ট্রান্সজেন্ডার বনাম ইসলাম
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ০৭:০৭ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

|| মুফতি মোহাম্মাদ জাকারিয়া ||

ইদানীং বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে ‘ট্রান্সজেন্ডার’ মানুষ নিয়ে আলোচনা দেখা যায়; যাদের বেশির ভাগ তৃতীয় লিঙ্গের মনে করলেও মূলত তারা এমনটি নয়। কারন ট্রান্সজেন্ডার হল সেসব ব্যক্তি যাদের মানসিক লিঙ্গবোধ জন্মগত লিঙ্গ চিহ্ন হতে ভিন্ন। রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তিবর্গ যদি তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে ডাক্তারি সাহায্য নেয় তবে তাদেরকে অনেকসময় রূপান্তরকামী নামে ডাকা হয়। 'এছাড়াও রূপান্তরিত লিঙ্গ একটি শ্রেণিগত পরিভাষা; যাতে এমন ব্যক্তিদেরও যোগ করা হয় যাদের মানসিক লিঙ্গবোধ তাদের জন্মগত লিঙ্গচিহ্ন’র বিপরীত। সুত্র: উইকিপিডিয়া

যুক্তরাষ্ট্রের জনসাস্থ্য প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) ট্রান্সজেন্ডারের  সংজ্ঞায় বলছে যাদের সামাজিক লৈঙ্গিক পরিচয় থেকে জন্মগত যৌন পরিচয় আলাদা এমন মানুষরা ট্রানজেণ্ডার হিসেবে পরিচিত। সূত্র: আজকের পত্রিকা (২৫ জানুয়ারি ২০ ২৪)

আদিকাল থেকে পৃথিবীজুড়ে তিন ধরনের মানুষের বসবাস। নারী,পুরুষ ও হিজড়া। সবাই আল্লহর সৃষ্টি। আল্লাহ যাকে যেভাবে উত্তম মনে করেছেন তাকে সেভাবে সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ তা’য়ালা কোরআনে কারীমে ইরশাদ করেন, আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে। (সুরা:ত্বীন আয়াত:৪)

পৃথিবী ব্যাপী ‘ট্রান্সজেন্ডার’ নামে নতুন যে লিঙ্গের মানুষের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। যদিও তারা নিজেদেরকে ভিন্ন লিঙ্গ তথা ‘ট্রান্সজেন্ডার’ নামে পরিচয় দিচ্ছে কিন্তু কোরআনের ভাষায় মূলত তারা শয়তানের কাজ করে নিজেদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কোরআনে কারীমে আল্লাহ বলেন ‘আর অবশ্যই তাদেরকে নির্দেশ দেব ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবে আর আল্লাহর পরিবর্তে কেউ শয়তানকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করলে সে স্পষ্টত ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ (সুরা:নিসা আয়াত:১১৯)

ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি রাসুলের অভিশাপ:

পুরুষ কখনো নারীর বেশ ধারণ করলে বা নারী কখনো পুরুষের বেশ ধারণ করলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয়ের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন। হাদিসের মধ্যে ইরশাদ হচ্ছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষ হিজড়াদের ওপর এবং পুরুষের বেশধারী মহিলাদের ওপর লানত করেছেন। তিনি বলেছেন, ওদেরকে ঘর থেকে বের করে দাও। ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অমুককে বের করেছেন এবং ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু অমুককে বের করে দিয়েছেন। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৫৮৮৬)

মৃত্যুর পরে ট্রান্সজেণ্ডারের শাস্তি:

'ট্রান্সজেন্ডার' ব্যাক্তি সম্পর্কে হাদিসের ভাষায়  কঠোরভাবে বলা হচ্ছে যে,সে জান্নাতে যেতে পারবে না।

আম্মার ইবনে ইয়াসার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন 'তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে যেতে পারবে না-

(১) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান।

(২) বাড়ীতে বেহায়াপনার সুযোগ প্রদানকারী।

(৩) পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী'(নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষ

সহীহ তারগীব:২০৭১

 

ট্রান্সজেন্ডারের জন্য শরয়ী পদক্ষেপ:

আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতঃ

কোন একদিন এক হিজড়াকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট আনা হলো। তার হাত-পা মেহেদী দ্বারা রাঙ্গানো ছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এর এ অবস্থা কেনো? বলা হলো, হে আল্লাহ্‌র রাসুল! সে নারীর বেশ ধরেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে আন-নকী নামক স্থানে নির্বাসন দেয়ার  নির্দেশ দিলেন। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কি তাকে হত্যা করবো না? তিনি বললেন, সলাত আদায়কারীদের হত্যা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। আবু উসামাহ বলেন, আন-নাফী হলো মাদীনাহ্‌ এর প্রান্তবর্তী একটি জনপদ, এটা বাকী’ নয়। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৪৯২৮)

উক্ত হাদিসে রাসুল সা. হিজড়ার ব্যাপারে এত কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন তাহলে ভাবা উচিৎ যারা পুরুষ হয়েও নারীর বা নারী হয়েও পুরুষের বেশ ধরে  তাদের ব্যাপারে শরয়ী অবস্থান কেমন!

