বিনা পারিশ্রমিকে কুরআন পড়ানো হয় প্রতিবন্ধী জমেলার ‘পাঠশালায়’
প্রকাশ: ২২ অক্টোবর, ২০২৪, ০১:৩২ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

জেসমিন প্রামানিক, চাটমোহর (পাবনা)

দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন জমেলা খাতুন (৪২)। রাত পার হতেই হাত-পা বাঁকা হয়ে যায় তার। দিনমজুর বাবা অভাবের কারণে মেয়েকে ভালো চিকিৎসা দিতে পারেননি। একটা সময় শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন জামেলা। ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকলেও আর কখনও স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। তবে, হাল ছাড়েননি জমেলা। স্থানীয় এক হাফেজের কাছে পবিত্র কুরআন শরিফ পড়া শুরু করেন। এরপর পুরো কুরআন শরিফ আয়ত্বে আনার পর প্রায় ১৮ বছর ধরে কুরআন শরিফ শিক্ষা দিচ্ছেন জমেলা খাতুন।

পাবনার চাটমোহর উপজেলার হান্ডিয়াল ইউনিয়নের ডেফলচড়া গ্রামের মৃত জমশের আলীর বড় মেয়ে জমেলার বাড়ির উঠোনে প্রতিদিন ‘কুরআন শিক্ষার পাঠশালায়’কুরআন শরিফ শিখতে আসেন বয়োবৃদ্ধ নারী থেকে শুরু করে শিশু-কিশোররা। পবিত্র কুরআন শরিফের বিভিন্ন সুরা ও আয়াতে মুখরিত হয়ে ওঠে চারদিক। একজন নারী এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও যেভাবে দিনের পর দিন জমেলা পবিত্র কুরআন শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন- তা দেখে স্থানীয়রা মুগ্ধ। তবে, স্থান সংকুলান না হওয়ায় এবং ঘর না থাকায় কুরআন শিখতে আসা সবাইকে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। উঠোনে বসেই কুরআন শরিফ শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছেন জমেলা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জরাজীর্ণ টিনের ঘরের চৌকাঠের ওপর বসে আছেন জমেলা খাতুন। আর বাড়ির উঠোনে বসে পবিত্র কুরআন পড়া শিখছে বেশ কিছু শিশু-কিশোর ও কিশোরী। জমেলার পড়ানো দেখতে এসেছেন বেশ কিছু অভিভাবক। শুধু অভিভাবকই নন, তারাও জমেলার কাছে পবিত্র কুরআন শিক্ষা নেন। সারা দিনে কয়েকটি ধাপে বয়োবৃদ্ধ নারী থেকে শুরু করে অনেকেই এই পাঠশালার ছাত্রী হয়ে ওঠেন। এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক নারী ও শিশু-কিশোরের হাতে পবিত্র কুরআন তুলে দিয়েছেন জমেলা। পরিবারে অভাব থাকা সত্ত্বেও কারো কাছ থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেন না জমেলা। শুধু তাই নয়, কেউ জোর করে টাকা দিলে সেই টাকা দিয়ে দরিদ্রদের কুরআন শরিফ কিনে দেন। শত কষ্টের মাঝেও ধর্মীয় কাজে নিজেকে উৎসর্গ করতে পেরে সন্তুষ্ট এই প্রতিবন্ধী নারী। তবে, একটি নতুন ঘর হলে পাঠদানে সুবিধার পাশাপাশি সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশে জীবনযাপন করতে পারতেন তিনি।

জমেলার কাছে কুরআন শিক্ষাগ্রহণ করা ষাটোর্ধ্ব নারী সোনাভান খাতুন বলেন, ছোটবেলায় কুরআন শরিফ পড়া শিখেছিলাম। কিন্তু পরে ভুলে গেছি। জমেলার কাছে শিখে এখন কুরআন শরিফ পড়তে পারি। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও মেয়েটা যেভাবে শেখায়, তাতে মুগ্ধ হয়েছি। এর জন্য জামেলা কোনো টাকা-পয়সাও নেয়নি।

রাজিয়া খাতুন নামে অপর এক নারী বলেন, মেয়েটার পরিবার খুব অভাবী। এখন পর্যন্ত অনেককে পবিত্র কুরআন পড়া শিখিয়েছে। শত অভাবের মাঝেও টাকা-পয়সার কোনো চাহিদা নেই তার। টাকা দিতে চাইলেও নেয় না। জোর করে দিলেও উল্টো সেই টাকা দিয়ে কুরআন শরিফ কিনে বিতরণ করে।

জামেলা খাতুন বলেন, সবাই আল্লাহর পথে চলুক। এই দুনিয়াতে মানুষ চিরদিন থাকবে না। মহান আল্লাহ তায়ালার অতি পছন্দ ও তাকে সন্তুষ্টি করতে পবিত্র কুরআন পাঠের কোনো বিকল্প নেই। পরকালের সুখের আশায় শত কষ্টের মাঝেও কুরআন শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। তবে, আমার ভাঙাচোরা ঘর দিয়ে ঝড়-বৃষ্টির দিনে পানি পড়ে। আর বাড়ির উঠানে বসে রোদের মধ্যে পড়াতে গিয়ে কষ্ট হয়। আমাকে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিলে খুব উপকার হতো।

হান্ডিয়াল ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেদুয়ানুল হালিম বলেন, আপাতত ঘরের কোনো প্রকল্প নেই। যদি কখনও প্রকল্প আসে, তখন ঘরের ব্যবস্থা করব।