তাবলিগ জামাত : দারুল উলুম দেওবন্দের অবদান
প্রকাশ:
০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ০৪:০০ দুপুর
নিউজ ডেস্ক |
|| মুনীরুল ইসলাম || ইসলাম আল্লাহর মনোনীত জীবনব্যবস্থা। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পৃথিবীতে অসংখ্য নবী ও রাসুল পাঠিয়েছেন। যেহেতু আমাদের প্রিয় রাসুল হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ রাসুল, তাঁর পরে আর কোনো নবী বা রাসুল আসবেন না, তাই তিনি বিদায় হজের ভাষণে ইসলামের দাওয়াত প্রদানের দায়িত্বটি উম্মতে মুহাম্মদিয়ার কাছে অর্পণ করে যান। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানুষের (কল্যাণের) জন্য তোমাদের বের করা হয়েছে। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করবে।’ (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ১১০)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘তার চেয়ে ভালো কথা আর কী হতে পারে, যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে যে, আমি মুসলমানদের একজন।’ (সুরা হা মীম সিজদা : আয়াত ৩৩)। নবীজি বলেছেন, ‘আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী হলেও তা মানুষের কাছে পৌঁছে দাও।’ (বুখারি : হাদিস ৩২৭৪) কুরআন ও হাদিসের এই দাওয়াতি আহ্বানকে কেন্দ্র করেই পর্যায়ক্রমে বিশ্বব্যাপী দাওয়াত ও তাবলিগের প্রচার-প্রসার ঘটে। বর্তমান দুনিয়ার সবচেয়ে কার্যকরী, সফল এবং আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য কাফেলার নাম তাবলিগ জামাত। এই জামাতের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা শুধু আল্লাহ তায়ালাকে রাজি-খুশি করার জন্য নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে দীনের দিকে আহ্বান করে। আজ সারা দুনিয়ায় এই জামাতের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এই আল্লাহকবুল জামাতও দারুল উলুম দেওবন্দেরই অবদান। গণমানুষের মাঝে দীন চর্চা ছড়িয়ে দিতে দেওবন্দ থেকেই উত্থিত হয় দাওয়াত ও তাবলিগ জামাত। দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্র বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও সাধক মাওলানা আখতার ইলিয়াস কান্দলবি রহ. তাবলিগ জামাতের সূচনা করেন। শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি রহ.-এর কাছে হাদিস পড়ার জন্য ১৩২৬ হিজরিতে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন এবং শায়খুল হিন্দ রহ.-এর কাছে বুখারি ও তিরমিজি পড়েন। ১৫ মুহাররম ১২৮৩ হিজরি মোতাবেক ৩০ মে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেওবন্দের ছোট্ট পল্লিতে ছাত্তা মসজিদের আঙিনায় একটি ডালিম গাছের ছায়ায় আবে হায়াতের এই নহর রচিত হয়। মূলত দুজন বুজুর্গের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। একজন শিক্ষক; মাওলানা মোল্লা মাহমুদ। অপরজন ছাত্র; দেওবন্দের নওজোয়ান মাহমুদ হাসান। যিনি পরবর্তী সময়ে ‘শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান’ নামে খ্যাত হন এবং ‘ইংরেজ খেদাও’ আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। লর্ড ম্যাকল কর্তৃক ইসলামকে মিটিয়ে দেওয়ার হীন ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দীনকে অক্ষুণ্ন রাখা ছিল দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার অন্যতম মৌলিক উদ্দেশ্য। এরই সঙ্গে উলামায়ে কেরামের এক জানবাজ জামাত তৈরি করাও ছিল সময়ের দাবি, যারা যেকোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর দীনকে হেফাজত করার প্রচেষ্টা চালাবেন এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেবেন। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে তালিম-তারবিয়াত, তাজকিয়া-তাসাউফ, দাওয়াত-সিয়াসত সহ প্রতিটি অঙ্গনের জন্য সে তৈরি করে আসছে যুগের খ্যাতনামা মনীষীদের। বিগত শতাব্দীতে বিশ্ববাসীর ওপর উলামায়ে দেওবন্দের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। আল্লামা মুফতি তাকি উসমানি এবং মাওলানা তারিক জামিল-এর মতো ব্যক্তিরা পৃথিবী ভ্রমণ করে বলেছেন, উলামায়ে দেওবন্দের মতো দ্বিতীয় আরেকটি জামাত বিশ্বের বুকে নেই। যারা যখন যেভাবে ইসলাম ও দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র করেছে, উলামায়ে দেওবন্দ তখনই সেভাবে এর মোকাবেলা করেছেন। বাতিল সম্প্রদায়ের ভয়ে উলামায়ে দেওবন্দ কখনো পালিয়ে যাননি। এক শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান রহ.-এর মোকাবেলায় ব্রিটিশ গোষ্ঠী অসহায় হয়ে পড়েছিল। অর্জিত হয়েছিল স্বাধীনতা। সাইয়েদ হোসাইন আহমদ মাদানি রহ.-এর দূরদর্শী সিদ্ধান্ত উপহার দিয়েছিল পাকিস্তান। হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবি রহ.