ট্রান্সজেন্ডার যেহেতু মানসিক রোগ থেকে হয়, তাই তাদের লিঙ্গে অস্ত্রোপচার না করে তাদের মানসিক চিকিৎসায় জোর দেওয়া উচিত, তাদের সমস্যাগুলো যদি হরমোনগত সমস্যা থেকে হয়, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃতির অধিকার কারো নেই। হ্যাঁ, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক কন্যাশিশুর জন্মের সময় যোনিপথ বন্ধ থাকে, যা অপারেশনের মাধ্যমে ঠিক করা সম্ভব, সে চিকিৎসা গ্রহণকে ইসলাম নিষিদ্ধ বলে না। এবং পরিভাষায় সেই অস্ত্রোপচারকে ট্রান্সজেন্ডারও বলে না। উপরন্তু যেসব নারী পুরুষের বেশভূষা নিতে চায়, যেসব পুরুষ নারীর বেশভূষা নিতে চায়, মহানবী সা. তাদের অভিসম্পাত করেছেন।

দেশে ট্রান্সজেন্ডার সামাজিকীকরণে হবে ভয়াবহ বিপর্যয় :

ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে অনেকের কাছে মনে হতে পারে, এতে সমস্যা কী, সবাই তো আর এক রকম হয় না। ওদের সংখ্যাই বা আর কত। তারা তো আমাদের কোনো সমস্যা করছে না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পশ্চিমা দেশগুলোতে এই মতাদর্শ পলিসি বাস্তবায়নের ফলে বিভিন্ন সামাজিক, স্বাস্থ্য এবং আইনগত সমস্যা গত কয়েক বছরে অনুধাবন করা যাচ্ছে। এটি হাজার হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গভিত্তিক সিস্টেমকে ওলট-পালট করে দিচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নানা বিতর্ক। এ মতবাদ সমাজের ভারসাম্যতা ও স্বাভাবিক রীতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিচ্ছে। উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে তৈরি হচ্ছে মারাত্মক সামাজিক বিশৃঙ্খলা। সঙ্গে সঙ্গে জেনা-ব্যভিচারের রাস্তাও আরো সুগম আরো সহজ হয়ে যাবে। কারণ ট্রান্সজেন্ডার মেয়েদের যদি মহিলা বিশেষায়িত স্থান তথা মহিলা হোস্টেল ইত্যাদিতে প্রবেশের অবাধ অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে তা হবে সুকৌশলে ব্যভিচারের পথকে আরো সহজ করে দেওয়া। কারণ আমরা আগেও উল্লেখ করেছি, অস্ত্রোপচার বা অন্য কোনো মাধ্যমে শরীরের কিছু পরিবর্তন আসলেও তাদের সৃষ্টিগত লিঙ্গের কোনো পরিবর্তন হয় না। সুতরাং এভাবে একজন ট্রান্সজেন্ডার মেয়েকে (যে কি না বাস্তবে একজন পুরুষ) মহিলা বিশেষায়িত স্থানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া তার জন্য ধর্ষণের পথ খুলে দেওয়া নয় কি?

পশ্চিমা দেশগুলোতে এই মতাদর্শ পলিসি বাস্তবায়নের ফলে বিভিন্ন সামাজিক, স্বাস্থ্য এবং আইনগত সমস্যা গত কয়েক বছরে অনুধাবন করা যাচ্ছে। এটি হাজার হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গভিত্তিক সিস্টেমকে ওলোট-পালট করে দিচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নানা বিতর্ক। এক যুগ কম সময়ের মধ্যেই শিশু-কিশোরদের মাঝে ট্রান্সজেন্ডার আইডেন্টিটি নেওয়ার হার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। আমেরিকায় ২০১০ তুলনায় জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া (যারা নিজেদের ভুল দেহে আটকা পড়েছে বলে মনে করে) ইস্যুতে ক্লিনিকে চিকিৎসা নিতে আসা শিশু-কিশোরদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫০০০%, ইংল্যান্ডের ছেলেদের মধ্যে বেড়েছে ১৪৬০%, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে তা হয়েছে ৫৩৩৭%। সুইডেনে বেড়েছে ১৪০০% এবং ডেনমার্কে বেড়েছে ৬৭,০০০%। (কালবেলা: ২৬ নভেম্বর ২০২৩)

ট্রান্স বিষয়ে  অমুসলিম বিশেষজ্ঞদের অবস্থান :

সম্প্রতি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে মন্তব্য- ‘কেউ চাইলেও লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে না’ অথবা ‘পুরুষ পুরুষই, নারী নারীই’-

বিশ্বের বিখ্যাত টেক বিলিনিয়ার ইলন মাস্ক ট্রান্সজেন্ডার মতাদর্শের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন। এই বিষয়ে তিনি মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট দিয়ে পিতামাতাকে সচেতন রাখেন। এই বিষয়টির ভয়াবহতা অনুধাবন করাতে সম্প্রতি তিনি একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি (what is a woman) শেয়ার করেন। এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বের ১৭০ মিলিয়ন মানুষ ভিডিওটি দেখেছে। (কালবেলা : ১৫ নভেম্বর ২০২৩)।

মহান আল্লাহ সবাইকে এই ঘৃণ্য কাজ থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া ইসলামিয়া হোসেনিয়া বরিশাল

কেএল/