কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষার তাগিদ দেয় ইসলাম: মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান নদভী
প্রকাশ: ২৩ মে, ২০২৪, ০৭:৪১ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান নদভী। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন নিভৃতচারী আলেম। রাজধানীর মিরপুর-১২ মাদরাসা দারুর রাশাদ’র মুহতামিম। ইসলাম শিক্ষার সঙ্গে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বিষয়ে সম্প্রতি আওয়ার ইসলামের সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসান আল মাহমুদ। সঙ্গে ছিলেন মুহাম্মাদ বিন ইয়ামিন। সাক্ষাৎকার সহযোগিতায় ছিলেন দারুর রাশাদের শিক্ষক মাওলানা এনামুল করীম ইমাম

আওয়ার ইসলাম: কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থায় ইসলাম কতোটা গুরুত্ব হিসাবে দেখে?

মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান নদভী: আল্লাহ তাআলা দুনিয়াকে দারুল আসবাব বা উপকরণের জগত বানিয়েছেন। এখানে মানুষের বহুমাত্রিক প্রয়োজন রয়েছে। এসব প্রয়োজন পূরণ এবং অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে আঞ্জাম দেওয়ার জন্য মানুষকে দান করা হয়েছে প্রয়োজনীয় জ্ঞান-বুদ্ধি ও শক্তি-সামর্থ্য। এগুলো কাজে লাগানোর জন্য পূর্ণমাত্রায় গুরুত্ব দিয়েছে ইসলাম। কুরআন মাজিদে ইরশাদ হচ্ছে :

وَأَعِدُّوا لَهُمْ مَا اسْتَطَعْتُمْ مِنْ قُوَّةٍ

তোমরা তোমাদের সাধ্যমতো শক্তি অর্জন কর। [সুরা আনফাল, আয়াত : ৬০]

একজন সবল ও শক্তিমান মুমিন আল্লাহ তাআলার কাছে খুবই প্রিয়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ، خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ

একজন সবল ঈমানদার ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দুর্বল ঈমানদার অপেক্ষা অধিক প্রিয় ও উত্তম। [সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬২৬৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৭৯]

অর্থাৎ এখানে শক্তি অর্জন করে তা কর্মজীবনে ব্যয় করতে জোর তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। পবিত্র কুরআনে নামাজ আদায়ের পরই কর্মতৎপর হয়ে বেরিয়ে পড়তে বলা হয়েছে। কর্মতৎপরতায় জোর দিয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন :

فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ

নামাজ আদায় সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে। [সুরা জুমআ, আয়াত : ১০]

হাদিসে নববিতে কর্মতৎপরতার প্রতি অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

طَلَبُ كَسْبِ الْحَلَالِ فَرِيضَةٌ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ

অন্যান্য ফরয আদায়ের সাথে সাথে হালাল রুজি-রোজগারের ব্যবস্থা গ্রহণ করাও একটি ফরয। [শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৮৩৬৭; সুনানুল কুবরা লিল-বায়হাকি : ১১৬৯৫]

এই বিবেচনায় ইমাম সাঈদ ইবনে ইয়াজিদ রহ. বলেন, পাঁচটি গুণের মাঝে ইলমের পূর্ণতা রয়েছে :

১. আল্লাহ তাআলাকে চেনা।

২. সবার হক বোঝা।

৩. একমাত্র আল্লাহর জন্য ইখলাসপূর্ণ আমল করা।

৪. সুন্নাহ মোতাবেক আমল করা এবং

৫. কর্মতৎপর হয়ে হালাল রুজি উপার্জন করা।

এর যেকোনো একটি নষ্ট হলে আমল কবুল হবে না।

[তাফসিরে কুরতুবি : ২/২০৮]

এজন্য ইমাম গাজালি রাহি. জাগতিক জ্ঞানার্জনকে জরুরী সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেন, অনুমোদিত জাগতিক জ্ঞান দুই ভাগে বিভক্ত :

১. যা চর্চা করা অপরিহার্য।

২. যা চর্চা করা উত্তম।

প্রথমটি হচ্ছে ওই সব জ্ঞান যা মানুষের জন্য অপরিহার্য। যেমন চিকিৎসা বিদ্যা। প্রকৌশল বিদ্যা, গণিত, কৃষি, বয়ন, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদির মৌলিক পর্যায়ের জ্ঞান। সুস্বাস্থ্য, জীবন যাপন, লেনদেন, মিরাস বন্টন ইত্যাদি বিষয়ে এগুলো জরুরী। গোটা জনপদে যদি এই জ্ঞানে পারদর্শী কেউ না থাকে তাহলে সবার কষ্ট হবে। এজন্য এসব ইলম অর্জন করা ফরজে কেফায়া। [ইহইয়াউ উলুমিদ-দ্বীন : ১/২৯-৩০]

মোটকথা, পার্থিব জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয় ও কল্যাণকর জ্ঞান অর্জন করাকে ইসলাম প্রয়োজনীয় মনে করে। এজন্য জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মৌলিকভাবে অনৈসলামিক মনে করার অবকাশ নেই। তবে জাগতিক জ্ঞান ও কলাকৌশল অর্জন করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি করে মুসলিমদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার নিয়ত থাকতে হবে। কারণ, বর্তমান সময়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সামরিক শক্তিতে সর্বোচ্চ পারদর্শিতা অর্জন করা ছাড়া দ্বীন বিজয়ী করা সম্ভব না। 

আওয়ার ইসলাম: দারুল উলুম দেওবন্দ কারিগরি শিক্ষাকে কিভাবে গুরুত্ব দেয়?

মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান নদভী: উলামায়ে কেরামের ফতোয়া হলো, ইসলামের খেদমতের জন্য আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার করা হলে সেটা আর দুনিয়াবী কাজ থাকে না, সম্পূর্ণরূপে ইসলামের খেদমত তথা ইবাদত হিসেবে গণ্য হয়। অনুরূপভাবে দ্বীন প্রচার-প্রসারের জন্য কম্পিউটার, প্রকাশনা এবং মিডিয়াসহ অত্যাধুনিক মাধ্যমগুলোর জ্ঞান অর্জন করা বর্তমান সময়ে অনেক দরকারী।

লক্ষ করা যাচ্ছে, কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা জীবনমুখী ও কর্মমুখী শিক্ষা থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। অথচ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কর্মমুখী শিক্ষা বিশেষ জরুরী। এখানে এজাতীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। অথচ উপমহাদেশে ইংরেজদের পক্ষপাতদুষ্ট শাসনের আগেও মাদরাসাগুলোতে বিজ্ঞান ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রচলন ছিল। শাইখুল ইসলাম মুফতি মুহাম্মাদ তাকি উসমানি দা. বা. বলেন :

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আগে মাদরাসা এবং স্কুল নামের দুটি ধারার শিক্ষাব্যবস্থার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, এ অঞ্চলে ইসলামের সূচনা থেকে ব্রিটিশ যুগের আগ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে একসঙ্গে দ্বীনি ও জাগতিক কর্মমুখী দুধারার শিক্ষাব্যবস্থার ব্যবস্থা ছিল। [বর্তমান সময়ে প্রয়োজন নতুন এক শিক্ষাব্যবস্থা, মুফতি তাকি উসমানি]

আসলেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পূর্ববর্তী উপমহাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ঘাঁটলে দেখা যায় যে, কুরআন ও হাদিস শিক্ষার সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এরপর শিক্ষার্থী নিজ মেধা অনুযায়ী চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, প্রকৌশল, ব্যবসায়-বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন কর্মমুখী উচ্চশিক্ষাকে বেছে নিতেন। 

তবে দারুল উলুম দেওবন্দে কেন কর্মমুখী শিক্ষা রাখা হয়নি? এই প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম বলেন, ভারতবর্ষের মুসলিমদের দ্বীন ও ঈমান যখন মারাত্মক হুমকির মুখে। বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মুসলিমদের খ্রিষ্টান বানানোর মিশন চলছিল, তখন দারুল উলুমকে খালেস দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হয়। যাতে এটি সাধারণ মুসলিমদের দ্বীন ও ঈমান হেফাজতের কেন্দ্র হতে পারে। আর এখন যেহেতু সেই অবস্থা নেই। এজন্য সেই একমুখী শিক্ষাও এখন অযৌক্তিক।

দারুল উলুমের সাবেক প্রধান মুফতি মুহাম্মদ শফি রহ. কোনো সাধারণ এক সমাবেশে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছিলেন ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতবর্ষে (মুসলমানদের জন্য) বিশেষ তিনটি শিক্ষাধারা প্রচলিত ছিল:

ক. দারুল উলুম দেওবন্দভিত্তিক শিক্ষাধারা।

খ. আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটিকেন্দ্রিক পড়াশোনা।

গ. দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার সিলেবাসকেন্দ্রিক শিক্ষাধারা।

‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আমাদের আলীগড়ের শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন নেই, নদওয়ারও প্রয়োজন নেই; এমনকি প্রয়োজন নেই দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাব্যবস্থারও; বরং আমাদের প্রয়োজন একটি তৃতীয় শিক্ষাব্যবস্থা, যা আসলাফ ও পূর্বসূরিদের ইতিহাসের ধারায় আমাদের সম্পৃক্ত করার সাথে সাথে আমাদের কর্মমুখী করবে।’

এটা ছিল হজরতের উম্মাহর প্রতি দরদভরা অত্যন্ত সূক্ষ্ম, দূরদর্শী ও তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য।

বিশ্বের অনেক মুসলিম সভ্যতায়ও জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কর্মমুখী শিক্ষাকে জীবনোন্নয়নের পাথেয় হিসাবে নেওয়া হয়েছিল। এজন্যই সেসময় বিশ্বখ্যাত অনেক মুসলিম বিজ্ঞানী পৃথিবী আলোকিত করেছিলেন। যেমন জাবির ইবনে হাইয়ান, আল বিরুনি, ইবনে সিনা, ওমর খৈয়াম, আল ফারাবি, আল বাত্তানি, মুসা আল খাওয়ারিজমি, আল বলখি, আল কিন্দি, আল সাইগ, ইবনে হাইছাম, আল-রাযি, বানু মুসা, ইবনুন নাফিস ও আল বেতরুগি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

চলমান......

হাআমা/