হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. : কে এই মহান ব্যক্তি
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ০৬:৫০ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

১৮১১ সালের কথা। গোটা ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের হাতে পরাধীন। নিজেদের শাসন ক্ষমতা হারিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা চরম নির্যাতিত, নিপীড়িত। ইংরেজদের কাছে তারা ধর্মীয় আগ্রাসন, অর্থনৈতিক শোষণ এবং রাজনৈতিক ও শিক্ষা-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। অপরদিকে উম্মাহর চির স্বাধীনতাকামী আলেম সমাজ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় রত। বৃটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে তারা প্রাণপন লড়াই করছিলেন নিজেদের শক্তি-সামর্থের শেষ বিন্দুটুকু দিয়ে।

এমনই এক সংকটময় মুহূর্তে ভারতবর্ষের মুসলমানদের আশার আলো হয়ে উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার অন্তর্গত ‘নানুতা’ নামক প্রত্যন্ত একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করলো চাঁদের মতো ফুটফুটে এক শিশু। শিশুটির যখন তিন বছর বয়স, তখন একদিন দোয়া ও বরকত লাভের উদ্দেশ্যে তাকে সে যুগের বিখ্যাত বুযুর্গ, আজাদি আন্দোলনের সিপাহসালার হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ.-এর কোলে তুলে দেওয়া হয়। হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ. শিশুটির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দোয়া করেন এবং বরকতস্বরূপ তাকে বাইয়াত করে নেন।

মাত্র ৩ বছর বয়সে হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রহ.-এর বাইয়াতের সৌভাগ্য লাভকারী সেই শিশুটিই ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের সম্রাট হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.।

জন্ম ও বংশ:  হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. ভারতের মুজাফ্ফর নগর জেলার অর্ন্তগত থানাভবন নামক গ্রামে ১২৩১ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম হাফেজ মুহাম্মদ আমিন। তিনি থানাভবনের ফারুকী মাশায়েখদের অর্ন্তভূক্ত ছিলেন। মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব সাহেব রহ. ও মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতুবী রহ. তার আত্মীয় ছিলেন।

শৈশব ও প্রাথমিক শিক্ষা: হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. শৈশবকাল থেকেই প্রখর স্মৃতি শক্তির অধিকারী ছিলেন। ফলে অতি অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পবিত্র কুরআন মাজিদ সম্পূর্ণ হিফজ করেন। তারপর তিনি ফারসি ও আরবি শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগ দেন।তার শিক্ষকদের মধ্যে জনাব মুন্সী আব্দুর রজ্জাক রহ. ও মুফতি ইলাহি ঝানঝানবী রহ. এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আধ্যাত্মিক সাধনা: ছোট বেলা থেকেই হযরত হাজী সাহেবের তাসাউফের দিকে প্রবল ঝোঁক ছিল। তিনি সর্ব প্রথম তরিকায়ে নকশবন্দীয়ার পীর হযরত শাহ নাসির উদ্দীন দেহলবী রহ. এর হাতে বাইয়াত হন। শাহ নাসির উদ্দীন রহ. এর মৃত্যুর পর তিনি হযরত মিয়াজী নুর মুহাম্মাদ ঝানঝানবী রহ. এর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার সোহবতে থাকেন। পরিশেষে তিনি মিয়াজী রহ. এর নিকট থেকে খেলাফত প্রাপ্ত হন।

জীবিকা অর্জন: হাজী সাহেব রহ. জমিদার ছিলেন কিন্তু প্রথমবার হজ করার পর তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি ছোট ভাইকে দান করে দেন এবং জাগতিক সকল চিন্তা-ভাবনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে একটি ছোট কামরায় মহান প্রভূর ইবাদতে গভীর ভাবে নিমগ্ন হন। তিনি নিজের ও সমস্ত মেহমানের ভার একমাত্র আল্লাহ তায়ালার উপর ছেড়ে দেন। তখন তার মেহমানের ভার তিনি নিজেই বহন করতেন।

