শরীয়তের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ নিয়ে একটি প্রামাণ্য ফতোয়া
প্রকাশ:
২২ মে, ২০২৪, ১০:০৭ রাত
নিউজ ডেস্ক |
ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন এবং এর রয়েছে স্বতন্ত্র নীতি-আদর্শ ও জীবনপদ্ধতি। কিয়ামত পর্যন্ত সকল সমস্যার সমাধান এতে রয়েছে। যত ভয়ঙ্কর ফিতনাই আসুক, তা থেকে বাঁচার জরুরি পথনির্দেশনা এ দ্বীন ও শরীয়তে আগে থেকেই বিদ্যমান আছে। বর্তমান যুগে ট্রান্সজেন্ডারবাদ নামে খুবই ভয়ঙ্কর এক ফিতনার প্রকাশ ঘটেছে, যাকে বলা যায় ‘সকল নোংরামি ও অশ্লীলতার মূল’। আফসোস, পাশ্চাত্য থেকে ছড়াতে ছড়াতে এখন তা মুসলিম দেশগুলোতেও অনুপ্রবেশ করতে শুরু করেছে। সচেতন মুসলিমগণ এ সম্পর্কে শরীয়তের বিধান জানতে চান। দেশের প্রায় সকল দারুল ইফতাতেই এ বিষয়ে প্রশ্ন আসছে। যেহেতু এটা একটা জাতীয় বরং আন্তর্জাতিক সমস্যা, তাই সঙ্গত মনে হল এ বিষয়ে জাতীয় প্রতিষ্ঠান ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর ‘জাতীয় মুফতি বোর্ড’ এর পক্ষ থেকে দলীলসমৃদ্ধ বিস্তারিত ফতোয়া প্রকাশ করা হোক। সেমতে ২৩ জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৫ হি. মোতাবেক ০৬ জানুয়ারি ২০২৪ ঈ. তারিখে জাতীয় মুফতি বোর্ডের মজলিস আহ্বানপূর্বক দাওয়াতনামা প্রেরণ করা হয় এবং ঘোষিত তারিখ ৩০ জুমাদাল আখিরা ১৪৪৫ হি. মোতাবেক ১৩ জানুয়ারি ২০২৪ ঈ. শনিবার মুফতি বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। মজলিসের কয়েকজন সদস্য নির্ধারিত বিষয়ে ফতোয়ার মুসাবিদা প্রস্তুত করে আনেন। একটি মুসাবিদা মজলিসে পড়ে শুনানো হয়। কিছু পরামর্শও সামনে আসে। চূড়ান্ত ফতোয়া প্রস্তুত করার জন্য নিম্নবর্ণিত ৫ (পাঁচ) সদস্যবিশিষ্ট একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়: সাব-কমিটি ঐ দিনই ফতোয়াটি নযরে সানী করেন। এরপর ০৪ শাবান ১৪৪৫ হিজরী মোতাবেক ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ঈসাব্দ তারিখে এক দীর্ঘ সভায় ফতোয়াটি আরো গভীরভাবে সম্পাদনা ও পরিমার্জন করা হয় এবং তাতে জরুরি সংযোজনও করা হয়। এভাবে সাব-কমিটি ফতোয়াটিকে চূড়ান্ত রূপ দান করে আমার সামনে পেশ করে। আমি ফতোয়াটি দেখে আল্লাহ তা‘আলার শোকর আদায় করেছি। আলহামদুলিল্লাহ, ফতোয়াটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে দলীলসমৃদ্ধ আকারে প্রস্তুত করা হয়েছে। অদ্য ১২ যিলকদ ১৪৪৫ হিজরী মোতাবেক ২১ মে ২০২৪ ঈসাব্দ, মঙ্গলবার জাতীয় মুফতি বোর্ডের সভায় দীর্ঘ পর্যালোচনার পর ফতোয়াটি প্রকাশের অনুমোদন দেয়া হয়। সর্বসাধারণের উপকারিতার কথা বিবেচনা করে ফতোয়াটি ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ এর প্রকাশনা বিভাগ থেকে ছাপানো হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এর মাধ্যমে পুরো উম্মতকে উপকৃত করুন। জাতির দায়িত্বশীলদেরকে নিজ নিজ দায়িত্ব আদায়ের তাওফীক দান করুন। আমীন। (মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা) মাহমুদুল হাসান ট্রান্সজেন্ডারবাদ বিষয়ে জিজ্ঞাসা বরাবর, বিষয় : ট্রান্সজেন্ডারবাদ বিষয়ে শরয়ী বিধান প্রসঙ্গে। মুহতারাম, সম্প্রতি একাধিক দৈনিক পত্রিকা ও মিডিয়া মারফত জানতে পারলাম, ‘‘ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন ২০২৩’’ নামে একটি আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। আইনের খসড়া কপিটি আমি সংগ্রহ করেছি এবং পড়ে দেখেছি। সেখানে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির পরিচয়ে বলা হয়েছে “ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি বলিতে বুঝাইবে (ক) জৈবিক লিঙ্গ জৈবশিষ্ট্য সম্পন্ন এমন ব্যক্তি যাহাকে পূর্ণাঙ্গ নারী বা পুরুষ কোনো লিঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না, অথবা জন্মকালে যাহার মধ্যে লিঙ্গ জৈবচিত্র পরিলক্ষিত হইবার কারণে লিঙ্গ নির্ধারণ করা সম্ভব হয় নাই এমন আন্তঃলিঙ্গ ব্যক্তি; অথবা (খ) এমন ব্যক্তি, শারীরিক-মানসিক ও আচরণগত বা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার রূপান্তরের ফলে যাহার প্রকাশ ভঙ্গিতে পরিবর্তন ঘটিয়াছে। ট্রান্সজেন্ডার ম্যান বা ট্রান্সজেন্ডার উইম্যান বা সামাজিক-সংস্কৃতিগতভাবে হিজড়া নামে পরিচিত ব্যক্তিও এর আওতাভুক্ত হইবেন; অথবা (গ) এমন ব্যক্তি, যিনি নিজেকে জেন্ডার নৈর্ব্যক্তিক অনুভব করেন।” এখানে ট্রান্সজেন্ডারের পরিচয়ের মাঝে হিজড়াকেও দাখিল করা হয়েছে, অথচ হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার টার্ম দুটির মাঝে বিশাল পার্থক্য রয়েছে। হিজড়া হল জন্মগত শারীরিক ত্রুটিযুক্ত ব্যক্তি আর ট্রান্সজেন্ডার হল মনস্তাত্ত্বিক লিঙ্গ অভিব্যক্তি বা জেন্ডার সম্পর্কীয়। ট্রান্সজেন্ডারবাদ মূলত জেন্ডার বিষয়ক পাশ্চাত্যের একটি ধারণা। ট্রান্সজেন্ডার মানে হল, যার মনস্তাত্ত্বিক লিঙ্গবোধ জন্মগত লিঙ্গ চিহ্ন থেকে ভিন্ন। এ মতবাদ অনুযায়ী শারীরিক গঠনে স্বাভাবিক কোনো পুরুষ যদি নিজেকে নারী বোধ করে, তাহলে সে নারী। অনুরূপভাবে শারীরিক গঠনে স্বাভাবিক কোনো নারী যদি নিজেকে পুরুষ বোধ করে, তাহলে সে পুরুষ। অর্থাৎ জন্মগত লিঙ্গ দিয়ে নারী-পুরুষ চিহ্নিত করা হবে না; বরং নারী-পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার মাধ্যম হবে মনস্তাত্ত্বিক লিঙ্গবোধ। নিজেকে যা মনে করেন তিনি তা। এ মতবাদে ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার জন্য সার্জারির মাধ্যমে বা হরমোন থেরাপির মাধ্যমে শারীরিক কাঠামো পরিবর্তন করা আবশ্যক নয়, করতেও পারে, আবার নাও করতে পারে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অধিকার ও নিয়মাবলি তার রূপান্তরিত অবস্থা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তি কর্তৃক অনুসৃত ধর্ম অনুসারে তাহার জন্য সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিম্নে বর্ণিতভাবে নির্ধারিত হইবে। যথা ট্রান্সজেন্ডার ম্যান-এর জন্য উত্তরাধিকারের অংশ পুরুষের অংশের অনুরূপ হইবে; ট্রান্সজেন্ডার উইম্যান-এর জন্য উত্তরাধিকারের অংশ নারীর অংশের অনুরূপ হইবে।” এ মতবাদ দ্বারা পারিবারিক কলহ ও ঝগড়া-বিবাদের সূচনা হবে। নারীদের সামাজিক নিরাপত্তাও অনেকাংশে হুমকির মুখে পড়বে। ট্রান্সজেন্ডার আইনের ভয়াবহ দিকগুলো হয়েছে, এর দ্বারা যিনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে। ট্রান্সজেন্ডারবাদের বিরুদ্ধে তুরস্ক, চীন ও রাশিয়াসহ অনেক দেশ সোচ্চার হয়েছে; কিন্তু‘ যদ্দুর জানা গেছে, আমাদের দেশে নাকি তা আইনি বৈধতা পেতে যাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রসিদ্ধ অনেক মিডিয়াতে ট্রান্সজেন্ডারবাদকে খুব ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। তার পক্ষে যুক্তি দেয়া হচ্ছে। