ইসরায়েলের অস্ত্র দিয়েই ইহুদিবাদী সেনাদের কাবু করছে হামাস
প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারী, ২০২৪, ১১:২১ দুপুর
নিউজ ডেস্ক

গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় নির্বিচারে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। দীর্ঘ ১১৫ দিনের এই যুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পুরো উপত্যকা। ইসরায়েলি বাহিনী বর্বর হামলা নিহত হয়েছে ২৬ হাজার ৪২২ ফিলিস্তিন। এর অধিকাংশই নারী ও শিশু। আহত হয়েছে আরও ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।

যুদ্ধে ইসরায়েলের লক্ষ্য- গাজার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাসকে নির্মূল করা ও তাদের হাতে আটক জিম্মিদের উদ্ধার করা। নির্বিচারে হামলা চালিয়েও দীর্ঘ প্রায় চার মাসে সেই লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হয়নি ইসরায়েল। ইসরায়েলি মন্ত্রীদের কেউ কেউ এখন বলছেন, হামাসকে ধ্বংস বা নির্মূল করতে এক প্রজন্ম লেগে যেতে পারে।

এছাড়াও মার্কিন প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ১১৪ দিন যুদ্ধ করে হামাসের মাত্র ২০ শতাংশ টানেল ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এখনও ৮০ শতাংশ টানেল অক্ষতই রয়ে গেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গাজার টানেলগুলো শনাক্ত করতে কুকুর ও রোবট দিয়ে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাচ্ছে ইসরায়েল। এসব টানেল ধ্বংসে নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এসব প্রচেষ্টার মধ্যে রয়েছে- ভূমধ্যসাগর থেকে পানি তুলে টানেলগুলো প্লাবিত করার জন্য পাম্প স্থাপন, বিমান হামলা এবং তরল বিস্ফোরক দিয়ে সেগুলো ধ্বংস করা। এসব করতে উচ্চ প্রশিক্ষিত সৈন্যদের দিয়ে অভিযান চালানোসহ টানেলগুলো পরিষ্কার করার জন্য ইসরায়েল বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। কিন্তু দীর্ঘ ১১৪ দিনেও খুব সামান্য টানেলই ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এখনও ৮০ শতাংশ অক্ষত রয়েছে গাজায়।

হামাসকে নির্মূল করা তো দূরের কথা, তাদের প্রতিরোধের কাছে রীতিমতো ধরাশায়ী ইসরায়েলি বাহিনী। সম্প্রতি একদিনে একটি ঘটনাতেই ২৪ ইসরায়েলি সেনাকে হত্যা করে নিজেদের সক্ষমতার আরও জানান দিয়েছে হামাস যোদ্ধারা।

কিন্তু গাজা দীর্ঘ ১৭ বছর অবরুদ্ধ থাকার পরও কীভাবে ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অস্ত্র পাচ্ছে হামাস তা নিয়েও চিন্তায় পড়েছে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ।

তবে এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন আরেক প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের অস্ত্র দিয়েই ইহুদিবাদী সেনাদের কাবু করছে হামাস।

এতে আরও বলা হয়, গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা ও পরে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হামাস যেসব অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পাচ্ছে অস্বাভাবিক উৎস থেকে। ইসরায়েলের সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতে, সেই উৎস হল ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী।

সামরিক বিশ্লেষকেরা বহু বছর ধরে বলে আসছেন যে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর অবরোধের মধ্যেও হামাসের কাছে এত ভারী অস্ত্র থাকার কারণ হল, গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে তৈরি করা পথে চোরাচালানের মাধ্যমে এসব অস্ত্র তাদের হাতে আসে। কিন্ত অস্ত্রবিশেষজ্ঞ এবং ইসরায়েল ও পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দাদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী সাম্প্রতিক গোয়েন্দা তথ্যে উঠে এসেছে, গাজায় ইসরায়েলের ফেলা অবিস্ফোরিত হাজার হাজার গোলাবারুদ দিয়ে নিজেদের জন্য রকেট ও ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা তৈরি হয়েছে হামাসের। এছাড়া ৭ অক্টোবর হামলার সময় ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি থেকে লুট করা অস্ত্রও ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে হামাস যোদ্ধারা।

গত কয়েক মাসের যুদ্ধের সময়ে সংগৃহীত গোয়েন্দা তথ্যে উঠে এসেছে, হামাসের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ৭ অক্টোবরের আগে যেভাবে ভুল মূল্যায়ন করেছে, ঠিক তেমনি তাদের সামরিক সক্ষমতার বিষয়টিকেও ছোট করে দেখেছে ইসরায়েল।

এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বিগত ১৭ বছরের গাজা অবরোধের কবলে থাকলেও সেখানে ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনী যেসব অস্ত্র ব্যবহার করেছে, এখন সেগুলোই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইসরায়েল ও আমেরিকার বিস্ফোরকই ইসরায়েলে বৃষ্টির মতো রকেট ছোড়া এবং প্রথমবারের মতো গাজা থেকে ইসরায়েলি একটি শহরে ঢুকে হামাসকে হামলা চালানোর সামর্থ্য তৈরি করে দিয়েছে।

৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। সীমানাবেড়া ভেঙে হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে ঢোকার কয়েক ঘণ্টা পর রেইম সামরিক ঘাঁটির বাইরে সশস্ত্র এক হামাস যোদ্ধার মরদেহ দেখতে পান ইসরায়েলি সেনারা। তার শরীরে বাঁধা ছিল একটি গ্রেনেড। ওই ইসরায়েলি সেনাদের একজন বলেন, গ্রেনেডে হিব্রু ভাষায় লেখাগুলো স্পষ্ট দেখা গেছে। তিনি চিনতে পারেন, সেটি ইসরায়েলের তৈরি নতুন মডেলের বুলেটপ্রুফ গ্রেনেড।

সেদিন ইসরায়েলে পাঁচ হাজার রকেট ছুড়েছিল হামাস। ওই সামরিক ঘাঁটির কয়েক মাইল দূর থেকে একটি রকেট উদ্ধার করে ইসরায়েলের একটি ফরেনসিক দল। ইসরায়েলের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ফরেনসিক দল পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখে, রকেটে যে বিস্ফোরক ছিল, সে ধরনের বিস্ফোরকের ব্যবহার শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীতেই দেখা যায়। যেটি খুব সম্ভবত এর আগের গাজা যুদ্ধে ছোড়া অবিস্ফোরিত ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি করা হয়েছে।

ইসরায়েলি পুলিশের বোমা নিষ্ক্রীয়করণ বিভাগের সাবেক উপপ্রধান মিখাইল কারদাশ বলেন, হামাসের হাতে থাকা বিস্ফোরকের প্রধান উৎস হল- অবিস্ফোরিত সমরাস্ত্র। তারা ইসরায়েলের ছোড়া বোমা ও কামানের গোলা কাটছে। সেগুলোর বেশির ভাগই এখন ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে। তারা এগুলো এখন বিস্ফোরক ও রকেট তৈরির কাজে ব্যবহার করছে।

অস্ত্রবিশেষজ্ঞরা বলেন, গাজায় ইসরায়েলের নিক্ষিপ্ত প্রায় ১০ শতাংশ বোমা ও গোলাবারুদ অবিস্ফোরিত থেকে যাচ্ছে। যদিও ইসরায়েলের দিক থেকে এই হার এর চেয়ে বেশি বলে দাবি করা হচ্ছে। ইসরায়েলের অস্ত্রাগারে গত শতকের পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশকের অনেক ক্ষেপণাস্ত্র আছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ সামরিক ক্ষমতাধর অন্যান্য দেশ বহুদিন আগে থেকেই এসব ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহার বাদ দিয়েছে।

এ বিষয়ে গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে কথা বলার অনুমতি না থাকায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসরায়েলের এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, এসব ক্ষেপণাস্ত্র অবিস্ফোরিত থাকার হার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।

গাজায় বহু বছর ধরে বিক্ষিপ্তভাবে বোমা হামলা ও সাম্প্রতিক বোমাবর্ষণ যেটাই হোক না কেন, সেখানে হাজার হাজার টন অবিস্ফোরিত সমরাস্ত্র এলোপাতাড়িভাবে পড়ে আছে, যেগুলো পুনরায় ব্যবহারযোগ্য। অবিস্ফোরিত ৭৫০ পাউন্ডের একটি বোমা থেকে কয়েক শ’ ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেট বানানো সম্ভব।

বিস্ফোরক নিয়ে কাজ করে জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন মাইন অ্যাকশন সার্ভিস। গাজায় সংস্থাটির প্রধান চার্লস বার্চ বলেন, যুদ্ধের পর গাজায় পড়ে থাকবে কামান, হাতবোমা ও অন্য হাজার হাজার অবিস্ফোরিত সমরাস্ত্র। এগুলো হবে হামাসকে উপহার দিয়ে যাওয়ার মতো একটি বিষয়। সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস

এনএ/