দাওরায়ে হাদিস সনদ বাস্তবায়নের দাবি: কিছু কথা
প্রকাশ:
০৬ মে, ২০২৫, ০৩:৫৫ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
![]()
|| ওয়ালিউল্লাহ আজিজী || ২০১৭ সালে কওমি মাদরাসার ‘দাওরায়ে হাদিস’ সনদকে মাস্টার্সের সমমান দেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ঐতিহাসিক এই আইনটি পাস হয়। কিন্তু ছয় বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এই স্বীকৃতি এখনো কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। বাস্তব ক্ষেত্রে কওমি শিক্ষার্থীরা চাকরি কিংবা উচ্চশিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে এখনো বঞ্চিত রয়েছেন। অথচ তাদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। (২৫ লাখ/৪৫ লাখ/৬৫ লাখ বিভিন্ন গণনায় বিভিন্ন রকম দেখানো হয়েছে) এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে দাওরায়ে হাদিস সনদধারীদের সরকারি বেসরকারি কর্মক্ষেত্রগুলোতে চাকরির সুযোগ প্রদান এবং দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রদানের বিষয়ে সম্প্রতি আল-হাইয়াতুল উলয়ার একটি প্রতিনিধি দল ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। এটি অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তারপরও প্রস্তাবিত চাকরির ক্ষেত্রসমূহ পর্যালোচনা করার এবং সেগুলোর সমালোচনা করার সুযোগ রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। চাকরির ক্ষেত্র সীমিত কেন? বর্তমানে দাওরায়ে হাদিস সনদধারীদের জন্য যে চাকরির ক্ষেত্রগুলো প্রস্তাব করা হয়েছে, তা প্রধানত ধর্মীয় কর্মক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ—ইমাম, খতিব, কাজি, ধর্মীয় শিক্ষক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বা জেলখানার ধর্মীয় উপদেষ্টা ইত্যাদি। যদিও এই পেশাগুলোর গুরুত্ব অনস্বীকার্য, তবুও এটি দাওরায়ে হাদিস সনদধারীদের প্রকৃত যোগ্যতা ও সক্ষমতার প্রতি একটি সীমাবদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। কওমি মাদরাসার পাঠ্যক্রমে কেবল ইসলামি জ্ঞানই নয়; যুক্তিবিদ্যা, দর্শন, ভাষাবিজ্ঞান, সাহিত্য, ফিকাহ, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বসহ বহু বিষয়ের গভীর চর্চা হয়। বহু কওমি শিক্ষার্থী এখন প্রবন্ধ রচনা, অনুবাদ, গবেষণা, ডিবেট, পাবলিক স্পিকিং, ইংলিশ স্পিকার এমনকি তথ্য-প্রযুক্তিতেও দক্ষতা অর্জন করছে। সেই জায়গা থেকে তাদের শুধু ধর্মীয় পরিসরে চাকরি প্রদানের মানসিকতা অবিচারসুলভ। আরও বিস্তৃত সুযোগ প্রদানের প্রয়োজনীয়তা রাষ্ট্রের দক্ষ ও সুশিক্ষিত নাগরিক হিসেবে কওমি সনদধারীদেরও অন্য শিক্ষাব্যবস্থার ছাত্রদের মতো সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার অধিকার রয়েছে। যেমন: ১. প্রশাসন ও সরকারি সেবা: সিভিল সার্ভিস বা প্রশাসনিক ক্যাডারে নির্ধারিত শর্তপূরণ সাপেক্ষে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। যদি একটি মাস্টার্স সমমানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তবে তা যেন অন্যান্য মাস্টার্স ডিগ্রির মতোই গণ্য হয়—এটাই ন্যায্য দাবি। ২. গবেষণা ও শিক্ষাক্ষেত্র: বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা থিংক ট্যাংকে ইসলামি চিন্তাবিদ ও গবেষকদের অভাব রয়েছে। এই শূন্যস্থান পূরণে কওমি পটভূমির গবেষকদের ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি করা দরকার। ৩. আইন ও বিচার বিভাগ: পারিবারিক আইন ও শরিয়াহ আইনসংক্রান্ত বিষয়ে কওমি সনদধারীরা বিশেষভাবে দক্ষ। শরিয়াহ্ বোর্ড, ফতোয়া বিভাগ, পারিবারিক আদালত ইত্যাদিতে তাদের নিয়োগ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর করে তুলতে পারে। ৪. মিডিয়া ও সাহিত্যচর্চা: বহু কওমি শিক্ষার্থী বাংলা, উর্দু ও আরবি সাহিত্যে পারদর্শী। সাংবাদিকতা, স্ক্রিপ্ট রাইটিং, ইসলামি মিডিয়া প্রডাকশন ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এখানে উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো। এছাড়াও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় শর্তসাপেক্ষে কওমি সনদধারীদেরকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করার সুযোগ দিলে দেশ ও জাতি তাদের থেকে ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে। শেষ কথা দাওরায়ে হাদিস সনদকে শুধু ধর্মীয় পেশায় সীমাবদ্ধ রাখার চিন্তা কওমি ছাত্রদের প্রতি একটি সংকীর্ণ রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে আসা ছাত্ররা শুধু ইমাম, খতিব বা কাজি নয়, বরং গবেষক, শিক্ষক, প্রশাসক এমনকি রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারক হিসেবেও ভূমিকা রাখতে পারে—যদি তাদের যোগ্যতা বিচার করে সমান সুযোগ প্রদান করা হয়। রাষ্ট্র কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা বজায় রেখেই তাদের জাতীয় উন্নয়নে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, বিশ্বাসের জায়গা তৈরি এবং সর্বোপরি একটি বাস্তবমুখী, ইনক্লুসিভ নীতি গ্রহণ। তাহলে কেবল স্বীকৃতি নয়, প্রকৃত অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে কওমি শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয় জীবনের প্রাণস্রোতে যুক্ত হতে পারবে। লেখক: ফাযেল, জামিয়া রাহমানিয়া আজিজিয়া, বছিলা, মোহাম্মাদপুর, ঢাকা এমএইচ/ |