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদেরকে নিয়েও খুব মাতামাতি করা হচ্ছে। যা দেশের অনেক সাধারণ জনগণের মাঝে ধোঁয়াশা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। এমতাবস্থায় আমাদের মতো সাধারণ জনগণের বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর জানতে চাই- ক. ট্রান্সজেন্ডারবাদ সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী? খ. ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে হিজড়া আর ট্রান্সজেন্ডার কি এক, না ভিন্ন? গ. হরমোন থেরাপি বা সার্জারির মাধ্যমে লিঙ্গ পরিচয় পরিবর্তনের অনুমতি আছে কি? ঘ. মুসলিম দেশে এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা শরীয়তের দৃষ্টিতে কেমন এবং এ বিষয়ে আমাদের করণীয় কী? ঙ. হিজড়াদের ব্যাপারে শরীয়তের বিধান কী? মীরাস (উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন), বিবাহ, পর্দা ইত্যাদি বিধানগুলোতে তাদের ক্ষেত্রে কী পন্থা অবলম্বন করা হবে? চ. শরীয়তের দৃষ্টিতে হিজড়াদের জন্য হরমোন থেরাপি ও সার্জারির অনুমতি আছে কি? অতএব মুফতি বোর্ড সমীপে আবেদন, আমার উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর শরয়ী সমাধান দিয়ে বাধিত করবেন। বিনীত নিবেদক- শামিম বিন যায়নুল আবেদীন সুতরাং ‘ট্রান্সজেন্ডার’ মানে হল রূপান্তরিত লিঙ্গ। ট্রান্সজেন্ডারকে সংক্ষিপ্তাকারে কখনো শুধু ট্রান্সও বলা হয়। পরিভাষায় ট্রান্সজেন্ডার হল এমন ব্যক্তি, যার মানসিক লিঙ্গবোধ জন্মগত লিঙ্গ চিহ্ন থেকে ভিন্ন। নারী পুরুষ নির্ধারণের এ নতুন ধারণা অর্থাৎ শারীরিক লিঙ্গ চিহ্নের বাইরে মানসিক বোধকে লিঙ্গ পরিচয়ের মানদন্ড হিসেবে দাঁড় করানো সকল আসমানী শরীয়ত এবং সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনীত শরীয়ত বিরোধী। এটি শুরু হয় অমুসলিমদের কাছ থেকে। এক্ষেত্রে যাদের নাম আসে, তাদের প্রথম সারিতে আছেন গত শতকের চরম বিতর্কিত সেক্সোলজিস্ট ড. জন উইলিয়াম মানি। ১৯৫৫ সনে তার এক লেখায় তিনি ‘জেন্ডার’ শব্দকে সেক্স থেকে আলাদা করে ব্যবহার করেন। লেখাটি জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির বুলেটিন, জুন ১৯৫৫ সংখ্যায় ছাপা হয়। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ম্যাগাজিন এ উদ্ধৃতির সারকথা হল, তিনিই (জন মানি) প্রথম ব্যক্তি, যিনি ১৯৫৫ সালে ‘সেক্স’-এর বিপরীতে ‘জেন্ডার’ ব্যবহার করেছেন। এর দ্বারা তিনি জন্মগত লিঙ্গ পরিচয়ের পরিবর্তে আচরণগত পার্থক্যকে লিঙ্গ পরিচয়ের মানদ- বানিয়েছেন। তিনি পরবর্তীকালে ‘জেন্ডার পরিচয়’ -এর মত শব্দগুলোকে জনপ্রিয় করে তোলেন। সর্বোপরি তিনি এ মত সামনে আনেন যে, আমরা যে লিঙ্গ পরিচয় নিয়েই জন্মগ্রহণ করি না কেন, সেটা আমরা পুরুষ, না নারী, তা নির্ধারণ করে না! জন মানিকে বলা হয়েছে যৌন স্বাধীনতাবাদী। অনেকেই তাকে বিকৃতকারী আখ্যা দিয়েছে। এটা করতে গিয়ে জন মানি যা করেছেন, তা ছিল অমানবিক, নোংরামি ও চরম ঘৃণ্য। ছেলেটি মেয়ে তো হয়নি, উপরš‘ তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তার দিন কাটছিল। পরিশেষে ৩৮ বছর বয়সে সে আত্মহত্যা করে। ডেভিড রেইমার আত্মহত্যা করে ২০০৪ সালে, ততদিনে পশ্চিমা গবেষকদের হাত ধরে পাশ্চাত্যে এ মতবাদটি ছড়িয়ে পড়ে। আর প্রভাবশালী বিভিন্ন গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় এবং মিডিয়ার প্রচারণায় এর ক্রমবিস্তার ঘটে। আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য প্রথমে কিছু মৌলিক বিষয় জেনে রাখা দরকার। কয়েকটি মৌলিক কথা এক. মানুষ সাধারণভাবে জন্ম থেকেই হয়ত পুরুষ কিংবা নারী। