বোন হারিয়ে স্মৃতিকাতর সাংবাদিক ও উদ্যোক্তা ওমর শাহ
প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১২:৩৬ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

গত কিছুদিন আগে একমাত্র বোনকে হারিয়েছেন লেখক, সাংবাদিক ও উদ্যোক্তা ওমর শাহ। আদরের বোনকে হারিয়ে তিনি স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ এবং ভাষাহীন হয়ে পড়েছেন।

আজ বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তিনি বোনকে নিয়ে দীর্ঘ একটি আবেগঘণ লেখা পোস্ট করেছেন ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে। লেখাটির শিরোনাম দিয়েছেন ‘ক্ষমা করে দিস বোন আমার!’

পাঠকের জন্য তার হৃদয় নিঙরানো লেখাটি তুলে ধরছি-

আজ ছয় দিন আমাদের একমাত্র বোনটি আমাদের মাঝে নেই। আমাদের প্রতি এক পৃথিবী চাপা অভিমান নিয়ে আল্লাহর কাছে চলে গেছে সে। ভাবতেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠে। বাড়ির চারপাশটা তার শূন্যতায় কেঁদে উঠছে। বোন হারানোর বেদনা যে কত যাতনার সে সবার পরে এসে সবার আগে বুঝিয়ে দিয়ে গেল!

এ পৃথিবীতে আমরা কেউই চিরস্থায়ী নই। যেকোনো মুহূর্তে যে কেউ চলে যেতে পারি। কিন্তু কিছু চলে যাওয়া নীরবে কাঁদিয়ে যায়। বুকের ভেতরটা ক্ষত-বিক্ষত করে চলে যায়। গত পাঁচ রাত আমাদের পরিবারের কেউ ঘুমাতে পারেনি। রাত নেমে এলেই যেন জান্নাতের স্মৃতিগুলো আমাদের চোখের সামনে কড়া নাড়ছে। আমার স্ত্রীও প্রথম দুই রাত লাইট অফ করতে দেয়নি। চোখে ঘুম ছিল না সারারাত। মধ্যরাতে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি বদ্ধ চোখের পাতার কোণ বেয়ে অশ্রু ঝরছে।

অনুশোচনার কান্না ঝরছে আমাদের সবার চোখ দিয়ে। বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে আমরা নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যকে অপরাধী বানিয়ে গেল বোন আমার। শুধুমাত্র আমার মা ও আমার বোন জামাই এ অপরাধের দায় থেকে মুক্ত। চলে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এ দুটি মানুষ-ই তার কাছে সবচেয়ে প্রিয় ছিলো। তাদের ভালোবাসার কাছে হেরে যায় তার জীবন। নিষ্ঠুরতার কাছে হেরে যাই আমরা। তার অসুস্থতার গত সাতটি বছর বোনটিকে আদর স্নেহ মায়া দিয়ে আগলে রাখলেও শেষ পর্যন্ত আমিও পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম ভাই হিসেবে বোনের কাছে অপরাধী হয়ে গেলাম। অসুস্থতা বেড়ে গেলে-ই আমাকে ফোন দিয়ে কান্না করতো। মনের কথাগুলো খুলে বলতো। সর্বোচ্চ মানসিক সাপোর্ট দেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এবার আর আমার বোন আমাকে সেই ফোন দেয়নি। আমার প্রতি তার অভিমানের মাত্রা এতোই বেড়েছিল ফোন দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। না জানিয়েই নীরবে চলে গেল পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। এ কষ্ট আমি কি করে সইবো। একটিবার যদি ফোন করে বলতো, ভাইয়া কেমন আছেন! আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই! পৃথিবীর সকল ব্যস্ততাকে মাটি দিয়ে তোর জন্য সময় বের করে নিতাম। তারপর চলে গেলেও নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম- আমার বোন আমার কাছে বলেই চলে গেছে।

