বিশ্বজয়ী হাফেজের দেশ বাংলাদেশে কেন আসছে না বিদেশি হিফজ শিক্ষার্থী
প্রকাশ:
২৮ মার্চ, ২০২৪, ০৯:৩৫ রাত
নিউজ ডেস্ক |
|| হাসান আল মাহমুদ || সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে গত এক যুগ ধরে সবচে বেশি পরিচিত হচ্ছে ক্ষুদে হাফেজ শিক্ষার্থীদের বিশ্ব জয়ের মহাকাব্যে । আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি হাফেজরা গত এক যুগের প্রায় প্রতিবছরই বিশ্বচ্যাম্পিয়নসহ বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলছেন। উচ্চ করছেন বিশ্ব দরবারে দেশের পতাকা। দেশের সুনাম বৃদ্ধিতে দেশের হিফজ শিক্ষার্থীরা স্মরণীয় অবদান রেখে চলছেন। তাদের অনন্য অবদানে বিশ্বমিডিয়ায় শিরোনাম হচ্ছে সতেরো কোটি পনেরো লাখ নব্বই হাজার মানুষের ‘বাংলাদেশ’। গত এক যুগে বাংলাদেশি হাফেজদের বিশ্বজয়: সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, লিবিয়া, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, মালয়েশিয়া, ভারত, বাহরাইনসহ বিভিন্ন দেশে আয়োজিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় বিশ্বচ্যাম্পিয়নসহ বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন বাংলাদেশি হাফেজরা। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একাধিকবার বিশ্ববুকে বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বাংলাদেশের ছেলে হাফেজ নাজমুস সাকিব। ২০১২ সালে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে অনুষ্ঠিত এশিয়া মহাদেশ কেরাত প্রতিযোগিতায় ২৭টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অর্জন করেন তিনি। তারপর ২০১৩ সালে দুবাই আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় ৮৬টি দেশের প্রতিযোগীকে টপকে প্রথম স্থানের শিরোপা অর্জন করে। ২০১৪ সালে পবিত্র মক্কায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় ৭৩ দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ওই বছরই ওমানের রাজধানী মাসকাটে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ২০১৫ সালে সুদানের রাজধানী খার্তুমে অনুষ্ঠিত আফ্রিকা মহাদেশ কেরাত প্রতিযোগিতায় ৬৫টি দেশের মধ্যে প্রথম হন। একই বছর কাতারে অনুষ্ঠিত ১৮ দেশের মধ্যে প্রথম হন। ২০১৬ সালে মালয়েশিয়া আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায়ও প্রথম স্থান অর্জন করে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি করেছে এ হাফেজে কুরআন। পড়ুন : উল্লেখযোগ্য ফতোয়া বিভাগগুলোর ওয়েবসাইট নাই কেন ২০১৫ সালে হাফেজ মুহাম্মদ হেলালুদ্দীন পবিত্র মসজিদুল হারামে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিশ্বের ৮০ দেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল কুয়েতের আওকাফ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ৫৫টি দেশের অংশগ্রহণে ‘কুয়েত অ্যাওয়ার্ড’ নামে আন্তর্জাতিক কেরাত ও হিফজ প্রতিযোগিতায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন কিশোর হাফেজ মুহাম্মদ জাকারিয়া । এর আগে তিনি ২০১৫ সালের এপ্রিলে মিসরের কায়রোয় আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে ৫০ হাজার পাউন্ড জিতে নেন। একই বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক শহর দুবাইয়ে আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় ৮০টি দেশের প্রতিযোগীকে হারিয়ে তৃতীয় ও সুর ক্যাটাগরিতে প্রথম স্থান লাভ করে। ২০১৭ সালে ১৫ জুন সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক রাজধানী দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় ১০৩টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অধিকার করেন হাফেজ মুহাম্মদ তরিকুল ইসলাম। ২০১৭ সালে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল জিম টিভির কেরাত ও হিফজ রিয়েলিটি শোতে অংশ নিয়ে ২৮টি দেশের প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন কিশোর হাফেজ ইয়াকুব হোসাইন তাজ। এর আগে তিনি সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ৯৬টি দেশকে পেছনে ফেলে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। একই বছর ২০১৭ সালের ১১ অক্টোবরে সৌদি আরবের ‘বাদশা আবদুল আজিজ আল সৌদ আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতা’য় ৭৩টি দেশকে পেছনে ফেলে প্রথম স্থান অর্জন করে হাফেজ আবদুল্লাহ আল মামুন। এর আগে তিনি মিসরের রাজধানী কায়রোয় ৫৫টি দেশের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ২০১৬ সালে দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় এবং ২০১৪ সালের জুলাই মাসে সৌদি আরবের জেদ্দায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। পড়ুন : পুলিশ সদস্যদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন কওমি পড়ুয়া মাওলানা মুজাহিদুল ইসলাম ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর বাহরাইনে শায়েখ জুনায়েদ আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ৫৪টি দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন বাংলাদেশের কিশোর হাফেজ সাইফুর রহমান ত্বকি। একই বছর কুয়েতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কুরআন প্রতিযোগিতায় ৭২টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় হন তিনি। ২০১৮ সালের মার্চে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল জিম টিভির একটি রিয়েলিটি শোতে অংশ নিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেন বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বলকারী আরেকজন হাফেজের নাম আবু রায়হান। অনূর্ধ্ব পনেরো বছর বয়সিদের নিয়ে আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী কুরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জনের পাশাপাশি কেরাত প্রতিযোগিতাতেও তিনি চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর হাফেজ সালেহ আহমাদ তাকরিম সৌদি আরবের পবিত্র মক্কায় অনুষ্ঠিত ‘৪২তম বাদশাহ আব্দুল আজিজ আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতা’য় বিশ্বের ১১১টি দেশের ১৫৩ জন প্রতিযোগীর মধ্যে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। এছাড়া ২০২২ সালের ২২ মে তেহরানের আন্দিশাহ (আল-ফিকির) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ৩৮তম আন্তর্জাতিক হিফজুল কুরআন প্রতিযোগিতায় তাকরিম বিশ্বে প্রথম স্থান অর্জন করে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে উঁচু করে। পড়ুন : ঈদের আগে কি দাওরায়ে হাদিসের ফল প্রকাশ হবে? যা জানালো হাইআতুল উলয়া ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের মক্কায় অনুষ্ঠিত ৪৩তম আন্তর্জাতিক হিফজুল কোরআন প্রতিযোগিতায় হাফেজ ফয়সাল আহমেদ তৃতীয় ও হাফেজ মো. মুশফিকুর রহমান চতুর্থ স্থান লাভ করেন। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরানে অনুষ্ঠিত সর্ববৃহৎ আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করেছে হাফেজ বশির আহমাদ। এছাড়া, এর ১০ দিন আগে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করে হাফেজ বশির। কেন আসছে না বিদেশি হিফজ শিক্ষার্থী গত এক যুগের এই সাফল্যে প্রশ্ন দাঁড়ায় বিশ্বজয়ী হাফেজের দেশ বাংলাদেশে হিফজুল কুরআন পড়তে কেন আসছে না বিদেশি হিফজ শিক্ষার্থী। এ প্রশ্নকে চ্যালেঞ্জ করে বিশ্বজয়ী হাফেজ তাকরিমকে গড়া প্রতিষ্ঠান মারকাযু ফয়জিল কুরআন আল-ইসলামী’র শিক্ষক আন্তর্জাতিক হাফেজ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠান মারকাযু ফয়জিল কুরআনে ভর্তি হবার জন্য যোগাযোগ করে প্রচুর পরিমান অভিভাবক। ‘বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান থেকে আমাদের সঙ্গে প্রচুর যোগাযোগ করে আমাদের প্রতিষ্ঠানে পড়তে। এছাড়া, যাদের বাবা-মা আরব দেশ থেকে ইউরোপে স্থায়ী হয়েছে, এসব বাবা-মাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মিশর, বাহারাইন থেকেও যোগাযোগ করেছে’। – বলেন তিনি। পড়ুন : সমাজের অবহেলিতদের জেনারেল শিক্ষাসহ দ্বীন শেখাচ্ছে ‘দ্বীনিয়াত বধির মাদরাসা’ কেন ভর্তি নিচ্ছেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চাইলে প্রতি বছর ত্রিশ-চল্লিশজন বিদেশি শিক্ষার্থী নিতে পারতাম, কিন্তু আমাদের যে পরিবেশ-পরিসর তা বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য অনুকূলে নয়’। তাছাড়া, বিদেশি শিক্ষার্থীরা যখন বাংলাদেশ এম্বাসিতে যায়, তখন বাংলাদেশ থেকে স্পন্সর কারা করেছে ইত্যাদি ডকুমেন্টস চায়। এতে তৈরী হয় ভিসা জটিলতা’। ‘এ বিশাল প্রসেসের জন্য আমাদের যা যা দরকার তা হাতে নেই আপাতত। এজন্য ভর্তি নিতে পারি না’।– বলেন তিনি। এদিকে, বিদেশি শিক্ষার্থী টানতে সরকারের সহযোগিতা দরকার বলে দাবি করছেন বিশ্বজয়ী হাফেজ গড়ার প্রতিষ্ঠান মারকাজুত তাহফিজ্ ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসার প্রিন্সিপাল হাফেজ ক্বারী নেছার আহমাদ আন-নাছিরী। তিনি বলেন, আমাদের মারকাজুত তাহফিজের পরিবেশ বিশ্বমানের উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়েছে। অনেক বিদেশি হিফজ শিক্ষার্থী পড়তে আসতে চায়। এক্ষেত্রে সরকারের সহযোগিতা হলে সহজ হত। এ নিয়ে সরকারের সাথে বসার আশায় আছেন বলেন জানান তিনি। ‘সরকারের সহযোগিতা থাকলে পুরো পৃথিবীর সব দেশ থেকে বাংলাদেশে হিফজ পড়তে আসবে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি। চলবে...... পড়ুন ২য় পর্ব : বিদেশি হিফজ শিক্ষার্থী টানতে সরকারের করণীয় কী হাআমা/ |