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে এ দুই ভাগেই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন- আর তিনিই সৃষ্টি করেছেন যুগল পুরুষ ও নারী। সূরা আন নাজম (৫৩) : ৪৫ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম আবু বকর জাসসাস রাহ. বলেন- অর্থাৎ এখানে পুরুষ ও নারী) যেহেতুউভয় শ্রেণির নাম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তাই সবাই এই দুই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। আর এটা প্রমাণ করে যে, পুরো মানব জাতি হয়তো পুরুষ নতুবা নারী। আর হিজড়ার অবস্থা বাহ্যত আমাদের সামনে অস্পষ্ট লাগলেও তারা নারী ও পুরুষের বাইরে নয়। আহকামুল কুরআন, ইমাম জাসসাস রাহ. খ. ৩, পৃ. ৫৫১ অর্থাৎ হিজড়ার মাঝে বাহ্যত উভয় ধরনের আলামত পরিলক্ষিত হলেও আলামতগুলো শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট হয়ে যায় কোন্ হিজড়া পুরুষ আর কোন হিজড়া নারী। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তো তা আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। আর একেবারেই জটিল হিজড়া, যার শ্রেণি নির্ণয় করা কঠিন, তাদের সংখ্যা খুব নগণ্য। তারা মূলত এক ধরনের প্রতিবন্ধী; ভিন্ন কোনো শ্রেণি নয়। উল্লেখ্য, হিজড়াকে আরবীতে ‘খুনসা’ বলা হয়। ফিকহ-ফতোয়ার কিতাবে খুনসা অধ্যায়ে খুনসার যাবতীয় বিধি-বিধান উল্লেখিত হয়েছে। বিস্তারিত ১৭-১৯ পৃষ্ঠায় আসছে। যাহোক, মানুষ জন্ম থেকেই হয়ত পুরুষ, নতুবা নারী। নারী ও পুরুষ উভয় শ্রেণিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ভিন্ন ভিন্ন এমন বিশেষ কিছু অঙ্গ ও শারীরিক অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন যে, কোনও শিশু যখন জন্মগ্রহণ করে, সে ছেলে নাকি মেয়ে, মানুষ দেখেই তা বুঝতে পারে। এরপর তার বড় হওয়ার সাথে সাথে তার এই পরিচয়টি আরো পরিষ্কার হতে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাওয়ার পর ছেলে হলে তার দেহে পুরুষের অন্যান্য আলামত এবং মেয়ে হলে তার দেহে নারীর অন্যান্য আলামত সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা মানুষকে বিশেষ কিছু অঙ্গ ও সক্ষমতায় এমনভাবে দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছেন যে, এর দ্বারা কে পুরুষ আর কে নারী সেটি তার দেহ থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। মানুষের দেহে নারী-পুরুষ হিসেবে এই পার্থক্য ও ভিন্নতা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। সৃষ্টিগত এই ভিন্নতার উপর ভিত্তি করে নারী-পুরুষের লিঙ্গ নির্ধারণ যেমনিভাবে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিগত বিধান, তেমনি আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়তেরও বিধান। শরীয়তের দৃষ্টিতে কারো জন্য এই ভিন্নতায় হস্তক্ষেপের কোনো রকম সুযোগ নেই। আর