আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সালাত
প্রকাশ:
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ১১:৪৩ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
|| নাজমুল হুদা মজনু || সুমহান আরশের মালিক আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শুধু জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তির হুঁশিয়ারি দিয়ে ক্ষান্ত হননি; পাশাপাশি তাঁর অনুগত-প্রিয় বান্দাদের সুসংবাদও দিয়েছেন। কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, 'মুত্তাকিদেরকে যে জান্নাতের ওয়াদা দেয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত হলো, তাতে রয়েছে নির্মল পানির নহরসমূহ, দুধের ঝরনাধারা, যার স্বাদ পরিবর্তিত হয় না, পানকারীদের জন্য সুস্বাদু সুরার নহরগুলো এবং আছে পরিশোধিত মধুর ঝরনাধারা। সেখানে তাদের জন্য থাকবে সবধরনের ফলমূল আর তাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা। তারা কি তাদের মতো, যারা জাহান্নামে স্থায়ী হবে এবং তাদেরকে ফুটন্ত পানি পান করানো হবে ফলে তা তাদের নাড়িভুঁড়ি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেবে? (সূরা মুহাম্মাদ-১৫) 'সব যুগে মানবজাতির সব প্রজন্মেই এসব অবস্থা ও নমুনার পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে। এখানে দু'ধরনের কর্মফল ঘােষিত হলাে, একটা হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে গুনাহ মাফের পাশাপাশি রকমারি ফলমূল ও রকমারি নহর-সংবলিত জান্নাতপ্রাপ্তি। আর অপরটা হলো, সে ব্যক্তি চিরদিনের জন্যে জাহান্নামি এবং তাকে এমন গরম পানি খাওয়ানো হবে, যা খেয়ে নাড়িভুঁড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। কেননা তারা ভােগবিলাসে মত্ত থাকত ও পশুর মতাে পানাহারে লিপ্ত থাকত। সুতরাং এখানে পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটটা হলাে আল্লাহর সাথে শিরকি ও কুফুরি আর কর্মফলটা হলাে গরম পানি পান করা ও তার ফলে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে যাওয়। কেননা তারা পশুদের মতাে খেয়েদেয়ে এই নাড়িভুঁড়িতেই তা সঞ্চিত রাখত। আর এই দু'ধরনের মানুষের কর্মফল কখনাে একরকম হবে না। কেননা তারা চরিত্রে ও আদর্শেও একরকম নয়।' (তাফসির ফি জিলালিল কুরআন) মু'মিন বান্দাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা নেয়ামতে ভরা জান্নাতের ব্যবস্থা রেখেছেন। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে দল প্রথমে জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের চেহারা পূর্ণিমার রাতের চাঁদের মতো উজ্জ্বল হবে। তারা সেখানে থুথু ফেলবে না, নাক ঝাড়বে না, মলমূত্র ত্যাগ করবে না। সেখানে তাদের পাত্র হবে স্বর্ণের; তাদের চিরুনি হবে স্বর্ণ ও রৌপ্যের, তাদের লোবান পাত্রে থাকবে সুগন্ধি কাঠ। তাদের গায়ের ঘাম মিসকের মতো সুগন্ধময় হবে। তাদের প্রত্যেকের জন্য এমন দু’জন স্ত্রী থাকবে যাদের সৌন্দর্যের কারণে মাংস ভেদ করে পায়ের নলার হাড়ের মজ্জা দেখা যাবে। তাদের মধ্যে কোনো মতভেদ থাকবে না; পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। তাদের সবার অন্তর এক অন্তরের মতো হবে। তারা সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করতে থাকবে। (বুখারি-৩২৪৫) দুনিয়ার জীবনে মু'মিনের জন্য আল্লাহ তায়ালা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছেন। আর এ আমলই মু'মিনের জন্য প্রধান ইবাদত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। হযরত আনাস ইবনে মালিক রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতের ওপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেন। আমি ওই পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত নিয়ে মূসা আ:-এর কাছে ফিরে এলাম। তখন মূসা আ: আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, আপনার প্রতিপালক আপনার উম্মতের ওপর কী ফরজ করেছেন? তখন আমি বললাম, পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছেন। মূসা আ: আমাকে বললেন যে, আপনি আবার আপনার প্রতিপালকের কাছে ফিরে যান। কারণ আপনার উম্মত পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে সক্ষম হবে না। তারপর আমি আমার প্রতিপালকের কাছে উপস্থিত হলাম। আল্লাহ তায়ালা পঞ্চাশ ওয়াক্ত থেকে কিছু কমিয়ে দিলেন। আমি মূসা আ:-এর ফিরে এসে তাঁকে