আজ ঐতিহাসিক লংমার্চ দিবস, সেদিন আমি যা দেখলাম
প্রকাশ:
০২ জানুয়ারী, ২০২৫, ০৫:৪৪ বিকাল
নিউজ ডেস্ক |
|| মাওলানা মুহসীনুল হাসান || আজ ২ জানুয়ারি। শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর নেতৃত্বে যশোরের বেনাপোল হয়ে অযোধ্যা অভিমুখী ঐতিহাসিক লংমার্চ সংঘটিত হয় এদিন। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে বাবরি মসজিদ ভাঙা হলে এর প্রতিবাদে ময়দানে ঝাপিয়ে পড়েন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক্ব রহ:। পরদিন বায়তুল মোকাররাম দক্ষিণ গেটে শায়খুল হাদিসের সভাপতিত্বে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে বিশাল সমাবেশ অনুষ্টিত হয়। তিনি গোটা জাতিকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদে অবতীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের ডাক দেন।আলেম সমাজের পক্ষ থেকে এই ন্যাক্কার জনক ঘটনার প্রতিবাদে ৮ই ডিসেম্বর দেশ ব্যাপী সকাল- সন্ধ্যা হরতাল ঘোষণা করা হয়। ১২ ডিসেম্বর মাগরিব পর সাংবাদিক সম্মেলনের আহবান করা হয়। এতে মূল বক্তব্য রাখেন আজিজুল হক্ব রহ:। তিনি প্রায় ৫শ বছরের পুরোনো এই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের তীব্র নিন্দা জানান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে ভয়াবহ মুসলিম নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি এ সকল ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে ২রা জানুয়ারি ঢাকা থেকে যশোরের বেনাপোল হয়ে অযোধ্যা অভিমুখী ঐতিহাসিক লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২রা জানুয়ারি ১৯৯৩ সাল লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছিল জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সামনে।জন সমুদ্রের মাঝ থেকে উঠে উদ্বোধনী ভাষণ দেন বাবরী মসজিদ আন্দোলনের অবিসংবাদিত সিপাহসালার শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক্ব রহ:। তার হৃদয়বিদারক ভাষণ শুনে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার ব্যথায় কেদেই ফেলেন অনেকে।দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্যে তিনি ঘোষণা করে ছিলেন, এ লংমার্চ পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে মানবতার মহাযাত্রা।আমাদের এ লংমার্চ হবে অহিংস। সংখ্যালঘুদের অহেতুক ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেননা তাদের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন নয়। প্রধান অতিথি হিসেবে লংমার্চনেতার দিক-নির্দেশনার পর দেশবরেণ্য আলেমদের নেতৃত্বে মহামুক্তির মিছিল শুরু হয়। ঢাকার মানুষ এমন মিছিল এর পূর্বে কখনো দেখেনি। ৪ঠা জানুয়ারি সকাল ১০ টায় যশোর বাস টার্মিনালে যখন সমাবেশ শুরু হয়,তখন যশোরের মাটিতে জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ। এত বিশাল সমাবেশ যশোরবাসী দ্বিতীয়টি দেখেনি। যারা সেদিন সেই সমাবেশে উপস্হিত ছিল তাদের বক্তব্য হচ্ছে, পুরো যশোরজুড়ে ছিল মানুষ আর মানুষ। মনে হচ্ছিল, গোটা যশোর জেলা পল্টন ময়দানের মত কোন সমাবেশ স্থল। সমাবেশ শেষ করে কাফেলা যাত্রা শুরু করে অযোধ্যা অভিমুখে।