দ্বীনি কাজে অর্থব্যয়: প্রয়োজনীয়তা ও ফজিলত 
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর, ২০২৩, ০৬:৪০ বিকাল
নিউজ ডেস্ক

।।মুফতি যুবাইর মাহমুদ রাহমানি।।

ধনসম্পদ দয়ালু আল্লাহর অপার দান। এতে কোন বিশ্বাসী বান্দার সংশয় থাকার কথা নয়। সম্পদের মধ্যে যাকাত ছাড়াও রয়েছে আরও কিছু হক। এ হকসমূহ আদায় করা মুমিন বান্দার কর্তব্য। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

"إن في المال لحقا سوى الزكاة".

নিশ্চয় সম্পদে যাকাত ছাড়াও রয়েছে হক।
(কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ১৬০০৬)

যাকাত ছাড়া সম্পদে কী কী হক রয়েছে, তার বিশদ বিবরণ হাদিসে দেওয়া হয়নি; তবে তার প্রতি কিছুটা ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেমন এক হাদিসে প্রিয়তম নবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, "পড়শি যদি অভুক্ত হয়ে ঘুমোয়, তবে তুমি মুসলিম নও।" অন্য হাদিসে এসেছে, "ভিক্ষুককে খালিহাতে ফিরিয়ে দিয়ো না।"

মূলত হাদিস শরিফে হকসমূহ স্পষ্টাকারে না বলে সংশ্লিষ্টদের সচেতন বিবেকের কাছে বিষয়টি ন্যস্ত করা হয়েছে। ফলে তারা চিন্তা করে বের করবে, জরুরি খরচের উপযুক্ত খাত কী কী? যেমন গরিব দুস্থ স্বজনদের দেখভাল করা, ধর্মীয় কাজে ব্যয় করা ইত্যাদি।

ধর্মীয় কাজে ব্যয় করতে হবে সাধারণ মুসলমানদেরই। সরকার থেকে কিছু আশা করা নিষ্ফল। তারা মসজিদ মাদ্রাসার কাজে ব্যয় করতে খুব একটা আগ্রহী নন। সুতরাং এক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে সকল আপামর মুসলমানের। কারণ দ্বীনের পথে ব্যয়ে রয়েছে সীমাহীন ফজিলত। যার কিয়দংশ নিচে তুলে ধরছি।

১. পরকালের সঞ্চয় : একজন ইমানদার বান্দার একনিষ্ঠ স্বেচ্ছাদান তার পরকালের বিরাট সঞ্চয়। এ মর্মে আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, 

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ، وَلاَ يَقْبَلُ اللَّهُ إِلَّا الطَّيِّبَ، وَإِنَّ اللَّهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِينِهِ، ثُمَّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهِ، كَمَا يُرَبِّي أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ، حَتَّى تَكُونَ مِثْلَ الجَبَلِ»

হজরত আবু হুরাইরা রা. বর্ণনা করেন, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তার হালাল উপার্জন হতে একটি খেজুর পরিমাণ দান করল আর আল্লাহ হালাল-পবিত্র বস্তুই কেবল গ্রহণ করেন, আল্লাহ তায়ালা তার দানকে নিজ কুদরতি হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর তাকে তার দাতার জন্য লালন করেন,  যেমন তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তার বাচ্চাকে লালন-পালন করে। ফলে তা পাহাড়সম হয়ে যায়। "
(বুখারি শরিফ, হাদিস নং ১৪১০)

"اعلموا أنه ليس منكم أحد إلا مال وارثه أحب إليه من ماله، مالك ما قدمت ومال وارثك ما أخرت".

জেনে রেখো, তোমাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি নেই, যার নিকট নিজের সম্পদের চাইতে তার ওয়ারিসের সম্পদ অধিক প্রিয়! মূলত তোমার সম্পদ হচ্ছে যা তুমি অগ্রে প্রেরণ করবে। আর তোমার ওয়ারিসের সম্পদ হচ্ছে যা পশ্চাতে রেখে যাবে।
(কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ১৫৯৮৮)

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: " يَقُولُ الْعَبْدُ: مَالِي، مَالِي، إِنَّمَا لَهُ مِنْ مَالِهِ ثَلَاثٌ: مَا أَكَلَ فَأَفْنَى، أَوْ لَبِسَ فَأَبْلَى، أَوْ أَعْطَى فَاقْتَنَى، وَمَا سِوَى ذَلِكَ فَهُوَ ذَاهِبٌ، وَتَارِكُهُ لِلنَّاسِ "،

সাহাবি আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বান্দা বলে আমার সম্পদ, আমার সম্পদ। অথচ তার প্রকৃত সম্পদ শুধু তিনটি : ১. যা সে ভক্ষণ করে নিঃশেষ করেছে। ২. পরিধেয় বস্ত্র, যা সে পরে পুরাতন করেছে। ৩. যা সে দান করে সঞ্চয় করেছে। এছাড়া যা রয়েছে, তার মালিকানা তার নয় বরং তা সে মানুষের জন্য রেখে যাবে।
(মুসলিম শরিফ, হাদিস নং ১৯৫৯)

২. পার্থিব বিপদাপদ বিদূরিত হওয়া: দান-সদকা মানুষের বালা-মসিবত দূরীভূত করে। এ প্রসঙ্গে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, الصدقة ترد البلاء

দানসদকা বালামুসিবত দূরীভূত করে দেয়। 

অন্যত্র এসেছে,

"تداركوا الغموم والهموم بالصدقات يكشف الله تعالى ضركم وينصركم على عدوكم". 

