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। খেজুরের গুড়ের সুনাম ধরে রাখতে জেলা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে গাছ লাগানো হচ্ছে।