সদকার তাৎপর্য ও প্রসঙ্গ কথা
প্রকাশ:
২৭ নভেম্বর, ২০২৩, ০৭:৩৩ বিকাল
নিউজ ডেস্ক |
<যাকারিয়া মাহমুদ> সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ ধনী গরীব দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। যারা ধনী, আল্লাহ তাআলা বলেছেন—তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের (গরীবদের) হক রয়েছে। (সুরা জারিআত,আয়াত–১৯) সদকা কাকে বলে? صدقة (সদাকাহ)— শব্দটি মূলত আরবি। যার আভিধানিক অর্থ হলো–দান,খয়রাত,যাকাত। বাংলা অভিধান মতে–বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর নামে কোনো কিছু উৎসর্গ। (বা.একা.ব্যবহারিক অভিধান, পৃ.–১২৭৯) পরিভাষায়—প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে সম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে অসহায় ও দীন-দুঃখীদের জন্যে ব্যয় করা হয় তাকে সদকা ও খয়রাত বলে। ( সংক্ষিপ্ত তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন, পৃ.–১৪২) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন– তুমি ( আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে) যা কিছুি ব্যয় করো তাই সদকা। এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে নলাটি তুলে দাও সেটাও। (বোখারি,হাদিস নং–৫৩৫৪) সদকার নির্দেশ অনুরূপ নির্দেশ এসেছে অন্য এক আয়াতে—হে নবী! আমার মুমিন বান্দাহদের বলে দিন, যেন তারা সালাত কায়েম করে এবং আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে গোপনে-প্রকাশ্যে ব্যয় করে। সে দিন আসার পূর্বে যে দিন ক্রয়-বিক্রয় এবং বন্ধুত্ব বলতে কিছুই থাকবে না। (সূরা ইবরাহিম, আয়াত:৩১) আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন—তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ইমান আনো। এবং আল্লাহ তোমাদের যে সম্পদের উত্তরাধিকার করেছি, তোমরা তা থেকে কিছু তাঁর পথে ব্যয় করো। সুতরাং যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ইমান আনে এবল ব্যয় করে, তাদের জন্যে রয়েছে মহাপুরস্কার। (সুরা হাদিদ,আয়াত:৭) হজরত আদি ইবনে হাতেম তাঈ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন—তোমরা জাহান্নাম থেকে বাঁচো। একটি খেজুর সদকা করে হলেও। (সহীহ বোখারি, হাদীস নং ১৪১৭ । সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০১৬) সদকার বস্তু কী ও কেমন হবে? পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন— হে মুমিনগণ! তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং আমি তোমাদের জন্যে ভূমি থেকে উৎপন্ন করি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করো। নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয়ের ইচ্ছা করো না। কারণ, তোমরা তা কখনোই গ্রহণ করবে না। তবে যদি তোমরা চোখ বন্ধ করে নাও; তাহলে জেনে রেখো–আল্লাহ অভাবমুক্ত,প্রসংশিত। (সুরা বাকারাহ, আয়াত:২৬৭) এ আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে,—সদকা করতে হবে উৎকৃষ্ট এবং সেরা বস্তু। নিকৃষ্ট বস্তু সদকা করা যথাবিধি নয়। কেননা মানুষ মাত্রই উৎকৃষ্ট বস্তু পছন্দ করে। আরেক আয়াতে বলা হয়েছে—হে মুমিনগণ! তোমরা কস্মিনকালেও কল্যান লাভ করতে পারবে না। যদি তোমরা তোমাদের সবচে’ প্রিয় বস্তু (আল্লাহর পথে) ব্যয় না করো। এবং তোমরা যা কিছুই ব্যয় করো আল্লাহ তাআলা তা জানেন। ( সুরা আলে ইমরান,আয়াত:৯২) উক্ত আয়াতের প্রভাব উক্ত আয়াত অবতীর্ণের পর তিনি উপস্থিত হলেন নবীজির দরবারে। বললেন—আল্লাহর রাসুল! আমি আমার সবচে’ প্রিয় সম্পদ ‘বাহিরা’ আল্লাহর পথে সদকা করে দিলাম। নবীজি তাঁকে বাহ! বাহ! দিলেন। এবং বললেন—তোমার এই বাগান তুমি তোমার স্বজনদের মধ্যে বণ্টন করে দাও। রাসুলের নির্দেশানুযায়ী তিনি সে বাগান আত্মীয়-স্বজন ও তাঁর চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন। (সহিহ বোখারি হাদিস নং ১৪৬১, সহিহ মুসলিম হাদিস নং ৯৯৪) তাফসীরে মাজহারি,ইবনে জারির ও তিবরানি’র সূত্রে মাআরিফুল কোরআনে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ রয়েছে —উক্ত আয়াত অবতীর্ণের পর হজরত জায়েদ ইবনে হারেসা