-এর সহস্রাধিক কিতাব জাতিকে দেখিয়েছিল নতুন দিগন্ত। হজরতজি আখতার ইলিয়াস রহ. পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন রাসুলের সুন্নাত। ইউসুফ বানুরি রহ. ‘আকিদায়ে খতমে নবুওয়াত’ কনফারেন্সে ইশা থেকে ফজর পর্যন্ত বক্তব্য রেখেছিলেন। কোর্টের ভেতরে বিচারপতির সামনে কাদিয়ানিদের অমুসলিম প্রমাণ করেছিলেন। আমিন সফদর রহ. বিতার্কিকের ভূমিকায় বাতিল গোষ্ঠীকে চুপসে দিয়েছিলেন। আর দারুল উলুম দেওবন্দের রীতি-বৈশিষ্ট্যের ওপর ভারতবর্ষ ও ইউরোপ আমেরিকায় তো আজ শত সহস্র দীনি প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছেই। (সূত্র : দারুল উলুম দেওবন্দ আওর উসকি মেজায) হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি রহ. একসময় হজরতজি ইলিয়াস রহ.-কে লক্ষ করে বলেছিলেন, ‘আল্লাহ আপনাকে দিয়ে দীনের বড় কোনো খেদমত নেবেন।’ সেই ইশারার আলোকেই হয়তো উপমহাদেশের মুসলমানদের এক ক্রান্তিলগ্নে তাবলিগ জামাতের শুভ সূচনা হয়। হজরতজি মাওলানা আখতার ইলিয়াস রহ. (১৮৮৫-১৯৪৪ খ্রি.) ভারতের ‘মেওয়াত’ অঞ্চল থেকে ১৯২৬ সালে তাবলিগ জামাতের সূচনা করেন। এটি দিল্লির দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটি ছিল ‘মেও’ জনগোষ্ঠীর আবাসভূমি। বর্তমানে গোরগাঁও, আলাওয়ার, ভরতপুর ও মথুরার কিছু অংশ নিয়ে মেওয়াত এলাকা বিস্তৃত। এই অঞ্চলের জনগণ ছিল নামেমাত্র মুসলমান। তাদের আচার-আচরণ ছিল বহুক্ষেত্রে আরব জাহেলিয়াতের কাছাকাছি। আর্যদের এ দেশে আগমনের বহু পূর্ব থেকে মেও গোষ্ঠীরা এই এলাকায় বসবাস করতো। দিল্লির মুসলিম সালতানাতের যুগে মেওয়াতিরা বনজঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে লুটপাট করতো। ১২৬০ সালে গিয়াসুদ্দিন বলবন মেওয়াতি দস্যুদের শায়েস্তা করার জন্য একটি বড় অভিযান পরিচালনা করেন। এমন একটি এলাকা থেকেই তাবলিগ জামাতের বিস্ময়কর সূচনা হয়েছিল। ১৩৪৫ হিজরিতে দ্বিতীয় হজ থেকে ফিরে এসে তিনি তাবলিগি গাশত শুরু করেন। জনসাধারণের মধ্যে কালেমা ও নামাজের দাওয়াত দেন। জামাতবদ্ধ করে বিভিন্ন এলাকায় বের হওয়ার দাওয়াত দেন। এভাবে গ্রামে গ্রামে সৎ কাজ করার জন্য জামাত তৈরি করে দেন। কয়েক বছর মেওয়াতে এ পদ্ধতিতে দাওয়াতি কাজ অব্যাহত থাকে। ১৩৫২ হিজরিতে তৃতীয় হজ পালনের পর তিনি উপলব্ধি করলেন, গরিব মেওয়াতি কৃষকদের পক্ষে দীন শেখার সময় পাওয়া কষ্টকর। ঘর-সংসার ছেড়ে মাদরাসায় দীন শেখাও অসম্ভব। তাই ছোট ছোট জামাত আকারে ইলমি ও দীনি প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে সময় কাটানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করেন এবং ধর্মীয় পরিবেশে তালিম দিতে থাকেন। সেসব ধর্মীয় মজলিসে উলামা-মাশায়েখের ওয়াজ-নসিহতের পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন জীবনের নিয়মনীতি বাতলে দেওয়া হতো। মানুষ দীনদার-পরহেজগার লোকদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ধীরে ধীরে এই জামাতের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। হজরতজি ইলিয়াস রহ.-এর ইন্তেকালের পর আমির নিযুক্ত হন তারই সুযোগ্য সন্তান মাওলানা ইউসুফ কান্দলবি রহ.। তিনি উত্তরাধিকারে লব্ধ কার্যক্রমকে বেগবান করার লক্ষ্যে গোটা জীবনকে কুরবান করেন। হজরতজি ইউসুফ রহ.-এর ইন্তেকালের পর আমির নিযুক্ত হন মাওলানা এনামুল হাসান রহ.। এরপর আর কাউকে একক আমির নিযুক্ত করা হয়নি। বরং হজরতজি এনামুল হাসান রহ.-এর জীবদ্দশায়ই আলমি শুরা বা আন্তর্জাতিক পরিচালনা পরিষদ গঠন করা হয়। তখন থেকে আলমি শুরার সদস্যরাই তাবলিগ জামাত পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু ২০১৪ সালে শুরার কনিষ্ঠ সদস্য মাওলানা মুহাম্মদ সাদ নিজেকে আমির দাবি করলেই বিশ্বজনীন এই জামাতে বিভক্তি তৈরি হয়। তাবলিগ জামাতের দ্বিতীয় আমির মাওলানা ইউসুফ কান্দলবি রহ.-এর যুগে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে এ দাওয়াতি মিশন সবচেয়ে বেশি ও শক্তিশালী ছিল। তখনই অঞ্চলভিত্তিক ইজতেমার আয়োজন শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে প্রথমে উপমহাদেশজুড়ে তাবলিগি দাওয়াতের কাজ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সারাবিশ্বে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। প্রথম ইজতেমা ১৯৪১ সালে দিল্লির নিজামউদ্দিন মসজিদের ছোট এলাকা মেওয়াতের নুহ মাদরাসায় আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশে ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের প্রথম ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরের বিশাল ময়দানে ইজতেমা শুরু করা হয়। লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামি লেখক ফোরাম কেএল/ |