জিহাদে অংশ গ্রহণ: ভারতের বিভিন্ন স্থানে যখন ১৮৫৭ সালের বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ল তখন উলামায়ে কেরামের মধ্যে উদ্দীপনার সৃষ্টি হল। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তারা ভাবলেন যে, এ বিপ্লবে অংশ গ্রহণ করা তাদের ওপর ফরজ। অগ্রনায়ক ছিলেন হাফেজ যামেন রহ.। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. ছিলেন আন্দোলনে হাফেজ সাহেবের পরম সাথী। আন্দোলনের এক পর্যায়ে জিহাদের ঘোষণা দেওয়া হল। জিহাদে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. কে ইমাম, মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতুবী রহ. কে সেনাপতি ও মাওলানা রশীদ আহমাদ রহ. কে কাজি নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ জিহাদে তারা বিভিন্নভাবে ইংরেজদের হাতে পরাজিত হওয়ার পর হাজী সাহেব রহ. পবিত্র মক্কা শরিফে হিজরত করার ইচ্ছা করেন। মাওলানা কসেম নানুতুবী রহ. আত্মগোপন করলেন এবং মাওলানা গাঙ্গুহী রহ. রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার হন।

মক্কায় হিজরত: থানা ভবন ধ্বংসের পর তিনি হিজরতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে দিলেন। পথিমধ্যে প্রথম ৩ দিন গঙ্গুহতে তার একান্ত প্রিয় খলিফা মাওলানা রশীদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহ. এর কাছে অবস্থান করেন। সেখান থেকে পর্যায়ক্রমে আমবালা, তাগরী, পাঞ্জালাসাহ অবস্থান করেন।তারপর সিন্ধুর পথে জাহাজে মক্কা শরিফে পৌঁছান।

মক্কায় অবস্থান: তিনি হিজরত করে মক্কা শরিফে পৌঁছে ‘রেবাতে ইসমাঈল, নামক স্থানে অবস্থান করলেন। তারপর হায়দ্রাবাদের নবাবের পক্ষ থেকে তার উকিলের নামে একটা ফরমান পৌঁছাল। তাতে লেখা ছিল হযরতকে দুটি ঘর দিয়ে দাও। জনৈক ব্যক্তি জারাতুশশাব নামক স্থানের একটি বাড়ি ক্রয় করে হযরতকে অর্পণ করেন। এ বাড়িতে শায়খ আকবর থাকতেন।

ইন্তেকাল: মৃত্যুকালে হাজী সাহেবের বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর ৩ মাস ২০ দিন। জন্ম থেকেই তিনি হালকা পাতলা ও দুর্বল দেহের অধিকারি ছিলেন। আধ্যাতিক সাধনা, মুজাহাদা, ঘুম ও খাদ্য স্বল্পতার কারণে তিনি আরো হালকা পাতলা হয়ে যান। ১৩১৫ হিজরীর ১৩ জুমাদাল উখরা সোমবার সুবহে সাদিকের তিনি তাঁর প্রকৃত বন্ধু আল্লাহ তায়ালার সান্নিধ্যে সাড়া দেন।

হাজী সাহেব রহ. এর প্রসিদ্ধ খলিফাগণ: মাওলানা রশীদ আহমাদ রহ., মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতুবী রহ., মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াকুব নানুতুবী রহ., হাজী মুহাম্মাদ আবিদ দেওবন্দী রহ., মাওলানা মুহাম্মাদ আশরাফ আলী থানভী রহ. মাওলানা খলিল আহমাদ সাহারানপুরী রহ., মাওলানা মুহাম্মাদ হাসান দেওবন্দী রহ., মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ বাঙালী রহ. প্রমুখ।

হাজী সাহেব রহ. এর প্রসিদ্ধ রচনাবলী-

.হাশিয়ায়ে মসনবী মাওলানা রুমী রহ.

. গিযায়ে রূহ

. জিহাদে আকবার

. মসনবী তুহফাতুল উশ্শাক

.ইরশাদে মুরশিদ

. যিয়াউল কুলুব

. ফালসাফায়ে হাফত মাসায়েল

. গুলজারে মারেফত, এই কিতাবটি এখন কুল্লিয়াতে ইমদাদিয়া নামে প্রসিদ্ধ।

এনএ/