কক্সবাজারে চিকিৎসাসেবায় বিপর্যয়ের শঙ্কা
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর, ২০২৪, ১২:৪৬ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

এনএ সাগর, কক্সবাজার

কক্সবাজার জেলাজুড়ে চিকিৎসাসেবায় আবারও বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। লাখ লাখ স্থানীয় ও রোহিঙ্গার জন্য বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

এর আগে গত ৩০ জুন প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় কক্সবাজারের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো থেকে জনবল প্রত্যাহারের চিঠি দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে কথা বলে পরে ১ জুলাই এসব প্রকল্প ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর নির্দেশ দেয় বিশ্বব্যাংক।

সেই হিসেবে পরের ছয় মাস অর্থাৎ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্প চালু রাখার কথা থাকলেও ৩০ সেপ্টেম্বর ফের অর্থ বরাদ্দ না থাকার কারণ দেখিয়ে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রকল্পগুলো।

ফলে সেদিনই কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়োগ পাওয়া প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারান।

এ মুহূর্তে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) কেবল একজন করে চিকিৎসক সামলাচ্ছেন, যেখানে প্রয়োজন ২৪ জন চিকিৎসক। জনবলের অভাবে যেকোনো সময় গুরুত্বপূর্ণ এই দুই বিভাগ বন্ধ হয়ে ‍যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।  

দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে ২০ শয্যার সরকারি হাসপাতালের চিত্রও প্রায় একই। সেখানে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কয়েকটি সেবা। বিশেষ সেবা বন্ধ আছে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতেও।

কক্সবাজারে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, উদ্ভূত সংকট নিরসনে নতুন প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে ইনক্লুসিভ সার্ভিসেস অপারেটিং (আইএসও) নামে আন্তর্জাতিক এক সংস্থা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে এবং কক্সবাজারে কর্মরত জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর সঙ্গে আইএসওর চুক্তি স্বাক্ষর হলে প্রকল্পটি শুরু হবে। তবে সেটা কবে নাগাদ শুরু হবে, সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কেউ কিছু বলতে পারছেন না।

কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয় ও কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের তথ্য মতে, স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের সহায়তার লক্ষ্যে ২০১৯ সালের শুরু থেকে বিশ্বব্যাংকের স্বাস্থ্য ও জেন্ডার সাপোর্ট প্রকল্প, স্বাস্থ্য ও লিঙ্গ সহায়তা প্রকল্পের অধীনে তাদের বরাদ্দ অর্থে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় ৬টি এনজিও জেলাব্যাপী হাসপাতাল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জনবল নিয়োগসহ নানা ধরনের সহায়তা দিয়ে আসছিল। কক্সবাজার স্বাস্থ্য বিভাগে সরকারিভাবে নিয়োগ করা জনবল ছাড়াও এসব প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ পান। তারা কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, সেন্টমার্টিন হাসপাতাল ও জেলার ৭২টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন।

বিশ্বব্যাংকের এসব প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় গত ৩০ জুন জনবল প্রত্যাহারের চিঠি দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ সরকারের নানা পর্যায়ে চিঠি পাঠিয়ে বিষয়টি জানানো হয়।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ জুলাই বিশ্বব্যাংকের এক চিঠিতে এসব প্রকল্প ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পরবর্তী ৬ মাস প্রকল্প চালু রাখার কথা থাকলেও ৩০ সেপ্টেম্বর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয় প্রকল্পগুলো।

জেলা সদর মডেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আশিকুর রহমান বলেন, কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রতিদিন গড়ে ৫ শতাধিক রোগী সেবা নিতে আসে। এছাড়া ২৫০ শয্যার হলেও হাসপাতালের ইনডোরে গড়ে প্রতিদিন ৮০০-৯০০ রোগী ভর্তি থাকে। ৩০ সেপ্টেম্বরের পর এখানে মাত্র ৩ জন চিকিৎসক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। যদি ন্যূনতম সেবা চালু রাখতে হয়, তাহলে জরুরি বিভাগে অন্তত ১২ জন চিকিৎসক প্রয়োজন। পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় জরুরি প্রসূতি ও শিশু বিভাগ এবং আউটডোরের নাক-কান-গলা (ইএনটি) বিভাগে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

আশিকুর রহমান বলেন, জেলা সদর হাসপাতালে সাধারণত আইসিইউ, সিসিইউ এবং স্ক্যান বিভাগ থাকে না। কিন্তু প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে বিশেষায়িত এসব সেবা চালু করে সরকার। ১০ শয্যার আইসিইউ চালু রাখতে কমপক্ষে ১৬ জন ডাক্তার প্রয়োজন এবং সিসিইউতে ৮ জন। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই দুই বিভাগে বর্তমানে চিকিৎসক রয়েছে একজন করে। চিকিৎসক পাওয়া না গেলে বিশেষায়িত এসব সেবা একেবারে বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না।

তিনি বলেন, প্রকল্প শেষ হওয়ায় চিকিৎসকের পাশাপাশি সেপ্টেম্বর মাস থেকে ক্লিনার, আয়াসহ ১৪৭ জনের চাকরি নেই। ফলে হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়েও শঙ্কায় আছে কর্তৃপক্ষ।

কক্সবাজারের চিকিৎসকরা জানান, জেলার ২৫ লাখ মানুষের সঙ্গে ২০১৭ সালে যোগ হয় ১২ লাখ রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের সংখ্যা এই সাত বছরে আরও বেড়েছে। তাছাড়া প্রতিবছর কক্সবাজারে বেড়াতে আসে লাখ লাখ পর্যটক। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর জন্য আধুনিক সেবা প্রতিষ্ঠান বলতে গেলে এই ২৫০ শয্যার হাসপাতাল।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ২৫০ শয্যার হলেও সেখানে সেবা দেওয়ার ধরন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো। প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগী জরুরি ও বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসে। গড়ে প্রতিদিন ভর্তি থাকে ৮০০-৯০০ জন রোগী।

কক্সবাজারে বিশ্বব্যাংকের স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রিক প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জীবন পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবার অভাবে হুমকির মুখে পড়বে- সংশ্লিষ্টদের এই আশঙ্কা অবশ্য নাকচ করে দিয়েছেন কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক মং টিং ঞো।

তিনি বলেন, ইনক্লুসিভ সার্ভিসেস অপারেটিংয়ের (আইএসও) সঙ্গে সরকারের যে আলোচনা চলছে, আশা করি তা ফলপ্রসূ হবে।

সিভিল সার্জন আসিফ আহমেদ হাওলাদারও একই আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে এই নতুন প্রকল্প চালু করা জরুরি।

এ বিষয়ে আইএসওর প্রকল্প পরিচালক বিপাশ খিসা বলেন, প্রকল্পের প্রস্তাব আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। সেখানে অনুমোদন পেলে জাতিসংঘের অধীন সংস্থাগুলোর সঙ্গে চুক্তি সইয়ের পর চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে।

তবে নতুন প্রকল্পটি কবে নাগাদ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাবে, চিকিৎসকই বা কবে নিয়োগ দেওয়া হবে- তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি বিপাশ খিসা।