সহিহ বুখারি শেষ করার তাওফিক আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ! যাঁরা এই উম্মতের সবচেয়ে সফল মনীষী ছিলেন, তাঁরা সহীহ বুখারী পড়েছেন, পড়িয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে আমাদের মধ্যে তেমন কোনো যোগ্যতা নেই। এটা মুখের কথা নয়, বাস্তবতা। তবু আল্লাহ তাআলা পড়ার তাওফিক দান করেছেন। এর শোকর আদায় করার উপযুক্ত ভাষা নেই। শুধু বলি, اللهم لك الحمد ولك الشكر

এই যে দ্বীন শেখার ও বোঝার সিলসিলাতুয যাহাব- স্বর্ণধারা, যা সাহাবায়ে কেরাম থেকে উলামায়ে দেওবন্দ পর্যন্ত পৌঁছেছে, তার সাথে যুক্ত হওয়া মহাসৌভাগ্যের বিষয়। আমরা নিজেদেরকে এই সোনালি ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি এটা আমাদের বড় পাওয়া। আমরাও ইনশাআল্লাহ সেই নূরানি ধারার একেকটা বিন্দু। اللهم لك الحمد كله ولك الشكر كله، اللهم لك الحمد كما ينبغي لجلال وجهك وعظيم سلطانك-

রব্বে কারীমের কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে মৃত্যু পর্যন্ত এই ধারার  সঙ্গে  যুক্ত রাখেন। এই ধারার সকল ফুয়ূয ও বারাকাত দান করেন। আমীন। 

এই ধারা থেকে যথাযথভাবে উপকৃত হওয়ার জন্যে আমাদের কিছু সিফাত অর্জন করতে হবে:

এক. নিজেকে মওত পর্যন্ত তালিবে ইলম মনে করবো। 

‘তালিবে ইলম’ (ইলম অন্বেষী) একটা লকব, একটি অভিধা। মৃত্যু পর্যন্ত এই লকব নিজের মধ্যে ধারণ করবো এবং অন্তরে লালন করবো। এটাকে নিজের জন্যে গর্বের মনে করবো। অন্তরে সর্বদা এ কথা পুষব যে, আমি একজন তালিবে ইলম। আমার কাজ ইলম তলব করা, ইলমের জন্য আত্মদান করা, ইলম-অন্তপ্রাণ হওয়া। 

প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের প্রয়োজনে মানুষ হয়ত আমাকে বলবে- মুদাররিস, মুফতি, মুহাদ্দিস। এটি তাদের বিষয়; ইন্তিজামী প্রয়োজনে বলছে। কিন্তু আমার উপলব্ধি থাকতে হবে- আমি নিতান্তই একজন তালিবে ইলম; আমি মুদাররিস তালিবে ইলম, হয়তো আমি মুফতি তালিবে ইলম...। এই অনুভূতি অন্তরে ধারন করবো। তাহলে ইনশাআল্লাহ ইলমের প্রতি শওক-যওক (আগ্রহ-উদ্দীপণা) বাড়বে। ধীরে ধীরে ইলম ফাহম আসবে। প্রতিদিন ইলম ও ফাহম বৃদ্ধি হতে থাকবে। মুহাসাবা করতে হবে, আজ কী পরিমাণ ইলম বৃদ্ধি পেল। যদি না বাড়ে তাহলে خسارة (ক্ষতি)।

দুই. ফোকাহায়ে আবেদীনের সাথে জুড়ে থাকবো। 

ইলম ও ফাহম কার কাছ থেকে নিবো? কোন উৎস থেকে গ্রহণ করবো? ফিকরে নিরাপত্তা কীভাবে আসবে? ফাহাম কীভাবে সালীম হবে? 

এর জন্য পদ্ধতি হলো- حيث ما كنت كن قرب فقيه ‘যেখানেই থাকো, একজন ফকীহ ফিদ-দ্বীনের নিকটে থাকো’। তাঁর সংশ্রব গ্রহণ করো। তাঁর কাছ থেকে ইলম ও ফাহম হাসিল করো। তাঁর বয়ান-আলোচনা শুনো। তাঁর সঙ্গে মশওয়ারা করো। তাঁর লিখিত কিতাব পড়ো। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- شاوروا الفقهاء العابدين ‘ইবাদাতগুজার ফকীহগণের মশওয়ারা নাও'। 

মশওয়ারা মানে- ইলমী মশওয়ারা। শুধু জাগতিক-পারিবারিক বিষয়ে মশওয়ারা নয়। এটা তো করবোই। মূলত ইলমী বিষয়ে মশওয়ারা করবো, যেমন ইমাম আবু হানীফা রহ. করেছেন। ইলমী বিষয়ে মশওয়ারার জন্যে তিনি চল্লিশ সদস্যের ফিকহী বোর্ড গঠন করেন। এই বোর্ডের সাথে মাশওয়ারা করেই তিনি ফিকহে হানাফী পত্তন করেছেন। 