বেলা ১টা ১০মিনিটে চাচড়া মোড়ে কাফেলা বাধার সম্মুখিন হয়। এ সময় পুলিশকে গাছের গুড়ি দিয়ে রাস্তায় ব্যরিকেড সৃষ্টি করতে দেখা যায়।কিন্তু কোন কাজ হয় না। কিছু দূরে ফুলেরহাটে পুলিশ আরেকটি ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। এতে কোনই কাজ হয় না। কাফেলার অগ্রযত্রা নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়।সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, ধোপাখোলা থেকে মিছিল আর সামনে এগোতে দেওয়া হবে না। সেখানে কয়েক কিলোমিটার এলাকা জোড়ে অত্যান্ত মজবুত তিন স্তরের ব্যারিকেড দেওয়া হয়। ব্যাংকার খনন করা হয়। যেন অসম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি।মিছিল যশোরের ধোপাখোলা মাঠে পৌছে জোহরের নামায আদায় করে। নামায শেষ করার সাথে সাথেই শুরু হয় পুলিশ ও বিডিআরের সম্মিলিত আক্রমন। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে চার দিকে। সংঘর্ষে অনেকেই আহত হয়। সেখানেই মিছিল কার্যত বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তখন লংমার্চের সিপাহসালার শায়খুল হাদীস আজিজুল হক্বকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ খুজতে থাকে। কিন্তু শায়খুল হাদীস সাধারণ জনতার সাথে পায়ে হেটে কখন ব্যারিকেড পার হয়ে গেছে তা কেউ টেরই পায়নি। আল্লাহু আকবার ধ্বনি তুলে বীর বিক্রমে মিছিল এগিয়ে যায়।বাধা আসছে ব্যরিকেড দেওয়া হচ্ছে।কিছুতেই থামানু যাচ্ছে না জনতাকে। লাউজানির রেলগেটের আগে আরেক বাধা অতিক্রম করে কাফেলা। সেখানেই আছরের নামাজ আদায় করা হয়। এভাবে ১২ কি:মি: পথ চলতে চলতে মিছিল যশোরের ঝিকরগাছা ব্রিজ পর্যন্ত পৌছে। সেখানে দেখা যায় ব্রিজের মধ্যে পুলিশের লম্বা লম্বা লরি এলোপাতাড়ি রেখে ব্যরিকেড সৃষ্টি করেছে।নদী পার হওয়ার কোন পথ খোলা নেই। নামাযের পরপরই কাফেলার একটা অংশ ঝিকিরগাছা ব্রিজের ব্যরিকেড ভেঙ্গে হাজের আলি বালুর মাঠে পৌছলে মিছিল পুলিশের দ্বারা আবার প্রচন্ড বাধাগ্রস্থ হয়।।শুরু হয় বেপরোয়া লাঠিচার্জ আর কাদানে গ্যাস নিক্ষেপ।গোটা পৃথিবিকে হতবাক করে নিরস্ত্র এই মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি বর্ষণ শুরু করে।ঝাঝরা হয়ে যায় হারুন,কামরুলসহ অসংখ্য যুবকের বুক। আল্লাহর রাহে প্রবাহমান সে রক্তে ভিজে লংমার্চ লাভ করে শহিদি কাফেলার মর্যাদা।এহেন পরিস্থিতিতে লংমার্চ নেতা শায়খুল হাদীস অশ্রুশিক্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে যশোর বেনাপোল সড়কে সমবেত লংমার্চ কাফেলাকে শান্ত হবার অনুরোধ জানান। এখানে মাগরিবের নামায আদায় শেষে সংক্ষিপ্ত ভাষণে শান্তিপূর্ণ মিছিলে বিনা উস্কানিতে গুলিবর্ষণের জন্য বিএন পি সরকারের তীব্র নিন্দা করে শায়খুল হাদীস বলেন, এর দায় বিএন পি সরকারকে নিতেই হবে এবং এর প্রতিবাদে পরদিন যশোর জেলায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকেন ও ৫ জানুয়ারি দেশব্যাপী শোক দিবস এবং ১২ জানুয়ারি বিক্ষোভ ও বিমান বন্দর ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করে লংমার্চ সমাপ্ত করেন। লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া রাহমানিয়া বেড়তলা, ব্রাক্ষ্মবাড়িয়া। হাআমা/ |