আমি না হয় তোকে একটি ধমকই দিয়েছিলাম। তুই যে কষ্ট নিয়ে আমার কাছে শেষ কথাগুলো বলেছিলে, আমি হয়তো তোকে যথেষ্ট সান্ত্বনা দিতে পারিনি। তাই বলে কি তোর মন থেকে এতটা দূরে সরে গিয়েছিলাম? কী এক অপরাধে অপরাধী বানিয়ে গেলি রে বোন! নিজের মনকে কি করে সান্ত্বনা দিবো এখন! তখন তো আমার মনেই সান্ত্বনা ছিল না। আমি কি করে তোকে সান্ত্বনা দিব। বাড়ি থেকে ঢাকা আসার পথে তোকে বলে আসতে না পারায় গাড়িতে বসে বসে আফসোস করেছিলাম। সেই আফসোসের কথাও কি তোর মনে বাজায়নি তোকে কতটা ভালোবাসি!

কি করে পারলি আমাকে না বলে চলে যেতে? অসুস্থতার গত সাত বছরের আদর স্নেহ ভালোবাসা কী তুচ্ছ ছিলো! শেষ পর্যন্ত বড় ভাইয়ের একটি ধমকই কী তুই মেনে নিতে পারলি না? এভাবেই ভাইটাকে অপরাধী বানিয়ে গেলি?

 

আজকের এই ফেসবুক পোস্ট কি তুই দেখতে পাবি? আমার আল্লাহ কি আমার এই কথাগুলো তোর কানে পৌঁছাবে? তুই না বলেছিলি, ভাইয়া আপনি ফেসবুকে এত কিছু লেখেন আমাকে নিয়ে তো কোনোদিন কিছু লিখলেন না? বলেছিলাম, লিখবো। কিন্তু সেই লেখা এই লেখা হবে কল্পনাও করেছি কোনোদিন!

তোর চলে যাওয়ার পেছনে তোর অসুস্থতা উসিলা হলেও আরো বড় দায়ী আমরা বেঁচে থাকা নিষ্ঠুর মানুষগুলো। আমরা তোকে যথেষ্ট সাপোর্ট দিতে পারিনি। তোকে যে আদর, স্নেহ, ভালবাসা দিয়ে ঢেকে রাখা প্রয়োজন সেটা দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। আমরা সবাই ব্যর্থ। আমরা সবাই অপরাধী। মহান আল্লাহর কাছে কি ক্ষমা হবে আমাদের? তুই কি ক্ষমা করতে পারবি আমাদের? তুই কী জানিস তোর অপরাধী ভাবি তোর জন্য ফুচকা কিনে নিয়ে এসেছিলো? এসেই দেখে তুই তাকে ছেড়ে চলে গেছিস।

আমরা নিষ্ঠুর হলেও তো আমার আল্লাহ আরহামুর রাহিমিন, গফুরুর রহিম। তোকে হয়তো বেশি ভালোবেসেছেন বলেই দ্রুত নিয়ে গেছেন। পৃথিবীর আর কোন কষ্ট তোকে তোকে আঘাত করতে পারবে না। মায়ের কষ্টে আর তুই ব্যথিত হবি না। তোর হাজবেন্ডের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোকে আর চিন্তা করতে হবে না। ভাইদের ধমক আর তোর মনে আঘাত করবে না। ভাবিরা আর তোকে বিরক্ত ভাববে না। তোকে আর কেউ অবহেলা করবে না। শশুর বাড়ির কোন কথায় তোকে আতঙ্কিত হতে হবে না। ডাক্তারকেও ওষুধের ডোজ কমাতে বাড়াতে হবে না। তোর অনাগত সন্তানের মায়া তোকে আর চিন্তিত করবে না।

তুই এখন জান্নাতের বাসিন্দা। এখানেই আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তি ও সান্ত্বনা। তোর এই ক্ষণস্থায়ী বিরতিতে আবারো দেখা হবে আমাদের জান্নাতের বাগানে। সে দেখায় আমাদের অন্তত ক্ষমা করে দিস, ক্ষমা করে দিস আমাদের পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে। মহান রাব্বুল আলামিন তোকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। অনন্ত জান্নাতের ঘরে তুই সুখে থাকিস। আমিন।

কেএল/