যাদের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন
প্রকাশ:
০৯ অক্টোবর, ২০২৪, ১১:১৯ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
প্রত্যেক মুমিন কামনা করেন, আল্লাহ তায়ালা যেসব মাখলুকের দোয়া নিশ্চিতভাবে কবুল করেন, তাদের দোয়ায় সামিল হতে। এটি এমন একটি পাওয়া, যা সবার ভাগ্যে জোটে না। তেমনই এক পবিত্র ও নিষ্পাপ মাখলুক হচ্ছেন ফেরেশতা। ফেরেশতাদের একটি কাজ হচ্ছে মুমিনদের জন্য ইস্তেগফার করা। ‘আকাশ ওপর থেকে ফেটে পড়ার উপক্রম হয় আর ফেরেশতারা তাদের পালনকর্তার প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করে এবং দুনিয়াবাসীদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে। শুনে রাখো, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়’। (সুরা শূরা: ৫) (তারা বলে,) হে আমাদের পালনকর্তা! আপনার রহমত ও জ্ঞান সবকিছুতে পরিব্যপ্ত। অতএব, যারা তওবা করে এবং আপনার পথে চলে, তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন”। (সুরা মুমিন: ৭) উম্মতের দরদী নবীজি সা. তাঁর প্রিয় উম্মতকে এমন কিছু আমল শিখিয়েছেন, যে আমলে মেলে ফেরেশতার দোয়া। আমলগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো— ১) জামাতে নামাজ পড়ে স্বস্থানে কিছুক্ষণ বসে থাকা হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা, বলেছেন, ‘(মসজিদে) জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়ার সওয়াব বাজারে কিংবা বাড়িতে একা নামাজ পড়ার চেয়ে ২৫ বা ২৭ গুণ বেশি। কারণ, যখন কোনো ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে আসে এবং একমাত্র নামাজের নিয়তেই মসজিদে আসে, তখন মসজিদে প্রবেশ করা পর্যন্ত প্রত্যেক কদমের বিনিময়ে তার একটি করে মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয় এবং একটি করে পাপ মোচন করা হয়। মসজিদে প্রবেশ করার পর যতক্ষণ নামাজ তাকে (মসজিদে) আটকে রাখে, ততক্ষণ সে নামাজের মধ্যেই থাকে (অর্থাৎ ততক্ষণ সে নামাজের সওয়াব পেতে থাকে) এবং নামাজ পড়ে যতক্ষণ সে স্বস্থানে বসা থাকে, ততক্ষণ ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। তারা বলতে থাকে, হে আল্লাহ, তার প্রতি দয়া করুন। হে আল্লাহ, তাকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ, তার তওবা কবুল করুন। (তারা এসব দোয়া করতেই থাকে) যতক্ষণ পর্যন্ত সে কাউকে কষ্ট না দেয় এবং তার অজু নষ্ট না হয়’। (সহিহ বুখারি: ২১১৯; মুসলিম: ৬৪৯) এখানে লক্ষণীয়, হাদিসে দুটি শর্তের কথা উল্লেখ রয়েছে। প্রথম শর্ত: এসময় কাউকে কোনো রকম কষ্ট দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয় শর্ত: এসময় যেন অজু নষ্ট না হয়। কাউকে কষ্ট দিয়ে ফেললে বা অজু ছুটে গেলে ফেরেশতাদের দোয়া পাওয়া যাবে না। ২) প্রথম কাতারে নামাজ পড়া ‘একদিন রাসুলুল্লাহ সা. (তাঁর সামনে উপস্থিত সাহাবাদের লক্ষ করে) বললেন, যারা প্রথম কাতারে নামাজ পড়ে, আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতারাও তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। (তাঁর এ কথা শুনে) সাহাবিরা বললেন, যারা দ্বিতীয় কাতারে নামাজ পড়ে তাদের জন্যও (দোয়া করুন)। রাসুলুল্লাহ সা. আবার বললেন, যারা প্রথম কাতারে নামাজ পড়ে আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতারাও তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। তখন সাহাবিরা বললেন, যারা দ্বিতীয় কাতারে নামাজ পড়ে তাদের