বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান: সংকট ও সমাধানের উপায়
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০৫:৩৫ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

|| মুহাম্মাদ শোয়াইব || 

বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো ইসলামি শিক্ষার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৩,৮২৬টি কওমি মাদ্রাসা ছিল, যেখানে ১৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছিল। ঐতিহাসিকভাবে দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাক্রম অনুসরণ করেই এসব মাদ্রাসা পরিচালিত হয় এবং সরকারিভাবে কোনো আর্থিক অনুদান ছাড়াই স্থানীয় জনগণের সহায়তায় পরিচালিত হয়।

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও অন্যান্য ইসলামি বিষয়ের পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, আরবি ও উর্দু ভাষা শেখে। অনেক ক্ষেত্রে কিছুটা ফার্সিও শিক্ষা দেওয়া হয়। যদিও সাধারণ শিক্ষা হিসেবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা, গণিত, ইংরেজি, ভূগোল, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ানো হয়, তবে উচ্চ স্তরে আধুনিক শিক্ষার সুযোগ সীমিত।

কর্মসংস্থানের সংকট

প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী দাওরায়ে হাদিস (সমমান মাস্টার্স) সম্পন্ন করে বের হলেও, তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুবই সীমিত। তাদের প্রধান কর্মস্থল মাদ্রাসা ও মসজিদ হওয়ায়, যারা এসব জায়গায় চাকরি পান না, তারা কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হন।

অনেক শিক্ষার্থী শৈশব থেকেই মাদ্রাসার পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে বাহ্যিক জগতের কর্মসংস্থান সম্পর্কে সচেতন হন না। তাছাড়া, কিছু আলেম তাদের বক্তব্যের মাধ্যমে এমন ধারণা প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, কওমি শিক্ষার্থীদের মাদ্রাসা ও মসজিদের বাইরের কাজ করা উচিত নয়। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী অন্য পেশায় যেতে ভয় পান, কিংবা দোটানায় ভুগেন।

প্রকৃতপক্ষে, কওমি শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা মাদ্রাসা বা মসজিদে চাকরি পান না, তারা জীবিকার তাগিদে নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত বা অনুপযুক্ত কর্মে যুক্ত হতে বাধ্য হন। অনেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান (যেমন চল্লিশা, তিনদিনা) আয়োজন করে উপার্জনের চেষ্টা করেন, যা অনেক ক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যায়।

ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা ও বাস্তবতা

অনেক সময় বলা হয় যে, পূর্বসূরী আলেমরা কেবল মসজিদ-মাদ্রাসায় কাজ করতেন এবং সেখান থেকেই তাদের জীবিকা নির্বাহ হতো। কিন্তু এই ধারণাটি ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা। গবেষক গরিব আব্দুল বাসেত তার লিখিত الطرفة فيمن نسب من العلماء إلى مهنة أو حرفة কিতাবে প্রায় ১,৫০০ জন পূর্বসূরী ইসলামী ব্যক্তিত্বের জীবনী সংকলন করেছেন। তার গবেষণা অনুযায়ী, এই বিশিষ্ট আলেমদের মধ্যে প্রায় ৪০০ ধরনের পেশায় নিযুক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যায়।

এই ৪০০ পেশার মধ্যে কেবল মসজিদ বা মাদ্রাসা-ভিত্তিক কাজ ছিল না; বরং তারা কৃষিকাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, হস্তশিল্প, সাহিত্য রচনা, বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসনিক কাজ, চিকিৎসা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন। এটি প্রমাণ করে যে ইসলামের প্রাথমিক যুগের আলেমরা শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, বরং জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন পেশায় নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতেন।

এই সমস্যার সমাধানের জন্য ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি আইটি, উদ্যোক্তা শিক্ষা, ব্যাংকিং, ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য কারিগরি প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। আধুনিক ভাষা ও যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ইংরেজি ও প্রযুক্তি শিক্ষার প্রসার ঘটানো উচিত। পাশাপাশি মসজিদ মাদ্রাসার সাথে সাথে  বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা উচিত।

মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্পোরেট ও ইসলামী এনজিও সেক্টরে চাকরির সুযোগ তৈরি করা যেতে পারে। যাতে তারা ইসলামি অর্থনীতি, হালাল ব্যবসা, মিডিয়া ও গবেষণার মতো খাতে অবদান রাখতে পারেন।আলেমদের উচিত কওমি শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবন ও কর্মসংস্থানের ব্যাপারে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া।

ইসলামের ইতিহাসে পূর্বসূরীদের কর্মজীবন সম্পর্কে প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া উচিত, যেখানে দেখা যায় তারা বিভিন্ন ধরনের পেশায় নিযুক্ত ছিলেন।

কওমি শিক্ষার্থীরা যদি ছোট ব্যবসা, ফ্রিল্যান্সিং বা কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে শেখে, তাহলে তারা স্বাবলম্বী হতে পারবে।

সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার উচিত কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের জন্য কর্মমুখী প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা।

কিছু উন্নয়ন সংস্থা ও ইসলামি ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান বিশেষ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে পারে।

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে এক বিশাল মানবসম্পদ। এই জনশক্তিকে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো সম্ভব। আলেমদের উচিত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, যাতে শিক্ষার্থীরা শুধু ধর্মীয় জ্ঞান নয়, বরং বাস্তব জীবনের প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করে সম্মানজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়।

বর্তমানে, বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবা এবং কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ইসলামের প্রথম দিকের আলেমরা বহু বৈচিত্র্যময় পেশায় নিযুক্ত ছিলেন, যা আজকের প্রেক্ষাপটেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। সুতরাং, বর্তমান আলেম ও শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজন যুগোপযোগী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা, যাতে তারা আখেরাতের পাশাপাশি দুনিয়ার জীবনেও সাফল্য লাভ করতে পারেন।

হাআমা/