মানবজীবনে আদব অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: বায়তুল মোকাররমের খতিব
প্রকাশ:
০২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫, ০৬:৪৮ বিকাল
নিউজ ডেস্ক |
শুক্রবার ৩১ জানুয়ারি) বাদ মাগরিব জামিয়া উসমানিয়া দারুল উলুম সাতাইশ মাদ্রাসার মসজিদে ওলামা-তালাবা, আইম্মায়ে মাসাজিদ এবং টঙ্গীস্থ দ্বীনপ্রিয় মুসলমানদের সামনে ইসলাহি বয়ান পেশ করেন বরেণ্য হাদিসবিশারদ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সম্মানিত খতিব মুফতি মওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক। বয়ানটি রেকর্ড থেকে অনুলিখন করেছেন মুফতি মাহবুবুর রহমান নোমানী সব মানুষের জীবনে আদব অতি অপরিহার্য বিষয়। আর আলেমের জন্য আরও বেশি অপরিহার্য। আদববিহীন আলেম জগতের জন্য আজাবস্বরূপ। আলেমতো রহমতস্বরূপ হওয়ার কথা। কিন্তু তার মধ্যে যদি আদব না থাকে তাহলে রহমতের পরিবর্তে সে আজাব হয়। আদব মানে সৌন্দর্য। অর্থাৎ যে কাজটি যেভাবে, যেই পদ্ধতিতে হওয়া দরকার সেভাবে এবং সেই পদ্ধতিতে হওয়া হচ্ছে আদব। ইলম শিখার আদব আছে, ইলম শিখানোর আদব আছে। তালেবে ইলমের সর্বাবস্থায় আদব রয়েছে। আমাদের উস্তাদ আব্দুর রাজ্জাক ইস্কান্দার রহ. বলতেন, "তালেবে ইলম যাহা ভী হু তালেবে ইলম হ্যাঁয়।" মাদ্রাসায় থাকলে তালেবে ইলম, বাজারে গেলে তালেবে ইলম, বাড়িতে গেলে তালেবে ইলম। অর্থাৎ চলাফেরায়, কথাবার্তায় সর্বাবস্থায় সে তালেবে ইলম হয়ে থাকবে। তাকে দেখে যেন বুঝা যায়, সে অমুক হুজুরের ছাত্র, অমুক মাদ্রাসার ছাত্র। প্রতিটা মানুষের জন্য আদব অপরিহার্য। কিন্তু আহলে ইলমের জন্য আরও বেশি অপরিহার্য। আমরা ছোটবেলায় উস্তাদের মুখে শুনেছি, এক মন ইলমের জন্য দশ মন আকল দরকার। পরে যা শুনেছি তা আরও গুরুত্বপূর্ণ। তা হলো, সামান্য ইলমের জন্য অনেক আদবের দরকার। যেমন, এক কেজি আটা খামিরা করার সময় সামান্য লবন লাগে। তোমার ইলম হচ্ছে, লবন আর আটা হচ্ছে আদব। এই যামানায় মাদ্রাসাপড়ুয়া এক ব্যক্তি, যার নামের সাথে মাওলানা লেখা হয়, সে বয়ানও করতে পারে। কিন্তু পুরো দুনিয়ার জন্য সে আজাব হয়ে আছে। কেন? আদবের অভাবে। শিখার সময় আদব ছিল না। এটা আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে জেনেছি। এখন সে মিম্বারে বয়ান করে, ইজতেমায় বয়ান করে। কিন্তু বয়ানেও আদব নেই। এই আদবের অভাবে জগতবাসীর জন্য আজাব হয়ে আছে। টঙ্গীর জন্যও আজাব হয়ে আছে। বলতে পারেন, কী বেয়াদবি করেছে? ইলমের সাথে বেয়াদবি করেছে, নিজের উস্তাদের সাথে বেয়াদবি করেছে, নিজের বাবার উস্তাদ, দাদার সহকারী সবার সাথে বেয়াদবি করেছে। ইলমের দাওয়াত, ইলমের তাবলিগ, ইলমের তালিম সবকিছুর সঙ্গে বেয়াদবি করেছে। ইলম পৌঁছানোর আদব আছে। ইলম বিতরণের আদব আছে। কিন্তু সে ঘন্টার ঘন্টা বয়ান করে মনগড়া। কিছু কিতাব থেকে, কিছু নিজের থেকে বানিয়ে বয়ান করে। মুস্তাহাব বিষয়কে ফরজ বানিয়ে দিচ্ছে। আর দাবি করছে, আমি দাওয়াত ও তাবলীগের কাজকে সীরাতের আলোকে নিয়ে যাচ্ছি। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত আগাগোড়া পুরাটাই হাদিস শরীফে রয়েছে। তিনি দাবি করছেন, এই কাজকে তিনি সীরাতের উপর ওঠাচ্ছেন। এটা সীরাতের সাথে বেয়াদবি। দাওয়াত ও তাবলীগ গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এর অনেক শাখা প্রশাখা হতে পারে। ইলিয়াছ রহমাতুল্লাহ আলাইহি একটা পদ্ধতি চালু করেছেন। তাহলো গাটলি-বোঁচকা নিয়ে মসজিদে মসজিদে যাওয়া। সাহাবায়ে কেরাম বিবি বাচ্চা, ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে থেকেই দাওয়াতের কাজ করেছেন। কোরআনের আল্লাহ বলেছেন- رجال لا تلهيهم تجارة ولا بيع عن ذكر الله واقام الصلاه সবকিছুর ভেতরে থেকে আল্লাহকে স্মরণ করা, দাওয়াতের কাজ করা সহজ নয়। এর জন্য পাকা ঈমান লাগে। তোমরা দুর্বল ঈমানদার। কাজেই তোমরা ঘর থেকে বের হয়ে মসজিদে মসজিদে দাওয়াতের কাজ করো। বেতলব মানুষের মধ্যে তলব সৃষ্টি করো। বয়ান পারো না, তবুও বয়ানের জন্য দাঁড়িয়ে যাও। তোমার বয়ান থেকে কেউ শিখতে আসবে না। কারণ, মানুষ বুঝে এটা বয়ানের প্রশিক্ষণ। এভাবে দুই চার কথা বলতে বলতে, শুনতে শুনতে নিজের ভিতরে এলেমের তলব আসবে। তখন আলেমদের কাছে গিয়ে বাকী এলেম শিখবে। যা শিখেছো তার শুদ্ধ- অশুদ্ধের তমিজ করবে। এটা ছিল ইলিয়াস রহ এর তাবলীগের উদ্দেশ্য। এখন এই লোক বয়ান করতেই থাকে, করতেই থাকে। কোন পড়াশোনা নাই, প্রস্তুতি নাই, হযরতজীর কিছু বায়ানাত দেখে সারা দুনিয়ার সব কিছু বলতে থাকে। ভুল বলল নাকি শুদ্ধ বলল খবর নাই। আয়াতের বিকৃতি, হাদিসের বিকৃতি, ইসলামী পরিভাষার বিকৃতি, নতুন নতুন হাদিস বানানো, নতুন বিধান আবিস্কার, নতুন ফরজ আবিষ্কার, নতুন হারাম আবিষ্কার ইত্যাদি চলছেই। এগুলো ভুল বশত বললে একরকম। কিন্তু ইচ্ছাকৃত বললে আরও মারাত্মক। আমরা যতটুকু জেনেছি, তিনি এসব ইচ্ছে করেই বলে। আমি ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই— জুমার নামাজের পর চার রাকাত নামাজ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। এখন অনেকেই সালাম ফিরিয়েই চলে যায়। এই মুয়াক্কাদা নামাজ পড়ে না। বাড়িতে পড়লে তো ভালো। তবে হয়তো বাড়িতে পড়ে না। এখন ইমাম সাহেবের