শরীয়তের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ নিয়ে একটি প্রামাণ্য ফতোয়া-২
প্রকাশ: ২৪ মে, ২০২৪, ০৯:৩৮ রাত
নিউজ ডেস্ক

এই মতবাদ অনুযায়ী ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিকে নারী থেকে পুরুষ অথবা পুরুষ থেকে নারী হওয়ার জন্য সার্জারি কিংবা হরমোন থেরাপির মাধ্যমে দেহের সৃষ্টিগত কাঠামো পরিবর্তনেরও প্রয়োজন নেই; বরং সেটি ঐচ্ছিক বিষয়।

সে নিজেকে কোন্ লিঙ্গের মনে করে এটাই মূলকথা। এ মতবাদের প্রবক্তাদের বক্তব্যে বিষয়টি এভাবেই একদম পরিষ্কার। যেমনটি প্রশ্নপত্রেও তুলে ধরা হয়েছে।

এখানে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে ট্রান্সজেন্ডার একটি পরিভাষা, যার দ্বারা এমন লোকদের বোঝানো হয়, যাদের লিঙ্গ পরিচয় তাদের জন্মগতভাবে নির্ধারিত লিঙ্গ পরিচয় থেকে ভিন্ন। তাদের লিঙ্গ পরিচয় জন্মগত চিহ্ন নয়; বরং তারা পুরুষ, না নারী এ ব্যাপারে তাদের মানসিক বোধই তাদের লিঙ্গ পরিচয়।

এই শ্রেণীর মানুষের সেই মানসিক বোধ জন্মের সময় যে লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারিত হয়েছিল তা থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। কোনো কোনো ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি হরমোন থেরাপি গ্রহণ করে থাকে আবার তাদের কেউ সার্জারিও করে।

তবে সব ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি এগুলো করে না বা করতে পারে না। এবং এটি জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, ট্রান্সজেন্ডার হওয়া কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের উপর নির্ভরশীল নয়।

ট্রান্সজেন্ডারের পরিচয় ও স্বরূপ পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পর এ বিকৃত ও বিকারগ্রস্ত মতবাদের খন্ডনে আসলে কিছু বলারই প্রয়োজন পড়ে না। বিষয়টি একটু সহজভাবেই ভেবে দেখুন আপনার পিতা, যাকে আপনি জন্মের পর থেকেই পিতা ডেকে আসছেন, একদিন সে নিজেকে নারী দাবি করে বসল! অথবা আপনার মা, যার কোলে আপনার বেড়ে ওঠা, জন্মের পর থেকেই আপনি যাকে মা ডেকে আসছেন, একদিন সে নিজেকে পুরুষ দাবি করে বসল!

তখন বিষয়টি কেমন হবে?! আপনার সেই পিতামাতার মধ্যকার সম্পর্কটা এখন কী দাঁড়াল! আপনার পিতৃ-মাতৃ পরিচয়েরই বা তখন কী দশা হবে!

আপনি যাকে পিতা বলছেন, সে কিনা একজন নারী কিংবা যাকে মা বলছেন, সে কিনা একজন পুরুষ! আজব! অনুরূপ কারো স্ত্রী, যার সাথে বিয়ের পর থেকে একত্রে থেকে আসছে, তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক হচ্ছে, তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে সে অবগত, কিন্তু হঠাৎ সে একদিন নিজেকে পুরুষ দাবি করে বসল! তখন অবস্থা কী দাঁড়াবে?!

অথচ ট্রান্সজেন্ডারবাদের পরিচয় এটিই যে, মানুষের লিঙ্গ পরিচয় তার মানসিক ব্যাপার। সে নিজেকে যে লিঙ্গের মনে করবে, সেটিই তার লিঙ্গ পরিচয়।

ট্রান্সজেন্ডারবাদের এ পরিচয় জানার পর একথা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটা চরম শয়তানী মতবাদ।

শয়তানের এ চক্রান্তের বিষয়ে আল্লাহ তাআলা মানুষকে আগেই সতর্ক করেছেন, যা আমরা সূরা নিসার ১১৮-১২১ নং আয়াতের উদ্ধৃতিতে পড়ে এসেছি।

তিন. কারো অবস্থা যদি বাস্তবিকই এমন হয় যে, সে পুরুষ হয়েও নারীর তুলনায় পুরুষের প্রতি বেশি আকর্ষণ বোধ করে, ১০ তদ্রুপ নারী হয়েও কেউ যদি পুরুষের তুলনায় নারীর প্রতিই বেশি আকর্ষণ বোধ করে তবে এটি তার মানসিক রোগ বা শয়তানের কুমন্ত্রণা। শরীয়তের দৃষ্টিতে একে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

বরং তার জন্য মনের এই অবস্থার চিকিৎসা ও সংশোধন করা জরুরি। এর জন্য যেমন শাস্ত্রীয় চিকিৎসাব্যবস্থা আছে, তেমনি শরীয়তের আখলাক অধ্যায়ে স্বতন্ত্র শিক্ষা রয়েছে, যাতে আত্মশুদ্ধি ও কলবের পবিত্রতা বিষয়ে মূল্যবান নির্দেশনা দেয়া আছে এবং এ আত্মিক ব্যাধি সংশোধনের জন্য অন্যান্য হেদায়েতের পাশাপাশি বিভিন্ন দুআও শেখানো হয়েছে।