মানুষের মাঝে নারী ও পুরুষ হিসেবে ক্সদহিক ও গঠনগত যে ভিন্নতা রয়েছে, এর উপর ভিত্তি করে আল্লাহ তাআলা উভয় শ্রেণির মাঝে সৃষ্টিগতভাবেই পরস্পর আকর্ষণবোধও সৃষ্টি করে দিয়েছেন। যার কারণে উভয় শ্রেণি পরস্পর শারীরিক সম্পর্কের প্রয়োজন বোধ করে। যার ভিত্তিতে সন্তান জন্ম হয় এবং মানবজাতির বংশ বিস্তার হয়। আর এ শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টিও আল্লাহর দেওয়া বিধান মতেই হতে হবে। স্রষ্টার বিধানের বাইরে কোনো নারী-পুরুষের জন্য শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো হারাম। একই কারণে পুরুষের সাথে পুরুষের এবং নারীর সাথে নারীর শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর কোনও সুযোগ নেই। তা সম্পূর্ণ হারাম ও চরম ঘৃণিত কাজ। এই হচ্ছে নারী-পুরুষের শ্রেণি ভিন্নতা ও লিঙ্গ নির্ধারণ এবং পরস্পরের শারীরিক সম্পর্ক বিষয়ক আল্লাহ তাআলার দেওয়া বিধান। এবং এ অনুযায়ী শুরু থেকেই মানবজাতির জীবনধারা ও সমাজ ব্যবস্থা চলমান। নগণ্য কিছু বিকৃত রুচি ও বিকৃত মনমানসিকতার লোক, যারা নারী-পুরুষের ক্সববাহিক ক্সবধ সম্পর্ক বাদ দিয়ে যিনা-ব্যভিচার এবং সমকামিতায় আগ্রহী, শুধু তারাই আল্লাহর দেওয়া বিধান ও সমাজব্যবস্থার থেকে বিচ্যুত। এই কুরুচিপূর্ণ ও অবাধ যৌনাচারের চূড়ান্ত রূপ হিসেবে বর্তমানকালে প্রকাশ পায় ‘ট্রান্সজেন্ডারবাদ’। মানুষের চিরায়ত ও সু¯’ রুচি-প্রকৃতির পরিপন্থী, ইসলাম ও কুরআন-সুন্নাহবিরোধী এই কুফরি মতবাদ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রদত্ত নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য করার শাশ্বত নিয়ম ভেঙে দিয়ে মানবসমাজকে মানবিক, সামাজিক ও ধর্মীয় সব দিক থেকে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দুই. আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানবম-লীর সৃষ্টিকর্তা, একমাত্র মালিক এবং জগৎসমূহের প্রতিপালক। দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানে মানুষের সফলতা লাভের ও সঠিক পথনির্দেশনার জন্য আল্লাহ তাআলা সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কুরআন কারীম অবতীর্ণ করেছেন। কিয়ামত পর্যন্তের জন্য তাঁকে আখেরী শরীয়ত দান করেছেন। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বাণী হাদীস ও সুন্নাহতে মানবজাতিকে সঠিক পথ, সফলতা, পবিত্রতা এবং নির্মল জীবনের পথে আহ্বান করেন। আর শয়তান যেহেতু মানুষের প্রকাশ্য দুশমন, তাই সে মানুষকে ভ্রষ্টতা, নষ্টামি, নোংরামি, পঙ্কিলতা, সংকীর্ণতা ও বিপর্যয়ের পথে ডাকে। মানবজাতির প্রতি শয়তানের এ শত্রুতার কথা আল্লাহ তাআলা কুরআনে খুব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে- হে আদম সন্তান! আমি কি তোমাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে বলিনি যে, তোমরা শয়তানের ইবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? এবং এও (বলিনি) যে, তোমরা আমার ইবাদত কর, এটিই সরল পথ? বস্তুত শয়তান তোমাদের মধ্য হতে একটি বড় দলকে গোমরাহ করেছিল। তবুও কি তোমরা বোঝনি? সূরা ইয়াসীন (৩৬) : ৬০-৬২ আরো ইরশাদ হয়েছে, হে মুমিনগণ! ইসলামে সম্পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চিত জেন, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। সূরা