 দান-সদকার মাধ্যমে তোমরা তোমাদের দুঃখ দুর্দশার প্রতিকার কর। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের দুঃখ কষ্ট দূর করে দেবেন এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে তোমাদের সাহায্য করবেন। (কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ১৬০১২)

"الصدقة تمنع سبعين نوعا من أنواع البلاء أهونها الجذام والبرص"

দান-সদকা সত্তর ধরনের বিপদ দূর করে দেয়, যার মধ্যে সবচাইতে সহজতর রোগ হল কুষ্ঠ ও শ্বেত রোগ।
(কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ১৫৯৮২)

৩. আল্লাহর রাগকে প্রশমিত করে এবং অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে : আল্লাহর রাস্তায় দান করলে আল্লাহ তায়ালার রাগ নিভে যায় এবং অপমৃত্যু থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এ মর্মে প্রিয়তম নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

- "إن الصدقة لتطفئ غضب الرب وتدفع عن ميتة السوء"

নিশ্চয় দান-সদকা প্রতিপালকের গোস্বাকে নির্বাপিত করে এবং অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে।
(কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ১৫৯৯৫)
 

৪. দানসদকা সম্পদ বৃদ্ধির কারণ : ধন-সম্পদ দ্বীনি  কাজে ব্যয় করলে সম্পদ হ্রাস পায় না বরং আরো বৃদ্ধি পায়। আপনি এমন কোন ব্যক্তিকে দেখাতে পারবেন না, দান করার কারণে যে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এজন্যই হাদিসে পাকে বলা হয়েছে, 

 عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِنْ مَالٍ،

হজরত আবু হুরাইরা রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ ফরমান, দানসদকা সম্পদকে হ্রাস করে না।
(মুসলিম শরিফ, হাদিস নং ২৫৮৮)

পাক কালামে ইরশাদ হয়েছে,

يَمْحَقُ اللَّهُ الرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ

আল্লাহ তায়ালা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দানসদকাকে বৃদ্ধি করেন।
(সুরা বাকারা : ২৭৬)

"استنزلوا الرزق بالصدقة"

দানসদকার মাধ্যমে রিজিক নামিয়ে আন।
(কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ১৫৯৬২)

"ما عظمت نعمة على عبد إلا وعظمت مؤونة الناس عليه، فمن لم يحتمل مؤونة الناس فقد عرض تلك النعمة للزوال".

কোন বান্দার ওপর আল্লাহর নেয়ামত বেশি হলে তার ওপর মানুষের দায়দায়িত্বও বেড়ে যায়। সুতরাং যে ব্যক্তি তা বহন করল না, সে উক্ত নেয়ামতকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিল। 
(কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ১৬২০২)

৫. দানসদকার মাধ্যমে সুনাম ও মানুষের ভালোবাসা অর্জন হয়: দান-সদকা করলে যেমন সুনাম বৃদ্ধি পায়, তেমনি মানুষের ভালোবাসাও অর্জন হয়। 

"من طلب محبة الناس فليبذل ماله".

 যে ব্যক্তি মানুষের ভালোবাসা লাভ করতে চায়, সে যেন নিজ সম্পদ ব্যয় করে।(কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ১৬২০৫)

৬. জান্নাত লাভ ও জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ : দানশীল ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা জান্নাত দান করবেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করবেন। এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে,

"السخاء شجرة تنبت في الجنة فلا يلج الجنة إلا سخي والبخل شجرة تنبت في النار فلا يلج النار إلا بخيل".

দানশীলতা একটি বৃক্ষ, যা জান্নাতে উৎপন্ন হয়। সুতরাং দানশীল ব্যতিত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর কার্পণ্য একটি বৃক্ষ, যা জাহান্নামে উৎপন্ন হয়। কাজেই জাহান্নামে একমাত্র কৃপণ ব্যক্তিই প্রবেশ করবে।
(কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ১৬২০৭)

আরও ইরশাদ হয়েছে,

"السخي قريب من الله قريب من الناس قريب من الجنة بعيد من النار، والبخيل بعيد من الله بعيد من الناس بعيد من الجنة قريب من النار، ولجاهل سخي أحب إلى الله من عابد بخيل".

দানশীল ব্যক্তি আল্লাহর নিকটবর্তী, মানুষের নিকটবর্তী এবং জান্নাতেরও নিকটবর্তী। জাহান্নাম থেকে দূরে। আর কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ থেকে দূরে, মানুষ থেকে দূরে এবং জান্নাত থেকেও দূরে। অবশ্য জাহান্নামের নিকটবর্তী। একজন মূর্খ দানশীল ব্যক্তি কৃপণ আবেদের চাইতে আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়।
(কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ১৫৯২৮)

রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও ইরশাদ ফরমান, :

«اتَّقُوا النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ»

তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো একটি খেজুরের টুকরো দিয়ে হলেও।
(বুখারি শরিফ, হাদিস নং ১৪১৭)

৭. ফেরেশতার দুআ লাভ: দানকারীর জন্য রোজ একজন ফেরেশতা দোয়া করেন। পক্ষান্তরে কৃপণ ব্যক্তির জন্য অপর একজন ফেরেশতা বদদোয়া করেন। নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

"ما من يوم يصبح العباد فيه إلا ملكان ينزلان، فيقول أحدهما: اللهم أعط منفقا خلفا، ويقول الآخر: اللهم أعط ممسكا تلفا".

এমন কোন দিন নেই , যাতে বান্দা সকাল করে; দুজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হন। তাঁদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! আপনি দানকারীকে তার বদলা দিন। আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! যে দান করেনি, আপনি তার সম্পদকে ধ্বংস করে দেন। 
(কানযুল উম্মাল, হাদিস নং ১৬০১৬)

আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : মুহাদ্দিস, জামিআ হোসাইনিয়া মদিনাতুল উলুম (ভোলা)
পরিচালক, রাহমানিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, চরফ্যাশন, ভোলা।

এনএ/