তাফসিরে বায়জাবি: পাঠ-পঠন
প্রকাশ: ১৮ এপ্রিল, ২০২৫, ১০:৪১ দুপুর
নিউজ ডেস্ক


|| মাওলানা আব্দুল কাদির মাসুম ||

আমাদের দরসে নেজামিতে কিছু কিতাব আছে যেগুলোর মুখাতাব আমাদের এ যুগের তালিবুল ইলম ভাই-বোনেরা না। যেমন বায়জাবি, মুখতাসার, সুল্লাম, হুসামি, শরহে মোল্লা জামি প্রভৃতি। এ কিতাবগুলো একেতো সম্পূর্ণ মানতিকি তরজে লিখিত, দ্বিতীয়ত বাক্যগুলো খুবই ইজাযপূর্ণ (অতি সংক্ষিপ্ত ও কঠিন বাক্য সম্বলিত)। আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রহ. বলেছেন, ‘এসব কিতাবের মুখাতাব আসলে তারা যারা আরবির কাদিম উসলুবে বেশ দক্ষ।’ 

আমাদের যুগের তালিবুল ইলম ভাইদের নফসে কায়দা ও মূল মাসআলার-ই ব্যাপারে খবর নেই তো নেই-ই; অনেকাংশ সহিহ করে আরবি কয়েক জুমলা ফিলবদিহ (জটপট) লিখতেই জানে না, দালায়েল ও ইললসম্পৃক্ত উচ্চমানের বই দিলে কী হাশর ঘটবে তাদের- তা সহজেই অনুমেয়। 

তাছাড়া হিজরি ৬ষ্ঠ শতক থেকে নিয়ে অষ্টম শতক পর্যন্ত সময়টি ছিল উলুমে ইসলামিয়ার উরুজ ও উৎকর্ষের যুগ। তখনকার উলামাগণের কার থেকে কে কঠিন ও দুর্বোধ্য করে বই লিখতে পারেন- সে প্রচেষ্টা থাকত। 'দরিয়া কো কুজা মেঁ ভর দিয়া' (কলসিতে সাগর ঢুকিয়ে দেওয়া) এর প্রতিফলনের প্রতিযোগিতা চলত। ইমাম বায়জাবি রহ.সপ্তম শতকের মানুষ। তাহলে তাঁর কিতাবাদির হালত বুঝতেই পারছেন। আর বর্তমানে ইলমি অধঃপতন কোন পর্যায়ের তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তো উস্তাদগণ এ কিতাবগুলো পড়াতে অনেক বেগ পোহাতে হয়। অনেক সময় লাগিয়ে ভালো করে নিজে মুতালাআ করতে হয়, আত্মস্ত করতে হয়, প্রদেয়তব্য তথ্যগুলো জেহেনে বসাতে হয় এবং শেষে পরের দিন ছাত্রদের কাছে 'উসলুবে ইলকা' ঠিক করতে হয়, কখনো নোটও করতেই হয়। মোটকথা, অন্যান্য ৪/৫ কিতাব মুতালাআয় যা সময় যায় সেই এক কিতাবই ওই সময় নিয়ে নেয়। উপরন্তু এগুলোর দরস যেন মাথার ওপর দিয়ে যায়। অধিকাংশ ছাত্ররাই এসব কিতাবের দরস তাহাম্মুলের লায়েক না। ফলে এ ঘণ্টাগুলোতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে না তারা। এজন্য এসব কিতাবের ঘণ্টা সহজে কেউ নিতে চায় না।

বায়জাবি অধমের নেসাবে কয়েক বছর ধরে থাকার ফলে এর সাথে আমার কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন হয়েছে। এর পাঠ-পঠন নিয়ে কিছু আলাপ আমি নোট করে রেখেছি। যার বিস্তারিত বিবরণ অধমের লিখিত «مدخل إلى تفسير القاضي» কিতাবে এসেছে। কিতাবটি পড়াতে গিয়ে যেভাবে মুতালাআ করা যেতে পারে:—