দায়িত্ব হচ্ছে, মুসল্লিদেরকে এ ব্যাপারে ব্যাপারে তারগিব করা, এই নামাজ পড়ার জন্য উৎসাহিত করা। কিন্তু ইমাম যদি বলে, বাদাল জুমা চার রাকাত নামাজ সুন্নাত নয়, ফরজ। কেউ এই নামাজ না পড়লে তার জুমার নামাজই হবে না। তাহলে এটা কি দাওয়াত হবে? এটা কি দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি নয়? ঠিক এই কাজটাই করছেন মাওলানা সাদ সাহেব। সে ভাবছে, মানুষ তাবলিগ করে না, চিল্লা লাগায় না। এগুলোকে মুস্তাহাব মনে করে। ব্যস, এসবকে ফরজ বলে দিল। একাজে অবহেলা করলে, বিলম্ব করলে গোনাহ হবে বলে দিল। এসব কথা তার বয়ানের মধ্য স্পষ্টভাবে রয়েছে। এরপরও কিছু মানুষের সন্দেহ। তিনি গোমরাহ কি গোমরাহ না? আহলে সুন্নাতের বাইরে কি বাইরে না? তারা বলে দেওবন্দ তো তাকে আহলে সুন্নাহর বাইরে বলেনি। তো দেওবন্দ কী বলেছে? দেওবন্দ বলেছে, আহলে সুন্নাহর রাস্তা ছেড়ে উনি হাঁটছেন। এটা কী বুঝায়? আহলে সুন্নাহর বাইরে আর আহলে সুন্নাহর রাস্তা থেকে সড়ে হাঁটছেন এক কথা নয় কি? শরীয়তের বিধানে যেই লোক হাত দেয়, সে আহলে সুন্নাহর গন্ডির বাইরে কিনা, গোমরাহ কিনা এ ব্যাপারে যার সন্দেহ সে দ্বীন-শরীয়তের বুঝে কিছু? তার গোমরাহ হওয়ার জন্য তো এটাই যথেষ্ট যে, সে পুরো বিশ্বে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। মসজিদে মসজিদে, ঘরে ঘরে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে দিয়েছে। যে বুঝে এ থেকেই বুঝতে পারে। আর যে বুঝে না, সে বলে ইলিয়াছ রহ এর খান্দানের লোক, নিজামুদ্দীনের লোক ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের দ্বীন -শরীয়তে ব্যক্তির চাইতে, খান্দানের চাইতে হক বড়, জায়গার চাইতে হক বড়। যেখানে সে নাহক কথা বলছে, গোমরাহি কথা বলছে, শরীয়তে হস্তক্ষেপ করছে, আয়াতের বিকৃতি করছে, হাদিসের বিকৃতি করছে, সীরাতের বিকৃতি করছে, নবী-রাসূলদের সমালোচনা করছে এই সবকিছু ভুলে গিয়ে খান্দান নিয়ে পড়ে আছো? তোমাকে সাদপন্থি হতে হবে? অনেকে বলে, উনার মাধ্যমে আমি তাবলীগে এসেছি। উনি সাদপন্থি তাই আমিও সাদপন্থি। আহারে, কী গোমারাহি কথা? এতে তো ঐ ব্যক্তির প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। কারণ, তার কারণে তাবলিগে এসে এখন তার সাথে ভুল পথে চলে ঐ লোকের গোনাহের পাল্লা ভারী করছে। এটা তার প্রতি জুলুম। অনেকে ওলামায়ে কেরামকে অবজ্ঞা করে বলে, উনারা তাবলীগের কী বুঝে? উনারা কি তাবলীগের কাজ করে? অথচ সমস্ত দ্বীনী কাজের অভিভাবক হচ্ছেন ওলামায়ে কেরাম। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সহিহ বুঝ দান করুন। হাআমা/ |