এ বিষয়ে অবহিত করলাম। তিনি বললেন, আপনি আবার হাজির হোন। কেননা আপনার উম্মত তা আদায় করতে সক্ষম হবে না। পরে আমি আবার আমার প্রতিপালকের কাছে উপস্থিত হলাম। তখন আল্লাহ তায়ালা পাঁচ ওয়াক্ত সালাত নির্ধারণ করে বললেন, এটা (গণনার) পাঁচ কিন্তু (প্রতিদানে) এ পাঁচ ওয়াক্ত সালাতই পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাতের সমান এটাই- চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আমার সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয় না। তারপর আমি মূসা আ:-এর কাছে ফিরে যাই। মূসা আ: বললেন, আবার আপনার প্রতিপালকের কাছে উপস্থিত হোন। তখন আমি বললাম, আমি আমার মহান প্রতিপালকের কাছে এ বিষয় নিয়ে আবার উপস্থিত হতে লজ্জাবোধ করছি।' (নাসাঈ-৪৪৯) কুরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন— اِنَّ الصَّلٰوۃَ تَنۡهٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡکَرِ অর্থ: নিশ্চয় সালাত অশ্লীল এবং মন্দ খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। (সূরা আনকাবুত : আয়াত-৪৫) এখানে প্রশ্ন হলো— আমরা তো অনেকেই সালাত পড়ি; কিন্তু আমরা পাপাচার থেকে মুক্ত হতে পারি না কেন? বলতে দ্বিধা নেই যে, আমাদের সালাত রাসূল সা:-এর নির্দেশনা অনুযায়ী হয় না। আমরা সালাত শেষ করার জন্য অস্থির হয়ে যাই। সালাত আমাদের চোখের শীতলতা আনতে পারে না। এর কারণ হলো আমরা সালাতে নিমগ্ন হতে পারি না। মহান প্রতিপালক আল্লাহ তায়ালার দরবারে তার শান-মান অনুযায়ী একাগ্র চিত্তে দাঁড়াতে পারি না। আমাদের মন চলে যায় দোকানে অথবা কারো অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে। দুনিয়াবি হিসাব-নিকাশের মধ্য দিয়ে আমাদের সালাত শেষ হয়। হায় দুর্ভাগা আমরা; ভুলে যাই কার সামনে দাঁড়িয়ে আছি! ঈমান আনার পর প্রধান কর্তব্য হলো সালাত কায়েম করা। কেননা আল্লাহ তায়ালার ফরজ হুকুম অমান্য করলে তাঁর ক্রোধাগ্নিতে পড়তে হবে। এমনকি জীবন সায়াহ্নে আল্লাহর সৈনিক ফেরেশতারা কী আচরণ করবে তা কুরআনুল কারিমের সূরা মুহাম্মাদে ভীতিপ্রদ ভাষায় এভাবে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে— 'ফেরেশতারা যখন তাদের মুখমণ্ডল ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে, তখন তাদের অবস্থা কেমন হবে?' ( সূরা মুহাম্মাদ আয়াত ২৭) এই আয়াতে যে দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে তা একই সাথে ভয়ঙ্কর এবং লজ্জাকরও। কারণ মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর অবস্থায় যখন তাদের কোনােই শক্তি সামর্থ্য থাকবে না সেই অসহায় অবস্থায় তারা এই পার্থিব জীবনের চৌহদ্দী পেরিয়ে পরকালীন জীবনে পা রাখতেই তাদেরকে এক করুণ ও বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। তখন ফেরেশতারা তাদের মুখে আঘাত করতে থাকবে, তাদের পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে থাকবে। এক দিকে মৃত্যুর কঠিন, কষ্টকর ও ভয়ঙ্কর মুহূর্ত, অপর দিকে পশ্চাৎদেশে আঘাতের পর আঘাত। কী করুণ পরিণতি। কেন এই পরিণতির শিকার হতে হলাে তাদেরকে, তার কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে পরবর্তী আয়াতে বলা হয়েছে, 'এটা এ জন্য যে, তারা সে বিষয়ের অনুসরণ করে, যা আল্লাহর অসন্তোষ সৃষ্টি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অপছন্দ করে। ফলে তিনি তাদের কর্মগুলো ব্যর্থ করে দেন।' (আয়াত ২৮) অর্থাৎ তারা নিজেরাই এই অশুভ পরিণতিকে নিজেদের জন্য বেছে নিয়েছে এবং পছন্দ করেছে। তবে আল্লাহ তায়ালার আজাব ও গজব থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে ধৈর্য ও সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য তালাশ করতে হবে। রহমান রহিম আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করতে হলে ফরজ সালাতের পাশাপাশি নফল এবাদত করলে ফরজের ঘাটতি তিনি নিজ দয়ায় পূরণ করে দেন। তাই তো মহান আল্লাহর দরবারে ধরনা দিতে হবে। নীরবে নিভৃতে তাঁর দয়া ভিক্ষা করতে হবে। নির্জন-নিরালায় মহান প্রতিপালকের দরবারে সিজদায় লুটিয়ে পড়তে হবে। এ প্রসঙ্গে একটি হাদিস রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, ফরজ সালাতের পর কোন সালাত সর্বোত্তম? তিনি বললেন, 'ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হলো, রাতে উঠে সালাত আদায় করা।' (মুসলিম ১১৬৩) লেখক : গবেষক ও সাংবাদিক এনএ/ |