জুলাই চব্বিশ গণঅভ্যুত্থান: হাসান আল মাহমুদ
প্রকাশ:
১১ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৫:১০ বিকাল
নিউজ ডেস্ক |
|| হাসান আল মাহমুদ || ৫ আগস্ট ২০২৪। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন। টানা ১৫ বছর ক্ষমতার দাপট দেখানো আওয়ামী লীগ স্বৈরশাসনের অবসাট ঘটে এ দিন। জামাত-বিএনপি, হেফাজতে ইসলামসহ রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমসমাজসহ সর্বশ্রেণির প্রতিটি মানুষ দীর্ষ ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হন। সকল শ্রেণি-পেশার ক্ষোভ গণ বিক্ষোভে রূপ নেয় ২০২৪ সালে এসে। অবশেষে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে গণভবন থেকে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ‘সি-১৩০জে’ হারকিউলিস পরিবহন বিমানযোগে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেন জগদ্দল পাথরের মত চেপে থাকা বাংলার ইতিহাসের প্রভাবশালী স্বৈরশাসক- শেখ হাসিনা। আন্দোলনের নেতৃত্বে: আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামে বাংলাদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংগঠন। স্কুল-কলেজ, মাদরাসা-ভার্সিটির সর্বশ্রেণির শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ২০২৪ সালের ১ জুলাই এটি গঠিত হয়। আন্দোলন সফল করতে ৮ জুলাই সংগঠনটি ৬৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি ঘোষণা করে, যার মধ্যে ২৩ জন সমন্বয়ক ও ৪২ জন সহ-সমন্বয়ক ছিলেন। আন্দোলনের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার পর ৩রা আগস্টে সংগঠনটি দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ১৫৮ সদস্যের সমন্বয়ক দল গঠন করে, যার মধ্যে ৪৯ জন সমন্বয়ক ও ১০৯ জন সহ-সমন্বয়ক ছিলেন। শুরুর পর্যায়: বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন করে। ৫ জুন হাইকোর্ট ২০১৮ সালে সরকারের কোটা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। ৬ জুন আদালতের রায়ের প্রতিবাদে ও কোটা বাতিলের দাবিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা বিক্ষোভ করে। ৭ জুলাই শিক্ষার্থীরা `বাংলা ব্লকেড’-এর ডাক দেয়, যার আওতায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, মহাসড়ক অবরোধ ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে। ৮, ৯ জুলাই একই রকম কর্মসূচি পালন করা হয়। জুলাই মাসজুড়ে আন্দোলন: শুরুতে আন্দোলন সভা-সমাবেশের মধ্যে স্থির থাকলেও ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের পরোক্ষভাবে `রাজাকারের নাতি-পুতি’ হিসেবে অভিহিত করেন, প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে `তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” এবং `চাইতে গেলাম অধিকার; হয়ে গেলাম রাজাকার` স্লোগান দেয়। এর পরেরদিন ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা, মন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে `মুক্তিযুদ্ধের চেতনা` নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। একই দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থী ও আন্দোলনকারীদের উপর রড, লাঠি, হকি স্টিক, রামদা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করা হয়। একই সাথে পুলিশও লাঠি, রাবার বুলেট দিয়ে হামলা করে। প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরাও তাদের দিকে ইটের টুকরা ছুড়ে ও উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এসব হামলায় ১৬ জুলাই থেকে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হলে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গের মত পুরো দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। ইন্টারনেট বন্ধ: কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হলে ১৭ জুলাই (বুধবার) রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) রাত ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। টানা পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর ২৩ জুলাই সীমিত পরিসরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু হয়। অন্যদিকে টানা দশ দিন বন্ধ থাকার পর ২৮ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট সেবা চালু হয়। পরে জানা যায়, সরকারি নির্দেশেই ইন্টারনেট বন্ধ ছিল। আন্দোলনে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো: বিগত ১৬ বছরে সবচে বেশি নির্যাতনের শিকার দেশের আলেমসমাজ ও ইসলামি দলগুলো। স্বৈরাচার আ.