বাকারা (২) : ২০৮ অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে অশ্লীলতার আদেশ করে, আর আল্লাহ তোমাদেরকে স্বীয় মাগফিরাত ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। সূরা বাকারা (২) : ২৬৮ আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে এও জানিয়েছেন যে, আল্লাহ তাআলার সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন সাধন অথবা পরিবর্তনের সন্দেহ সৃষ্টি হয় এমন কিছু করার জন্য শয়তানই মানুষকে প্ররোচিত করে। এজন্য মানুষের মধ্যে যারা এমন কিছু চিন্তা করে বা এমন মতবাদের দিকে ডাকে, তারা মূলত শয়তানের অনুগামী। তারা শয়তানের পদাঙ্কই অনুসরণ করছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শয়তানকে অভিসম্পাত করে বলেছেন- যাকে (শয়তান) আল্লাহ লানত করেছেন। সে (আল্লাহকে) বলেছিল, আমি তোমার বান্দাদের মধ্য হতে নির্ধারিত এক অংশকে নিয়ে নেব। এবং আমি তাদেরকে সরল পথ হতে নিশ্চিতভাবে বিচ্যুত করব, তাদেরকে (অনেক) আশা-ভরসা দেব এবং তাদেরকে আদেশ করব, ফলে তারা চতুষ্পদ জন্তুর কান চিরে ফেলবে এবং তাদেরকে আদেশ করব, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে। শয়তান তো মানুষকে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে দেওয়ার হুকুম করে। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলার হুকুম হল সুতরাং তুমি নিজ চেহারাকে একনিষ্ঠভাবে এই দ্বীনের অভিমুখী রাখ। আল্লাহর সেই ফিতরত অনুযায়ী চল, যে ফিতরতের উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তনসাধন নেই (অর্থাৎ কোনো পরিবর্তন করো না)। এটাই সম্পূর্ণ সরল দ্বীন। কিš‘ অধিকাংশ মানুষ জানে না। সূরা রূম (৩০) : ৩০ কুরআন কারীমের এ আয়াতগুলো চিন্তা-ভাবনার সাথে পাঠ করলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ট্রান্সজেন্ডারবাদ নিরেট শয়তানী মতবাদ। আল্লাহ তাআলার দেওয়া হেদায়েত এবং তাঁর নাযিলকৃত শরীয়তের সাথে এর ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক নেই; বরং তা সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহ ও শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা, ট্রান্সজেন্ডারবাদের দাবি হল, মানুষের লিঙ্গ পরিচয় তার সৃষ্টিগত ক্সদহিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল নয়; বরং সেটি সম্পূর্ণ ব্যক্তির মানসিক ব্যাপার। যার জন্ম পুরুষ হিসেবেই হয়েছে এবং তার দেহে পুরুষের সব আলামতই আছে; পুরুষ হিসেবে তার শারীরিক কোনো ত্রুটি নেই, তারপরও সে যদি কখনো নিজেকে নারী মনে করে তাহলে সে একজন নারী। সমাজ এবং আইন তাকে নারী হিসেবেই গণ্য করতে হবে এবং সে নারী হিসেবে যাবতীয় অধিকার লাভ করবে। তার উপর নারীর যাবতীয় বিধিবিধান প্রযোজ্য হবে; পুরুষের নয়। তদ্রুপ একজন মানুষ নারী হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছে; বাহ্যিকভাবে সে সম্পূর্ণ নারী; এতে তার কোনো ত্রুটি নেই; তার ঋতুস্রাব হয়; সে গর্ভধারণ করে এবং সন্তান জন্ম দেয়, সন্তানকে স্তন্য দান করে, তথাপি সে যদি নিজেকে কখনো পুরুষ মনে করে তাহলে সে একজন পুরুষ। সমাজ ও আইন তাকে পুরুষ হিসেবেই গণ্য করতে হবে এবং সে পুরুষ হিসেবে যাবতীয় অধিকার লাভ করবে, তার উপর পুরুষের যাবতীয় বিধিবিধান প্রযোজ্য হবে। নাউযুবিল্লাহ। এনএ/ |