ক. মুসান্নিফের মুকাদ্দিমা পড়ানোর সময় হাশিয়া বিল ইসতিআব পড়া। সাথে হাশিয়াতু শিহাব ও হাশিয়াতুল কুনাবী যেরে মুতালাআ রাখা। শায়খ আবুল কালাম যাকারিয়া রহ.-এর ‘তাকরীরে কাসেমী’ পুরো মুতালাআয় থাকা।

খ. সুরা ফাতেহা পড়ানোর সময় প্রথমে ‘তাকরীরে হাবী’ ও মুফতী নুর আহমদ সাহেবের ‘দরসে বায়যাবী’ পড়ে কথাগুলো জেহেনে বসানো। এরপর শিহাব ও কুনাবী পুরো দেখা। উসুলভিত্তিক কথার জন্য হাশিয়াতুশ শিহাবের জুড়ি-ই হয় না। আর নকদ ও তানকিদের ক্ষেত্রে হাশিয়াতুল কুনাবী লা-ছানী তাফসির ভাষ্য। এরপর ‘হাশিয়াতুল কা যা আবাদী’ (حاشية القاذ آبادي)-টা পড়া। এটি শুধু ফাতিহার ওপরই লিখিত। খুবই চমৎকার।

গ. বাকারাহ পড়ানোর সময় ‘তাকরীরে হাবী’ ও শাইখ সালেহ আহমদ সালেক সাহেবের ‘আত তাশরীহুল হাবী’ পুরো মুতালায় রাখা যেতে পারে। হজরত মাওলানা সালেহ আহমদ সালেক সাহেব দা. বা. অত্যন্ত সহজ করে বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছেন। সহজে বোঝাতে শাইখ পালনপুরী রহ.-এর কলমের তরজ এতে সুনিপুণভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। 
আর হাশিয়াতুল কুনাবী থাকা চাই যেরে মুতালাআয়। 

ঘ. বায়জাবির একটি হাশিয়া আল্লামা ইবনে আবেদিন শামি (সাহেবে ফাতাওয়ায়ে শামি) রহ-এরও আছে। এটি অতিসংক্ষেপ হলেও বেশ জামে'মানে'। কিছু জায়গায় এমন তথ্য এনেছেন যা কোনো মুফাসসির উল্লেখ করেননি। সেটা সংগ্রহ করে পড়লে অনেক এযাফি ইলম হবে।

ঙ. সুরা বাকারা পড়ানোর সময় অন্যান্য তাফসিরও মুরাজাআত করা দরকার, বিশেষত রুহুল মাআনি, তানতাবির ‘তাফসিরে ওসিত’ বা ‘আবুস সাউদ’ প্রভৃতি। কারণ বায়জাবি রহ. অনেক জায়গায় রাজেহ বা আওলা কওল বাদ দিয়ে মারজুহ বা গায়রে মুসতাহছান আকওয়ালও এনেছেন।

চ. বায়জাবি রহ. আমছাল, নছর বা শের-আশআর দিয়ে ইসতেদলাল করে তাফসির বিল-ইজতিহাদের যে ঝলক দেখিয়েছেন তা ছাত্রদের সামনে তাফসিলি আলোচনা কাম্য। কারণ এগুলো ছাত্রদের মাঝে তাফসিরি মালাকা তৈরি করে।

ছ. বায়জাবিতে আসা রেওয়াতগুলোর ওপর ফন্নি নকদানা আলোচনা কাম্য। 

জ. বায়জাবির কোনো জায়গায় বেশি দুর্বোধ্য লাগলে কাশশাফ ও তাফসির কবিরের দিকে মুরাজাআত করা যেতে পারে। কারণ তিনি তাফসিরি আলোচনাগুলোর বেশির ভাগ এই দুই তাফসির থেকেই নিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত ইবারতে উল্লেখ করেছেন।

লেখক: শিক্ষক, জামেয়াতুল খাইর আল ইসলামিয়া, সিলেট।

এমএম/