ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলের নির্বিচার হামলা ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মতো ইউরোপেও বিক্ষোভ-প্রতিবাদ চলছে। এসব বিক্ষোভ-প্রতিবাদে প্রতিদিনই লাখ লাখ মানুষ অংশ নিচ্ছেন। একইভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ও জায়নবাদী ইসরাইলের বর্ণবাদ ও গণহত্যার বিপক্ষে সরব অসংখ্য মানুষ।
কিন্তু যারা সবসময় মানবতা, উদারতা ও গণতন্ত্রের বুলি আওড়ায়, ইউরোপের সেই সরকারগুলোর পক্ষ থেকেই নাগরিকদের কণ্ঠরোধের ব্যাপক চেষ্টা দেখা গেছে। একইভাবে এখন লেখক, কবি ও শিল্পীদেরও একঘরে করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
‘ইহুদিবিদ্বেষী’ আখ্যা দিয়ে কখনও শিল্পীদের শিল্প প্রদর্শনী বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। কবি ও লেখকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে। বাধা দেয়া হচ্ছে বই প্রকাশনায়। যার ফলে এই অঞ্চলে সংস্কৃতি চর্চার অভিন্ন স্থানগুলো ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদন মতে, হামাস-ইসরাইল সংঘাতে মানবতার পক্ষে কথা বলায় এবং গাজায় ইসরাইলের নির্বিচার হামলার সমালোচনা করায় সম্প্রতি অনেক শিল্পী ও সাহিত্যিকের বিরুদ্ধে ‘ইহুদিবিদ্বেষে’র অভিযোগ তুলেছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ।
জার্মানি থেকে শুরু করে যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডসসহ অনেক দেশে তাদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী, বইমেলা বা অন্যান্য আয়োজনে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয়া হচ্ছে।
প্রতিবেদন মতে, গত অক্টোবরের শুরুতে যখন ইসরাইল-হামাস সংঘাত শুরু হয়, তখন বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শহিদুল আলম জার্মানিতে একটি চিত্রকর্ম প্রদর্শনী আয়োজনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
কিন্তু অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলের নির্বিচার হামলার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন তিনি। এ কারণে জার্মান আয়োজকেরা তার বিরুদ্ধে ‘ইহুদিবিদ্বেষে’র অভিযোগ এনে তার একটি প্রদর্শনী বাতিল করে।
আল জাজিরা বলেছে, বিশ্ব মানবাধিকার লঙ্ঘন ইস্যুতে কথার বলার ক্ষেত্রে শহিদুল আলম নতুন কোনো মুখ নয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে কয়েক দশক ধরে কাজ করছেন তিনি। সম্প্রতি তাকে নিয়ে প্রভাবশালীটাইম ম্যাগাজিনও একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
গাজায় ইসরাইলের নির্বিচার হামালার ক্ষেত্রে চুপ থাকেননি শহিদুল আলম। হামলার শুরু থেকেই ফেসবুকে সংঘাত নিয়ে অসংখ্য পোস্ট করেছেন তিনি। কিন্তু এসব পোস্টের কারণে শহিদুল আলমকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ অভিহিত করে জার্মান বাইয়েনাল ফর কনটেম্পোরারি ফটোগ্রাফি থেকে তার নাম বাদ দেয়া হয়।
কারণ হিসেবে ২১ নভেম্বর এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘গত ৭ অক্টোবরের পর নিজের ফেসবুক চ্যানেলে শহিদুল আলমের বিভিন্ন পোস্ট এমন বিষয়বস্তুকে সামনে এনেছে, যা ইহুদিবিদ্বেষী বিষয়বস্তু হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।’ এ ঘটনার প্রতিবাদে আলমের দুই বাংলাদেশি সহ-কিউরেটর তানজিম ওয়াহাব ও মুনেম ওয়াসিফ প্রদর্শনী থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করেন।
আয়োজক সংস্থা যে অভিযোগ করেছে, তা নাকচ করে দিয়েছেন তারা। তারা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ইতিহাসের কোন দিকে আমরা দাঁড়াবো তার সিদ্ধান্ত নেয়ার নৈতিক দায়িত্ব আমাদেরই।’
অভিযোগ নিয়ে আল জাজিরাকে এক সাক্ষাৎকারে শহিদুল আলম নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেন, ‘আমি ইহুদিবিদ্বেষী নই। আমি জায়নবাদের বিরোধী এবং একইভাবে আমি উপনিবেশবাদ, অন্যের জমি দখল করে জোরপূর্বক বসতিস্থাপন, বর্ণবাদ, জাতিবিদ্বেষ ও গণহত্যার বিরোধী।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি কোনোভাবেই ইহুদিবিদ্বেষী নই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, জার্মানি এ দুটিকে (ইহুদিবিদ্বেষ ও জায়নবাদ বিরোধিতা) এক করে দেখছে যা তাদের শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের স্বার্থকেই চরিতার্থ করছে।’
শহিদুল আলম একটা উদাহরণ মাত্র। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পশ্চিমা বিশ্বের শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনে এমন ভুরি ভুরি ঘটনা ঘটে চলেছে। ‘ইহুদিবিদ্বেষ’র অভিযোগ তুলে ইউরোপজুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুক্তচিন্তার মানুষদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিশেষ করে সম্প্রতি এমন বেশ কিছু ঘটনা জার্মানিতে দেখা গেছে। কারণ হলোকস্ট থেকে উদ্ভূত ইতিহাসের কারণে ইসরাইলের প্রতি বিশেষ দায় বোধ করছে অ্যাডলফ হিটলারের দেশটির বর্তমান সরকার ও প্রশাসন।
গত মাসে হামাসের হামলার প্রেক্ষিতে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ার ফিলিস্তিনি লেখক আদানিয়া শিবলির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। বইমেলায় গত ২০ অক্টোবর একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে পুরস্কার গ্রহণের কথা ছিল। যা তিনি তার উপন্যাস ‘মাইনর ডিটেইল’র পেয়েছিলেন।
এরপর একইভাবে ১৩ নভেম্বর জার্মান জাদুঘর ফয়েকভাংয়ে হাইতির লেখক আনাইস দুপলানের একটি প্রদর্শনী বাতিল করা হয়। একই অভিযোগ তোলা হয় ভারতীয় চিত্রকর ও শিল্প সমালোচক রঞ্জিত হোসকোটের বিরুদ্ধেও।
নেদারল্যান্ডসেও একই ঘটনা ঘটেছে। দেশটিতে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নেয়া কয়েকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়—তারা ফিলিস্তিনপন্থি স্লোগান দিয়েছেন। পরে ওই চলচ্চিত্র নির্মাতা নিজেদের প্রদর্শনী প্রত্যাহার করে নেন।
লন্ডনে মার্কিন বংশোদ্ভূত লেখক নাথান থ্রালের বই প্রকাশ করতে দেয়া হয়নি। কারণ তার বইটির নাম ‘আ ডে ইন দ্য লাইফ অব আবেদ সালামা: আ প্যালেস্টাইনিয়ান স্টোরি’। গত ১২ অক্টোবর বইটি লন্ডনে প্রকাশ হওয়ার কথা থাকলেও নিরাপত্তার অজুহাত তুলে বইটির প্রকাশনা অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।
জেএম/