নিজের বুঝের ওপর অতি ইতেমাদ, মোহমুগ্ধতা এখন বড় ফেতনা। যেটা বুঝলাম, সেটাই প্রচার করে দিলাম। কোনো মশওয়ারা নেই, মোযাকারা নেই, মনে হলো আর বলে দিলাম। অথচ জরুরি ছিল- ফকীহ উলামায়ে কেরামের তাওছীক গ্রহণ করা। এটা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ, ফুকাহায়ে আবেদীনের সাথে মশওয়ারা করো। তোমার ফিকির সঠিক কি না যাচাই করো।

বর্তমানে ফিকরের কোনো নিরাপত্তা নেই। চিন্তাধারার উপর চতুর্মুখী হামলা হচ্ছে । আমি নিজের ইলম ও ফাহমকে নিরাপদ রাখার জন্য শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি। যেকোনো মুহূর্তে (আল্লাহ না করুন) বাতিলে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারি। বেউসুলি আমাকে গ্রাস করে নিতে পারে। তাই বলব, যদি ফিকরের সালামতি ও নিরাপত্তা (الأمن الفكري) চাও, তাহলে ফকীহ ফিদদ্বীন এর সোহবতে যাও। যাদের দ্বীনের সঠিক বুঝ আছে, গভীর সমঝ আছে, তাঁদের সোহবতে থাকো। এর জন্য চেষ্টা করো। দোয়া করো।

আহলে ইলমের সাথে চলাফেরা উঠাবসা হওয়া সমঝদারির আলামত- من فقه الرجل ممشاه ومدخله ومخرجه مع أهل العلم এই বিশেষণ অর্জন করো।

তিন. মুসলিহ হওয়ার আগে নিজে সালেহ হওয়ার ফিকির বেশি করবো।

উর্দুতে একটা কথা আছে- پیر نابالغ کسی کام کا نہیں ہوتا অর্থাৎ ‘যে পাকার আগে পেকে যায়, সে কোনো কাজের হয় না।’ সালেহ না হয়ে মুসলিহ হওয়ার ধান্ধা- এর নাম ‘পীরে না-বালেগ’। 

স্বাভাবিক নিয়মে প্রত্যেক জিনিষ পাকার একটা সময় আছে। প্রাকৃতিকভাবে প্রতিটি বস্তু পরিপক্ক হওয়ার একটা মেয়াদ আছে। যে এই সময় আসার আগে পেকে যায়, সে কাজের হয় না। সময়ের আগে পেকে গেছে। মুরব্বী বনে গেছে এমন পীরে না-বালেগ কাজের হয় না। ফেতনা আর বিভ্রান্তি ছড়ায়। নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, উম্মতকে ক্ষতিগ্রস্থ করে। তোমরা পীরে নাবালেগ হয়ো না, সময়ের আগে পেকে যেও না।

কৃষক বীজতলায় বীজ ছিটায়। এরপর সেখান থেকে চারা উঠিয়ে জমিতে রোপন করে। বীজ ছিটানোর সময় কিছু বীজ দূরে গিয়ে পড়ে। কিছু চারা বিচ্ছিন্ন থাকে। ওগুলো অঙ্কুরেই মোটা হয়ে ওঠে। সেগুলো কৃষক উপড়ে ফেলে দেয়। রোপন করে না। ওটা থেকে ধান হয় না। এটা পীরে না-বালেগের উদাহরণ। 

আম পাকার একটা মৌসুম আছে। জৈষ্ঠ মাসে আম পাকে। পরিপুষ্ট হওয়ার আগে যদি কোনো আম পেকে যায় অর্থাৎ রং হলুদ হয়ে যায়  তা অপুষ্ট থাকে। ঝরে পড়ে। খাওয়ার উপযুক্ত হয় না। পীরে না-বালেগের আরেকটা উদাহরণ।

পরিপক্ক হতে হলে দীর্ঘ সবর করতে হবে। ম্যাচিউর্ড হতে হলে অনেক ধৈর্য ধরতে হবে। যাদের সবর নেই, তারা ‘পীরে না-বালেগ’ হয়। তাই পড়তে হবে। মুযাকারা অব্যাহত রাখতে হবে। ফকীহ ফিদদ্বীনের সোহবত গ্রহণ করতে হবে। তাঁর কাছ থেকে সমঝ-ফাহম হাসিল করতে হবে। এরপর বিতরণের সময় আসবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে বুঝার ও মানার করার তাওফিক দান করুন, আমীন।

শ্রুতিলিখন
মাওলানা আব্দুর রহমান সিলেটী
শিক্ষক, জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগ

এমএইচ/