জন্যও (দোয়া করুন)। রাসুলুল্লাহ সা. আবার বললেন, যারা প্রথম কাতারে নামাজ পড়ে আল্লাহ তায়ালা তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতারাও তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন। তখন সাহাবিরা বললেন, যারা দ্বিতীয় কাতারে নামাজ পড়ে তাদের জন্যও (দোয়া করুন)। (তাদের কথা শুনে চতুর্থবার) রাসুলুল্লাহ সা. বললেন, এবং যারা দ্বিতীয় কাতারে নামাজ পড়ে তাদের প্রতিও (রহমত বর্ষণ করেন)’। (মুসনাদে আহমদ: ২২২৬৩; হাদিসটি সহিহ লিগাইরিহি) ৩) কাতারের ডান দিকে দাঁড়ানো হজরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যারা কাতারের ডান দিকে দাঁড়ায়, আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন, ফেরেশতারা তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন’। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ২১৬০, সুনানে কুবরা, বায়হাকি: ৩/১০৩, হাদিসটি সহিহ) উপরোক্ত হাদিস অনুযায়ী, ডান দিকে ফাঁকা থাকলে সেদিকেই আগে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। ফাঁকা না থাকলে তো ভিন্ন কথা। ৪) মানুষকে কল্যাণকর কথা শিক্ষা দেওয়া ‘হজরত আবু উমামাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমাদের মধ্যকার সাধারণ কারো ওপর আমার মর্যাদা যেমন, একজন আবেদের ওপর একজন (সত্যিকারের) আলেমের মর্যাদা ঠিক তেমন। এরপর বলেন, আল্লাহ তাআলা ওসব লোকদের ওপর রহমত বর্ষণ করেন, যারা মানুষকে কল্যাণকর কথা শিক্ষা দেয়, ফেরেশতারা এবং আসমান-জমিনের সকল বাসিন্দা, এমনকি গর্তের পিঁপড়া এবং পানির মাছ পর্যন্ত তাদের জন্য দোয়া করে’। (জামে তিরমিজি: ২৬৮৫, হাদিসটি হাসান) ৫) মুসলিম ভাইয়ের জন্য যিনি দোয়া করেন সহিহ মুসলিমে হজরত আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন— مَا مِنْ عَبْدٍ مُسْلمٍ يَدْعُو لأَخِيهِ بِظَهْرِ الغَيْبِ إِلاَّ قَالَ المَلَكُ: وَلَكَ بِمِثْل ‘যখন কোনো মুসলিম তার ভাইয়ের জন্য তার পশ্চাতে দোয়া করে, তখন তার (মাথার কাছে নিযুক্ত) একজন ফেরেশতা তাঁকে লক্ষ্য করে বলে, তোমার জন্যও এমনই হোক’। (সহিহ মুসলিম: ২৭৩২) অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘কোনো মুসলিম তার ভাইয়ের অবর্তমানে তার জন্য নেক দোয়া করলে তা কবুল হয়। তার মাথার কাছে একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকে, যখনই সে তার ভাইয়ের জন্য দোয়া করে, তখনই ওই ফেরেশতা বলেন, ‘আমিন! তোমার জন্যও এমনই হোক”। (সহিহ মুসলিম: ২৭৩২) দেখুন! কত সহজ একটি আমল। ধরুন, আপনি অসুস্থ, ওই অবস্থায় আপনার অসুস্থ ভাইদের জন্য দোয়া করুন। এতে মিলবে কী? এতে হাদিসের ভাষ্যমতে, আপনার সুস্থতার জন্য দোয়া করবেন নিষ্পাপ ফেরেশতারা। ধরুন, আপনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তো আপনার যেসব ভাই আপনার মতো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, তাদের জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া করতে থাকুন, এর বিনিময়ে আপনার সঙ্গী ফেরেশতা আপনার নিরাপত্তার জন্য দোয়া করবেন ইনশাআল্লাহ। এছাড়াও অন্যের জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করতে পারা একজন মুমিনের হৃদয়ের স্বচ্ছতার একটি দলিল। কারো হৃদয়ে কুটিলতা থাকলে, সে অন্যের জন্য দোয়া করতে পারে না। ৬) অজুসহ ঘুমানো হজরত আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রাতে পবিত্র অবস্থায় (অজু সহকারে) ঘুমায়, একজন ফেরেশতা তার গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা কাপড়ের ভেতরে অবস্থান করে। রাতে সে যখনই জাগ্রত হয়, ওই ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করে বলে, হে আল্লাহ, আপনি আপনার এ বান্দাকে ক্ষমা করে দিন। সে পবিত্র অবস্থায় রাত কাটাচ্ছে’। (সহিহ ইবনে হিব্বান: ১০১৫) ৭) প্রতিদিন অল্পকিছু হলেও সদকা করা হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেশতা (আসমান থেকে) অবতরণ করেন। তাঁদের একজন বলেন, হে আল্লাহ, যে দান করে তাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ, যে দান করে না, তাকে ধ্বংস করে দিন’। (সহিহ বুখারি: ১৪৪২; মুসলিম ১০১০) ৮) সেহরি খাওয়া রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, إنَّ اللهَ وملائكتَه يُصَلُّونَ على المتسحِّرينَ ‘যারা সেহরি খায়, আল্লাহ তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারাও তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন’ (সহিহ ইবনে হিব্বান: ৩৪৬৭) মুসনাদে আহমদে হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা. থেকে বর্ণিত অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন— ‘সেহরি পুরোটাই বরকত। অতএব তোমরা সেহরি খাওয়া ছেড়ো না, এক ঢোক পানি হলেও পান করো। কারণ, যারা সেহরি খায়, আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতারাও তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন”। (মুসনাদে আহমদ: ১১১০১; হাদিসটির সনদ শক্তিশালী) ৯) অসুস্থ মুসলিমকে দেখতে যাওয়া ‘কোনো মুসলিম যদি অন্য কোনো (অসুস্থ) মুসলিমকে সকাল বেলা দেখতে যায়, সন্ধ্যা পর্যন্ত ৭০ হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর যদি সন্ধ্যায় যায়, তাহলে সকাল পর্যন্ত ৭০হাজার ফেরেশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর জান্নাতে তার জন্য আহরিত ফল নির্ধারিত হবে’। (জামে তিরমিজি: ৯৬৭, হাদিসটি হাসান) ১০) দরুদ পড়া রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘যখনই কেউ আমার ওপর দরুদ পড়ে, যতক্ষণ দরুদ পড়ে ততক্ষণ ফেরেশতারাও তার জন্য রহমতের দোয়া করতে থাকে। অতএব কেউ কম পড়তে পারে আবার বেশিও পড়তে পারে’। (মুসনাদে আহমদ: ১৫৬৮৯, হাদিসটি হাসান) ১১) সুরা হাশরের শেষ তিনটি আয়াত তেলাওয়াত ‘যে ব্যক্তি সকালে তিনবার ‘আউজুবিল্লাহিস সামিয়িল আলিম, মিনাশশাইত্বনির রাজিম’ পড়ার পর সূরা হাশরের শেষের তিনটি আয়াত তেলাওয়াত করবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য ৭০ হাজার ফেরেশতা নিয়োজিত করে দেবেন। তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকবে। সে ওই দিন মৃত্যুবরণ করলে শহিদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করবে। এমনিভাবে যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় এরূপ পাঠ করবে, সেও একই ফজিলতের অধিকারী হবে’। (জামে তিরমিজি: ২৯২২; মুসনাদে আহমদ: ২০৩০৬; আত তারগীব ১/৩০৪) তবে, এ সংক্রান্ত হাদিসটি জয়িফ। দূর্বল হাদিসের ক্ষেত্রে মুহাদ্দিসিনে কেরামের নীতি অনুসারে, এখানে যে ফজিলত বলা হয়েছে তার ওপর শতভাগ একিন ছাড়া আমলটি করার অবকাশ আছে। কারণ, এটি কোরআনে কারিমেরই তিনটি আয়াত। অন্তত প্রতিটি হরফের বিনিময়ে দশটি নেকি তো অবশ্যই মিলবে। তাই চাইলে এ আমলটিও করা যায়। আল্লাহ তায়ালা মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেককে উপরোক্ত আমলের ওপর অবিচল থাকার তাওফিক দিন। আমিন। এনএ/ |