লীগের কাছে কোণঠাসা ছিল দলগুলো। বিভিন্ন সময়ে রক্ত দেওয়া এই দলগুলো এবার জেগে ওঠেছে। দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থীদের পাশে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ ইসলামি দলগুলোর ভূমিকা ছিল ছব্বিশের গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনের গতি বৃদ্ধিকারক। আন্দোলনে ইমাম-খতিব: শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলছিল তুমলভাবে। গুলি খাচ্ছে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছে দেশের মসজিদগুলো। মসজিদের ইমাম-খতিবগণ বয়ানে আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে শিক্ষার্থীদের পাশে জনগণকে আহ্বান জানান। এসময় অনেক খতিবের চাকরি চলে যায়। আ.লীগ সন্ত্রাসীদের নানা হামলার শিকার হন অনেক ইমাম-খতিব ও মাদরাসার শিক্ষকরাও।
আন্দোলনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ: আন্দোলনে অকুন্ঠ সমর্থন ছিল উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের। ২ আগস্ট ২০২৪ হেফাজত আমীর আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে হেফাজত জানায়, আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এখন আর কোটা নিয়ে নয়; ছাত্রহত্যার বিচারের দাবিতে পরিণত হয়েছে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ ও নিন্দা ছড়িয়ে পড়েছে। এই শাসকগোষ্ঠীর হাতে ছাত্রহত্যার বিচার আকাশ-কুসুম কল্পনা মাত্র। ৫ মের শাপলা চত্বরে শহীদ হেফাজতকর্মী ও মাদরাসাছাত্রদের খুনের বিচার গত দশ বছরেও করা হয়নি। এক্ষেত্রে সরকারের কোনো বিকার নেই; অনুতাপ নেই। বরং বারবার নির্দয় অস্বীকারের দুঃসাহস দেখেছি আমরা। সুতরাং, হত্যাকারীর কাছে হত্যার বিচার চেয়ে কোনো প্রতিকার আসবে না। এই জালিম শক্তির ধ্বংস ছাড়া এদেশে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তার মিথ্যা আশ্বাসে প্রতারিত হবেন না। আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, আজকে নির্বিচার গুলি, গণগ্রেপ্তার, গুম ও অন্যায়-জুলুমের বিরুদ্ধে এবং ছাত্রহত্যার বিচারের দাবিতে দল-মত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধ। আমাদেরও অকুন্ঠ সমর্থন রয়েছে। আমরা রক্তে ভেদাভেদ করি না। ন্যায়ের পক্ষে এবং জুলুম-বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিহতরা শহীদ। আর শহীদদের রক্ত কখনো বৃথা যায় না। তাদের রক্তের পথ বেয়েই আমাদের জাতীয় জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে, ইনশাআল্লাহ। আমি ছাত্রসমাজকে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে যাওয়ার আহবান জানাচ্ছি। এর আগে ১৮ জুলাই ২০২৪ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে ছয় শিক্ষার্থী হত্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলায় ছয় শিক্ষার্থী হত্যার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ও মহাসচিব আল্লামা শায়েখ সাজেদুর রহমান সংবাদমাধ্যমে এক বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে নেতৃদ্বয় বলেন, ঢাবিসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শান্তিপ্রিয় শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে ছয় শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েদেরকেও পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়েছে। এমনকি হাসপাতালে ঢুকেও আহতদের ওপর হামলা করা হয়েছে। যুদ্ধের ময়দানেও নারীদের ওপর আক্রমণ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনেরও চরম লঙ্ঘন। অথচ আলোকিত জাতীয় বিদ্যাপীঠে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নৃশংস হামলা কোন বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারে না। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তারা বলেন, কোটা সংস্কারের দাবি অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত একটি দাবি। কোটার নামে মেধাবীদের বঞ্চিত করা জুলুম। ইসলাম সব ধরনের জুলুম ও বৈষম্যের বিপক্ষে। সংবিধান অনুযায়ী কোটা প্রাপ্যদের সাথে সঙ্গতি রেখে ন্যায়ানুগ অনুপাতে আলোচনার মাধ্যমে কোটা সংস্কার করে বিদ্যমান সঙ্কট ও অস্থিরতার নিরসন করা সম্ভব। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ রাখা জরুরি। দমন পীড়নের মাধ্যমে সমাজকে বিভক্ত করলে তা রাষ্ট্রের শেকড়কে দুর্বল করে দেয়। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। তারা আরো বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তানের মতো। তারা দেশের ভবিষ্যত। আলোচনার মাধ্যমে তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবির সমাধানের জন্য সরকারের নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি। আমরা নিহতদের পরিবারকে গভীর সমবেদনা এবং আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থার জন্য দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া তারা আহতদের দ্রুত সুস্থতা এবং নিহতদের মাগফিরাত কামনায় দেশবাসীর নিকট দু'আর আহ্বান জানিয়েছেন। ১ আগস্ট ২০২৪ হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি আগামীকাল বাদ জুমা দেশব্যাপী দোয়ার আহ্বান জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর আল্লামা শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী দেশের চলমান উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে আগামীকাল বাদজুমা দেশব্যাপী দোয়া করার আহ্বান জানিয়েছেন । আজ (১ আগষ্ট) বৃহস্পতিবার বা'দ আসর জামিআতুল মানহাল উত্তরায় মহাসচিব আল্লামা শায়েখ সাজিদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে হেফাজত আমীর ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করে এ আহ্বান জানান । তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে দেশব্যাপী নিরীহ ছাত্রদের সাথে প্রশাসনের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শত শত ছাত্র-জনতা নিহত হয়েছেন, হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। যৌক্তিক এ আন্দোলনকে দমন করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক ছাত্র জনতার ওপর বলপ্রয়োগ ও বেপরোয়া নির্যাতন চালানো হচ্ছে। এছাড়া বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতাকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমীরে হেফাজত আরও বলেন, চলমান নাজুক পরিস্থিতিতে আসুন আমরা সকলেই আমাদের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। আল্লাহ তওবাকারীদের ভালোবাসেন। আমি দেশের সকল মসজিদের ইমাম ও খতীবদেরকে কূনুতে নাজেলা পড়ে দেশ ও জাতির কল্যানে এবং বিচার বহির্ভূত জুলুম থেকে নিরস্ত্র মানুষকে হেফাজতের জন্য দু’আ করার জন্য বিশেষভাবে আহবান জানাচ্ছি। বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে মহাসচিব আল্লামা শায়েখ সাজিদুর রহমান গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সমগ্র দেশকে গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যে কালো ইতিহাস রচনা করা হয়েছে, তার পূঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য তাৎক্ষণিক জানা সম্ভব হচ্ছিল না। পরবর্তিতে বিভিন্ন মিডিয়ার কল্যাণে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, সেগুলো রীতিমতো রোমহর্ষক ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ পরিস্থিতিতে দেশের সর্বত্র আতঙ্কময় ভয়াবহ এক অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। দেশে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। তিনি বলেন, ইসলামে কুরআন হাদিসের আইন বহির্ভূত সব রকম হত্যা, রক্তপাত, অরাজকতা, সন্ত্রাস ও সহিংসতাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআ'লা বলেন, কেউ যদি কোনো মুসলমানকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তাহলে তার শাস্তি চিরস্থায়ী জাহান্নাম। আর আল্লাহ তার প্রতি ক্রোধাণ্বিত হবেন, তাকে লা'নত করবেন এবং তার জন্য তিনি মহাশাস্তি প্রস্তুত করবেন। (সূরা নিসা- আয়াত নং ৯৩) আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন, নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল; আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল। (সূরা মায়িদাহ-আয়াত নং ৩২) হত্যা এমন একটি জঘন্য অপরাধ, যা আল্লাহর কাছে কঠিন ও মারাত্মক গুনাহ হিসেবে বিবেচিত এবং এর শাস্তি অত্যান্ত ভয়ানক। আল্লাহ তাআ'লা এই ব্যাপারে আমাদেরকে কুরআনুল কারিমে সতর্ক করেছেন। তিনি আরো বলেন, সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- ছাত্রদের কাউকে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হবে না, মামলাও দেবে না; কিন্তু সারা দেশে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে এবং নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। একদিকে সরকার সহানুভূতির কথা বললেও অন্যদিকে ছাত্র জনতার ওপর হামলা ও মামলা অব্যাহত রেখেছে। আমরা সরকারের এই আচরণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। দেশের এই উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য অবিলম্বে সরকারকে সব ধরনের রাজনৈতিক অপকৌশল, নির্যাতন, নিপীড়ন এবং অহেতুক হামলা ও মিথ্যা মামলার হয়রানি বন্ধ করতে হবে। সরকারের প্রতি তিনি জোর দাবি জানিয়ে আরো বলেন, দ্রুত সময়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল করুন। সাথে সাথে ছাত্রদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে তা বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে দেশে শান্তি শৃংখলা ফিরিয়ে আনুন। কোটা সংস্কার ছাত্র আন্দোলনে দেশজুড়ে যেই নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে, তার নিরেপক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করুন। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিন। এছাড়া এখন পর্যন্ত যারা নিখোঁজ রয়েছে তাদের সন্ধান দিন এবং জনসম্মুখে দ্রুত হাজির করুন। তিনি বলেন, গত কয়েকদিনে দেশ ও জাতির জান-মালের যে সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা বর্ণনা করা অসাধ্য ব্যাপার। এই সংঘাত এবং অরাজকতা এখনই বন্ধ করতে হবে। কালক্ষেপণ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে, এ দাবি এখন শুধুমাত্র ছাত্রদের দাবি নয়। এটা আজ জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। তাই আমরা সরকার প্রধানসহ দায়িত্বশীল মহলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা এ বিষয়ে সর্বোচ্চ বিনম্রতার পরিচয় দিয়ে সর্বাগ্রে ছাত্র জনতার যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নিন। এছাড়া প্রশাসনের দায়িত্বরত ব্যক্তিদের প্রতি আহবান থাকবে, বিক্ষোভকারী ছাত্র জনতার সাথে সর্বোচ্চ সহনশীল আচরণ করুন। এই আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারবর্গ ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতি গভীর শোক ও সমবেদনা জানিয়ে হেফাজত মহাসচিব আল্লামা শায়েখ সাজিদুর রহমান বলেন, আমরা নিহতদের মাগফিরাত এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি। আমরা নিহতদের পরিবার, পরিজনদের ক্ষতিপূরণ প্রদাণ করতে এবং আহতদের দ্রুত সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। এছাড়া এই আন্দোলনে যারা হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তিনি হেফাজতের নেতাকর্মী ও দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান। এ সময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, মাওলানা মুহিউদ্দিন রাব্বানী, মাওলানা নাজমুল হাসান কাসেমী, মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী, মুফতি মুনির হুসাইন কাসেমী, মুফতি বশিরুল্লাহ, মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন, মাওলানা মুসা বিন ইজহার, মুফতী কিফায়াতুল্লাহ আজহারী, মুফতি কামাল উদ্দিন, মুফতি জাকির হুসাইন কাসেমী, মুফতী আনিসুর রহমান ,মাওলানা আফসার মাহমুদ, মাওলানা রাশেদ বিন নূর, মাওলানা শরিফুল্লাহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। সমন্বয়কদের এক দফা দাবি: ৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম সরকার পদত্যাগের এক দফা আন্দোলন ঘোষণা করেন। এক দফা ঘোষণার সময় শহীদ মিনারে আরও উপস্থিত ছিলেন অন্যান্য সমন্বয়করা। তারা হলেন নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও আবদুল কাদের। শুরুতে ৬ই আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন "লং মার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচি ঘোষণা করে। তবে পরিস্থিতি নাজুক বিবেচনায় সমন্বয়করা কর্মসূচি একদিন এগিয়ে এনে ৫ই আগস্ট ঘোষণা করেন। ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট ২০২৪: আগস্টের ৫ তারিখ। ওই দিন বেলা ১১টার পর থেকে ঢাকার পথে ঢল নামে মানুষের। কারফিউ উপেক্ষা করে বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করেন তারা। এক পর্যায়ে শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। এদিকে এদিন গণভবনে দুপুরের খাবার রান্না করা ছিল। কিন্তু খাওয়ার সময়ও ছিল না। এর আগে ৪ আগস্ট রাত থেকেই প্রস্তুত ছিল বিমানবাহিনীর `সি-১৩০ জে’ ট্রান্সপোর্ট বিমান। কিন্তু হাসিনার পালানোর নাটকের প্রথম ধাপটি ছিল গণভবনের ভেতরে একাধিক বৈঠক। গভীর রাতে সেনাপ্রধানসহ তিন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে উত্তেজনার চরম পর্যায়ে পৌঁছান শেখ হাসিনা। রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে তিনি বলেন, "আমাকে গুলি করে মেরে ফেল।" সেনা কর্মকর্তারা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু কোনোভাবেই তার অনড় মনোভাব বদলাতে পারছিলেন না। গণভবনে ৪ আগস্টের রাতটি ছিল ঘটনাবহুল। সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে পদত্যাগের পরামর্শ দিলে তিনি রাগারাগি করে তাদের সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলেন। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে, তার বোন শেখ রেহানা তাকে শান্ত করার জন্য পা জড়িয়ে ধরেন। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাথে ফোনে কথা বলার পর পদত্যাগে রাজি হন। বিজয়ের দিন: ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপেক্ষিতে সৃষ্ট অসহযোগ আন্দোলনের ফলে ফ্যাসিস্ট সরকার শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে বিজয় হয় ছাত্র-জনতার। দেশের মানুষ বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে। এ যেন নতুন আরেক স্বাধীনতা। ঢাকার মানুষের উপচে পড়া ঢেউ পড়ে সংসদ ভবন ও শেখ হাসিনার বাসস্থান গণভবনের দিকে। স্রোত নামে মানুষের। মিছিলে মিছিলে স্লোগান তুলে ‘পালাইছেরে পালাইছেরে, শেখ হাসিনা পালাইছে’। ক্ষোভে পতিত স্বৈরাচারের ব্যবহৃত সকল কিছু তুলে নিয়ে এনে পথে পথে উল্লাস করে জনতা। আন্দোলনে শহীদ ও আহতরা: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ি জুলাই বিপ্লবে শহিদের সংখ্যা ১৪২৩, আহত ২২ হাজার। এ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা খুব দ্রুত করা হবে বলে জানিয়েছে গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল। আন্দোলনে মাদরাসা শিক্ষার্থীরা: স্কুল-কলেজ, ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মাদরাসার শিক্ষার্থীরাও অংশ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। অংশ নেয় ইসলামি ছাত্র সংগঠনগুলোও। সকল শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পতন হয় স্বৈরাচারি শেখ হাসিনা সরকারের। তবে এই আন্দোলনে ঝরে যায় বহু প্রাণ। সেই তালিকায় রয়েছে অসংখ্য মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ৭৭ জন শহীদ আলেম-শিক্ষার্থীদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ‘তরুণ আলেম প্রজন্ম’। তালিকাবদ্ধ ছাড়া আরো অনেক মাদরাসা শিক্ষার্থীর জীবন গেছে এই আন্দোলনে। সর্বশেষ (এই লেখা তৈরীর সময় ২৩ ডিসেম্বর) রোববার (২২ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে দশটায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিন মাস হসপিটালে চিকিৎসারত থাকা গণঅভ্যুত্থানে গুলিবিদ্ধ মাদরাসা শিক্ষার্থী মো. আরাফাত (১১)। গত ৫ আগস্ট ২০২৪ উত্তরার আজমপুর পূর্ব থানার সামনে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। আরাফাতের বাবা মো. শহীদুল ইসলাম জানিয়েছেন, আরাফাত ঢাকার উত্তরা ৫ নং সেক্টরে অবস্থিত জামিয়া রাওজাতুল উলুম মাদরাসায় কিতাব বিভাগের ইবতেদায়ী প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত ছিলেন। এর আগে কুরআন শরীফের নাজেরা শেষ করে তিন পাড়া মুখস্থ করেছিলেন। বিজয় পরবর্তী সময়: ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট বিজয়ের পর নতুন বাংলাদেশে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের প্রতিনিধি দল এবং সেনাবাহিনী প্রধান দ্বারা এ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। এরপর ৮ই আগস্ট ২০২৪ শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইইনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ৬ আগস্ট সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন বলে ঘোষণা দেন। নতুন এই সরকারে উপদেষ্টা মোট ২৪ জন, যাদের মধ্যে তিনজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। এসময় শিক্ষার্থীরা নতুন দেশ সাজাতে আন্দোলনের নানা চিত্র আঁকে দেয়ালে দেয়ালে। মাদরাসা শিক্ষার্থীর আঁকা ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়’নামে এক দেয়াল গ্রাফিতি দেশজুড়ে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। উপসংহার: এখনো নানামুখি ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। ভারতে পালিয়ে দেশের বিরুদ্ধে নানা উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। ভিন্ন নামে ও দলে আন্দোলন করে দেশে অরাজকতা সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সকল দল ও দেশের জনগণকে সাথে নিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল ও নিরাপদ রাখতে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের ইমাম-খতিব, মাদরাসা শিক্ষক, ইসলামি বক্তা, রাজনীতিবিদ আলেমগণ দেশের পক্ষে যে কোনো ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় জনগণকে আহ্ববান জানিয়ে যাচ্ছেন। হাআমা/ |