আখেরি জমানার সংস্কার আন্দোলন
প্রকাশ:
০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ০৪:২৪ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
|| মাওলানা লিয়াকত আলী || মরু আরবের এক প্রান্তর থেকে উঠেছিল তাওহিদের আহ্বান। পৌত্তলিকতার আঁধারে নিমজ্জিত মানুষেরা এই নতুন আহ্বানে সাড়া দিতে প্রস্তুত ছিল না। কেননা ভোগবাদ ও দুনিয়াবি মোহে আচ্ছন্ন থাকার কারণে তাদের সত্যবাণীর মর্ম অনুধাবনের শক্তি যেন লোপ পেয়েছিল। অথচ একই বাণীই তো প্রচার করে গেছেন আম্বিয়ায়ে কেরামের নুরানি কাফেলা। প্রত্যেকই মানুষকে অলীক অসার প্রভুর ধারণা পরিহার করে এক অদ্বিতীয় মহান প্রতিপালকের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন ও তার বিধানসমূহ অনুসরণের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের দীক্ষা দিয়েছেন। পার্থিব জীবনের স্বরূপ ও উদ্দেশ্য পরকালীন স্থায়ী জীবনের জন্য পাথেয় সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা এবং মহান স্রষ্টার প্রতি সমর্পিত হওয়ার অপরিহার্য বুঝিয়ে দেওয়াই তাদের চিরন্তন কর্মসূচি। আখেরি জামানায় এসেছেন সাইয়েদুল মুরসালিন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা.। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তিনি মানব জাতিকে উপহার দিয়েছেন চূড়ান্ত জীবন বিধান। পার্থিব ও পারিত্রিক উভয় জগতের সার্থকতা ও মুক্তির গ্যারান্টি জীবনের প্রথম চল্লিশটি বছর যিনি সমকালীন সমাজ ও প্রতিবেশে বিশ্বস্ততা ও নির্ভরযোগ্যতার অনুপম প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিলেন, প্রচলিত প্রথা ও রীতির বিপরীতে নতুন বক্তব্য উচ্চারণের কারণে তিনি নিছক বিরোধ ও সমালোচনা নয়, তিরস্কার, নিন্দা পর্যন্তও সীমিত থাকেনি। বরং নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারে তাঁর জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। আল্লাহর নির্দেশে জন্মভূমি ছেড়ে তিনি ইসলামের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেন সুদূরের ইয়াছরিব পল্লীকে। নানা বিশ্বাস ও ঐতিহ্যের ধারক বিচিত্র জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও কল্যাণময় রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার নমুনা পেশ করলেন। বিশ্ববাসী লাভ করল ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান। ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে ইসলামের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রইল। মাত্র এক দশকে গোটা আরব উপদ্বীপের একমাত্র ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো ইসলাম। তারপর মুসলিম উম্মাহকে পরিচালনার দায়িত্ব অর্পিত হলো খোলাফায়ে রাশেদিনের ওপর। মাত্র দু’দশকে সমকালীন দু পরাশক্তির ক্ষমতা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেল মুসলমানদের হাতে। খেজুর পাতার আসনে বসে অর্ধ জাহানের শাসন চালাতে লাগলেন মহানবী সা. -এর প্রশিক্ষিত ও দীক্ষিত ঘনিষ্ঠ সহচরেরা। এরপর এক পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন পরিচালনায় কিছুটা ছন্দপতন হলো। তথাপি ইসলামের প্রসার ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রইল। অনুপম আদর্শ ও সোনালি নির্দেশনার আকর্ষণে পৃথিবীবাসী শান্তির পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। আজ পর্যন্ত তাতে কখনোই বিরতি ঘটেনি। আজ পৃথিবীতে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মানুসারী গোষ্ঠীর নাম মুসলিম। সাড়ে ছয়শ কোটি বনি আদমের মধ্যে মুসলিম পরিচয়ের মানুষ একশ সাতান্ন কোটি। যে গতিতে ও হারে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে অচিরেই এ জনগোষ্ঠী উঠে আসবে প্রথম স্থানে। প্রতিকার মুসলিম উম্মাহর ভেতর থেকেই আসতে হবে। এটাই তাবলিগ কার্যক্রম। হজরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলবী রহ. এ ব্যবস্থাই চালু করে গেছেন। মুসলমানদের অভ্যন্তরীণ শক্তি যদি দূর না হয়, যে ঐকান্তিক বিশ্বাস ও নিষ্ঠা মুসলমানদের স্বাতন্ত্রের দলিল, যে শক্তির কাছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলো পরিচিত হয়েছিল, যদি তা-ই আবার জাগ্রত হন, তাহলেই মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ। দীনি চেতনা, দীন পালনের অপরিহার্যতার অনুভূতি, আকায়েদ ও ইবাদতে নিষ্ঠার পাশাপাশি ইলম চর্চা ও খোদায়ি স্মরণে মগ্নতা, মুসলমানদের পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহযোগিতা এবং উদ্দেশ্যের শুদ্ধতা চর্চায় মুসলমানরা যদি আবার প্রথম যুগের মানুষদের অনুসরণ করে তাহলে আখেরি নবীর উম্মত যেমন পৃথিবীর জীবনে সার্থকতা খুঁজে পাবে। তেমনি অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর কাছে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হয়ে যাবে। কার্যকর উপায়ে অবাচনিক পদ্ধতিতে। এসব গুণের চর্চা শুধু তাত্ত্বিক পর্যায়ে থাকলে সুফল হবে সীমিত পর্যায়ে। বরং বাস্তব জীবনে পালন ও অবলম্বনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে নজরদারি ও দীক্ষার মাধ্যমে। আপন কর্মক্ষেত্র ও পারিবারিক গণ্ডি থেকে কিছুকালের জন্য নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে একাগ্রতা ও একনিবিষ্টতার অনুশীলন করতে হবে নাতিদীর্ঘ কাল ধরে। হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা উম্মতে মুহাম্মদীকে পরিচিত করেছেন আখেরি জামানার জন্য সবচেয়ে উপযোগী এই সাংস্কারিক কার্যক্রমের সাথে। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও পরিচয় গৌণ রেখে নিছক ঈমান ও ইবাদতের প্রতি আগ্রহী করে তোলার সুফল ব্যাপক হতে বাধ্য। বৈষয়িক জীবনের শুদ্ধতা আসবে অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে। শেষ যুগে ইসলামের জাগরণে এই নীরব অথচ ফলপ্রসূ কর্মসূচির ফলেই এখানো দীনের নির্ভেজাল প্রকৃতির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। সচেতন সব মহল তাবলিগ কার্যক্রমের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন রাখছে এজন্যই। ইসলামের সেবা ও প্রচার-প্রসারের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই যতই এ কার্যক্রমের প্রতি একাত্ম হবেন, উম্মতের ততই মঙ্গল হবে ইনশাআল্লাহ। লেখক : মুহাদ্দিস, সাংবাদিক ও লেখক কেএল/ |