সে সব হেদায়েত গ্রহণ না করে যদি মানসিক ব্যাধি ও বিকৃত চিন্তাকে জিইয়ে রাখা হয়, তাহলে তা হবে চরম গোমরাহী।

আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন- আল্লাহর হেদায়েতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চাইতে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে? সূরা কাসাস (২৮) : ৫০

চার. কোনো পুরুষের কাছে নিজেকে ভেতরে ভেতরে নারী নারী মনে হলেও শরীয়তের দৃষ্টিতে তার নিজেকে নারী হিসেবে প্রকাশ করার সুযোগ নেই।

তদ্রুপ কোনো নারীর নিজেকে ভেতরে ভেতরে পুরুষ পুরুষ লাগলেও শরীয়তের দৃষ্টিতে তার নিজেকে পুরুষ হিসেবে প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই; বরং কোনো পুরুষের যদি নিজেকে নারী নারী মনে হয় তবে এটি তার মানসিক রোগ।

তখন শরীয়তের দৃষ্টিতে তার উপর জরুরি হল, নিজে নিজেই চেষ্টা করে এবং প্রয়োজনে যথাসম্ভব চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এই নারীবোধ দূর করা এবং পরিপূর্ণ পুরুষরূপে জীবন যাপন করা।

তা না করে উল্টো সে যদি তার এই মেয়েলিভাবকে ভেতরে লালন করতে থাকে; এবং মানুষের সামনে নিজেকে মেয়েলিভাবেই প্রকাশ করে, তাহলে সে চরম গুনাহগার হবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের লানতের শিকার হবে।

তদ্রুপ নারীদের ক্ষেত্রেও একই হুকুম। কোনো নারীর যদি নিজেকে পুরুষ পুরুষ মনে হয় তাহলে নিজে নিজে চেষ্টা করে এবং প্রয়োজনে যথাসম্ভব চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে তার পুরুষবোধকে দূর করা এবং পরিপূর্ণ নারীরূপে জীবন যাপন করা জরুরি।

তা না করে উল্টো সে যদি তার পুরুষালিভাবকে ভেতরে লালন করতে থাকে এবং মানুষের সামনে নিজেকে পুরুষালিভাবেই প্রকাশ করে তাহলে সেও মারাত্মক গুনাহগার হবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের লানতের শিকার হবে।

হাদীস শরীফে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীরূপ ধারণকারী পুরুষদের উপর এবং পুরুষরূপ ধারণকারী নারীদের উপর লানত করেছেন এবং বলেছেন, তাদেরকে তোমাদের ঘর থেকে বের করে দাও।

বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুককে (তাঁর ঘরে আসলে) বের করে দিয়েছেন এবং অমুককে উমর রা. বের করে দিয়েছেন। সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৮৮৬

অপর হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ লানত করেন আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি সাধনকারী ঐ সকল নারীর প্রতি, যারা অন্যের শরীরে উল্কি অঙ্কন করে ও নিজ শরীরে উল্কি অঙ্কন করায় এবং যারা সৌন্দর্যের জন্য ভ্রু-চুল উপড়িয়ে ফেলে ও দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি ১১ করে।Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৮৬

আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐসব পুরুষকে লানত করেছেন, যারা নারীর বেশ ধারণ করে এবং ঐসব নারীকে লানত করেছেন, যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে।সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৮৮৫

অপর হাদীসে এসেছে, আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লানত করেছেন এমন পুরুষের ওপর, যে নারীর মতো পোশাক পরিধান করে এবং এমন নারীর ওপর, যে পুরুষের মতো পোশাক পরিধান করে। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৩০৯

পাঁচ. এ তো হচ্ছে নারী ও পুরুষের একে অন্যের বাহ্যিক সাদৃশ্য অবলম্বন সম্পর্কে শরীয়তের বিধান। শরীয়ত এতেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। আর ট্রান্সজেন্ডারবাদ এর থেকে বহুগুণ ভয়াবহ মতবাদ।

এটা শুধু নারী ও পুরুষের একে অন্যের বাহ্যিক সাদৃশ্য অবলম্বনের বিষয় নয়; বরং এতে নারী-পুরুষের সৃষ্টিগত লিঙ্গ পরিচয়কেই পরিবর্তন করে দেওয়া হচ্ছে। যার ফলে মানবসমাজের জীবন ব্যবস্থা ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে, চরম বিশৃঙ্খলা, ক্সনতিক অবক্ষয় ও নানাবিধ সমস্যার জটলা ক্সতরি হবে।

এর চেয়েও ভয়াবহ হল, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির বিকৃতি এবং তার দেওয়া শরীয়ত ও কুরআন-সুন্নাহর বিধান সবকিছুর সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ হয়। ট্রান্সজেন্ডারবাদের মতো স্বভাববিরুদ্ধ ও সুস্থ রুচি-প্রকৃতি পরিপন্থী এ মতবাদ যদি সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়, তাহলে তার অনিবার্য পরিণতির কয়েকটি হল-