রাদিআল্লাহু আনহু দেখলেন যে,বাহনের ঘোড়া তাঁর সবচে’ প্রিয় সম্পদ। তিনি তা নিয়েই উপস্থিত হলেন নবীজির দরবারে। নবীজি খুশি মনে তা গ্রহণ করলেন। এবং ঘোড়াটি জায়েদেরই পুত্র ওসামাকে দিয়ে দিলেন। নিজের সম্পদ নিজের ঘরে ফিরে যেতে দেখে তিনি মনঃক্ষুণ্ন। নবীজি তাঁকে কাছে ডেকে সান্ত্বনা দিলেন। বললেন– মনঃক্ষুণ্ন হয়ো না জায়েদ! তোমার সদকা কবুল হয়েছে। (সংক্ষিপ্ত মা'আরেফুল কুরআন, পৃ–১৮৬) সদকা গ্রহণীয় হওয়ার শর্ত এটা সুরা বাকারাহ'র ২৬২ নম্বর আয়াত। এ আয়াত থেকে স্পষ্টই বোঝা সদকা শুদ্ধ হওয়ার দুটি শর্ত: আল্লামা শফি (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর তাফসিরে আরও তিনটি শর্তের কথা উল্লেখ করেছেন। সদকা গ্রহণের যোগ্য কারা উল্লেখ্য যে, সাহাবায়ে কেরাম ও সকল তাবেয়িদের ঐকমত্যে কুরআনে বর্ণিত উক্ত খাত ওয়াজিব সদকা তথা যাকাত ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার সাহাবীদের লক্ষ করে বললেন—যদি তোমরা চাও,তাহলে আমি তোমাদের সদকা দিতে পারি তবে মনে রেখো,কোনো ধনী ও কর্মক্ষম ব্যক্তি সদকা খেতে পারে না। (আবু দাউদ,হাদিস নং–১৬৩৩) সারকথা হলো—গরীব,মিসকিন, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি,সহায়-সম্বলহীন মুসাফির এবং মুজাহিদ সদকা গ্রহণের অধিক উপযুক্ত। আরো সহজ করে বললে, নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয় এমন সবাই সদকার উপযোগী। শুধু হাসেমি বংশ ব্যতিত। সদকার ফজিলত আল্লাহ আরও বলেছেন—যারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করে রাত-দিনে,গোপনে-প্রকাশ্যে তাদের প্রতিদান রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকট। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না। ( সুরা বাকারা,আয়াত:২৭৪) আরেক আয়াতে আল্লাহ বলেন–যারা আল্লাহর কিতাব (কুরআন) পাঠ করে,নামাজ কায়েম করে,এবং আমি তাদের যা দিয়েছি তা থেকে গোপনে-প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসা করে যাতে কখনোই লোকসান হবে না। পরিণামে আল্লাহ তাদের পরিপূর্ণ দেবেন। এবং নিজ অনুগ্রহে আরও বেশি দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী। (সুরা ফাতির, আয়াত:২৯–৩০) সদকার নেকি সাতশো গুণে বৃদ্ধি পায়! পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে—যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি বীজের মতো। যা থেকে সাতটি শীষ জন্মায়। প্রত্যেক শীষে একশো করে দানা। আল্লাহ অতি দানশীল,সর্বজ্ঞ। (সুরা বাকারাহ,আয়াত:২৬১) রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুরপরিমাণ সদকা করে,আল্লাহ তার সদকা (রহমতের) ডান হাতে গ্রহণ করেন। এই হাদিসের শেষে নবীজি বলছেন, আল্লাহ খেজুর পরিমাণ সে সম্পকে পাহাড় পরিমাণ বানিয়ে দেন। ( বোখারি,হাদিস:১৪১০) হযরত আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত নবী কারিম সা. বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন —হে আদম সন্তান! তুমি দান কর,আমি তোমাকে দান করব। ( মুসলিম, হাদিস:২১৮০) অন্য হাদিসে আছে—কেয়ামতের দিন সাত শ্রেণীর মানুষ আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে, তন্মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণী হচ্ছে, যারা গোপনে সদকা করে। (বোখারি,হাদিস নং–১৪২৩) সদকার এমন অসংখ্য ফজিলতের বর্ণনা পাওয়া যায় কুরআন ও হাদিসে। আর সে জন্যই সাহাবীগণ সবসময় সদকায় প্রতিযোগিতা করতেন। এতএত ফজিলত তাঁরা কখনোই হারাতে চাননি। একটু আগে হজরত আবু তালহা ও জায়েদ রাদিআল্লাহু আনহুমার দুটি ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। সদকার পথে এমন অগ্রপথিক ছিলেও অন্যান্য সাহাবিগণও। এখানে যদি তাঁদের সংক্ষিপ্ত তালিকাও লেখা হয়, তবেও লম্বা ফিরিস্তি হয়ে যাবে। সুতরাং সকল মুসলমানদেরই উচিত স্বতঃস্ফূর্তভাবে সদকা করা। যাতে বর্ণিত সকল ফজিলতের অধিকারী হয়ে পরকালে জান্নাতের পথ সুগম করা যায়। তবেই সার্থক হবে জীবন। রব্বে কারিম সকলকেই তাওফিক দান করুন। আমিন। লেখক: শিক্ষার্থী ,মারকাযুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া,উত্তর বাড্ডা, ঢাকা–১২১২ জেএম/ |