ক. সমকামিতার মত ভয়ানক অপরাধের পথ খুলে যাওয়া।

খ. যিনা-ব্যভিচারের অবাধ বিস্তার।

গ. ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন সহজ হয়ে যাওয়া।

ঘ. ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ও ভয়াবহ সামাজিক বিপর্যয়।

ঙ. আল্লাহর দেওয়া শরীয়ত ও কুরআন সুন্নাহর অসংখ্য বিধানের বিরুদ্ধাচরণ।

ক. সমকামিতা ট্রান্সজেন্ডারবাদকে স্বীকৃতি দেওয়ার একটি অনিবার্য ফল হল সমকামিতাকে বধৈতা প্রদান। অথচ ধর্ম ও সমাজ উভয় দিক থেকে নারী-পুরুষের সমলিঙ্গে বিবাহের কোনো সুযোগ নেই। অনেক দেশের আইনেও তা নিষিদ্ধ। কিন্তু কিছু বিকৃত রুচির লোক এতেই আগ্রহী।

তাদের এহেন কুরুচি বাস্তবায়নের পথে ধর্ম, সমাজ ও অনেক দেশের আইনও বাধা। কোনো পুরুষ যদি নিজেকে নারী মনে করে আর রাষ্ট্র ও সমাজ তা মেনে নেয়, তাহলে তার জন্য অপর পুরুষকে বিয়ে করার পথ সুগম হয়ে যায়। অথচ বাস্তবে সে পুরুষ এবং বিয়ে করছে অপর পুরুষকে; যা সুস্পষ্ট সমকামিতা।

তদ্রুপ কোনো নারী যদি নিজেকে পুরুষ পরিচয় দেয়, আর রাষ্ট্র ও সমাজ তা মেনে নেয়, তাহলে তার জন্য অপর নারীকে বিবাহ করতে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কোনো বাধা থাকে না। অথচ এটি হচ্ছে নারীতে নারীতে বিবাহ; যা সম্পূর্ণ সমকামিতা।

আর সমকামিতা যে শরীয়তের দৃষ্টিতে জঘণ্য হারাম তা তো সবারই জানা। এ অপরাধের কারণেই হযরত লূত আলাইহিস সালামের কওমের উপর কঠিন আসমানী আযাব এসেছিল। যা কুরআন কারীমের অনেক সূরায় বর্ণিত হয়েছে। এখানে আমরা দুটি সূরা থেকে উদ্ধৃত করছি- এবং লূতকে (পাঠালাম)। যখন সে নিজ সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের আগে সারা বিশ্বে কেউ করেনি?

তোমরা তো কামেচ্ছা পূরণের জন্য নারীদেরকে ছেড়ে পুরুষের কাছে যাও! বরং তোমরা এক সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়।

তার সম্প্রদায়ের উত্তর ছিল কেবল এই কথা যে, এদেরকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা তো এমন লোক, যারা বড় পবিত্র থাকতে চায়’। পরিণামে আমি তাকে (অর্থাৎ হযরত লূত আলাইহিস সালামকে) ও তার পরিবারবর্গকে (জনপদ থেকে বের করে) রক্ষা করলাম, তবে তার স্ত্রী ছাড়া।

সে অবশিষ্ট লোকদের মধ্যে শামিল থাকল (যারা আযাবের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়)। আর আমি তাদের উপর (পাথরের) প্রচ- বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। সুতরাং দেখ, সে অপরাধীদের পরিণাম কেমন (ভয়াবহ) হয়েছিল। সূরা আরাফ (৭) : ৮০-৮৪

এবং আমি লূতকে (নবী বানিয়ে পাঠালাম)। যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কি চোখে দেখেও অশ্লীল কাজ করছ? তোমরা কি কামচাহিদা পূরণের জন্য নারীদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে গমন কর? তোমরা তো এক মূর্খ সম্প্রদায়। সূরা নামল (২৭) : ৫৪-৫৫

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- কোনো পুরুষ অপর পুরুষের সতরের প্রতি তাকাবে না এবং কোনো নারী অপর নারীর সতরের প্রতি তাকাবে না। কোনো পুরুষ এক কাপড়ের নিচে অপর পুরুষের শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর লাগাবে না এবং কোনো নারী এক কাপড়ের নিচে অপর নারীর শরীরের সঙ্গে নিজের শরীর লাগাবে না। সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৩৮; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৭৯৩

এই হল ট্রান্সজেন্ডারবাদের এক অনিবার্য পরিণতি। সুকৌশলে মানুষকে ধোঁকা দিয়ে সমকামী বিবাহকে ক্সবধ ও স্বাভাবিকীকরণের উদ্দেশ্যে তারা সরাসরি সমকামী বিবাহের দাবি না করে নারী-পুরুষের লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তনে হাত দিয়ে বসেছে।

তাই এ বিষয়ে সকলের সোচ্চার হওয়া জরুরি।

(চলবে...)

এনএ/